সজল ছত্রী

২৭ আগস্ট, ২০১৫ ১৩:৩৯

আমাদের গানের পাখি

কাল রাতে ঝড় হয়েছে। দারুণ ধস্তাধস্তি করে ভেঙে গেছে অনেক গাছের ডাল। খাল-বাকল ছড়ে গেছে। শেষরাতে ধুম বৃষ্টি। তরতাজা ক্ষতে শুদ্ধ তরলও বেশ জ্বলুনি দেয়। কিন্তু এই বিকেলবেলা, সবুজান্ত বৃক্ষপল্লব তার কোনো জানান দেয় না। তোপখানার সরকারি কলোনিতে এখন কিশোরির মতো উচ্ছ্বল সময়।

আমরা যার সাথে কথা বলতে এসেছি তাঁর বিষয়ে মোটামুটি কিছুই জানি না। তাঁর অনাড়ম্বর জীবনিকার হবার ইচ্ছে ও সাধ্য কোনোটাই নেই। যারা জানেন বা জানতেন, এই সিলেট শহরে সেসব মানুষের খোঁজে বেশ বিপাকে পড়তে হয়। কবি তুষার কর বললেন, আমি তাঁর গান শুনেছি, এর বেশি কিছু নয়।

শুভেন্দু ইমাম বললেন, উনিতো আমার মেয়ে হন! আমাকে বাবা বলেন।
কিছু তুলে আনতে হলে বুড়োদের দ্বারস্থ হতে হয়। বুড়োতেই উদ্ধার। আমরা তরুণতম কাউকে খুঁজতে থাকি এবং নিজেরাই শেষ পর্যন্ত নিজেদের প্রতিনিধি হিসেবে মনোনীত করি। আমি, দেবাশীষ দেবু, আব্দুল বাতেন, ইসমাইল গণি হিমন, এবং বিপ্লব সাহা এসেছি চন্দ্রাবতী রায় বর্মণ-এর কাছে।

দিদিমা, বয়স কতো হল?
আশি তো হবেই।

চন্দ্রাবতী রায় বর্মণ, লোকগানের শিল্পী। স্রেফ শিল্পী। গান গান। এর বেশী কিছু নয়। একটা গান লিখেছিলেন, দু’কলি শোনালেন, ‘যাব আমি বহুদুরে/ বিলম্ব সহেনা প্রাণে/ মন মাঝি ভাই গলুইতে নাওয়ের পাল তোলো...’ তিনি কিছুতেই এর বেশি গাইতে চান না এবং গানের লিখিত কপিও দিতে চান না। ‘আমি ভাই শখের বশে একটা গান লিখে ফেলেছি, কিন্তু এ আমার কর্ম নয়। এটা তুলে আনার দরকার নেই।’

বটে! চন্দাবতী রায় এমন করেই আড়ালে রয়ে যান। পুরোপুরি ফুলের মতো, পাখির মতো। জন্মগত সুগন্ধময়, রূহগত গায়িকা।

তাঁর কোনো গুরু নেই, রেওয়াজও করেন না তিনি অথচ গান গাইছেন সত্তর বছর ধরে। দেশে অনেক সম্মাননা পেয়েছেন, কোলকাতায় বাউল সম্মেলন, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মাননা জানিয়েছে। কোথায় কোথায় সম্মাননা পেয়েছেন? প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দিয়েছে কেউ কেউ, ভারতেও পেয়েছি। আর? সবার নাম মনে করতে পারেন না, ভেতরে গিয়ে কতগুলো ক্রেস্ট নিয়ে আসেন।

ধবধবে সাদা শাড়ি, বয়সের ভারে খানিকটা নুয়েপড়া শরীর... আমরা একটু কল্পনাবিলাসী হই অগ্রসরমান সভ্যতাকে তার বর্তমান ধারক দেখিয়ে দিচ্ছেন অবশিষ্ট পাথেয়... এইগুলি অর্জন, এ-ই অর্জিত হতে হতেই সময় চলে যায়। চন্দ্রাবতী রায় বর্মণরা চুরাশিতে পা রাখেন, খেদহীন, সামান্য অর্জন নিয়ে, আর সজল ছত্রীরা তিরিশে পৌঁছে যায়, অর্জনহীন, আনন্দহীন, দ্বিধাদ্বন্দ্বভরপুর সুড়ঙ্গ বেয়ে।

আমাদের কথা হয় সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায়। তিনি আমাদের উত্তর দেন সিলেট এবং সুনামগঞ্জের একটি মিশ্র মিষ্টভাষায়। মনে মনে আমরা তার শিষ্টরূপকল্প এঁকে নিই। বাউল উৎসব,শ্রুতি, নাট্যমঞ্চ, গ্রামীনফোন বইমেলা। ক্রেস্ট অনেকগুলো।

ভারতের সাথে যোগাযোগ হল কিভাবে?
ঐ একটা মেয়ে আছে না, মৌসুমী, তার মাধ্যমে।
কোন মৌসুমী!
খুব সুন্দর গান গায় মেয়েটা। নিজে লেখে, নিজে গায়। লোকগান, পল্লীগান সংগ্রহ করে, গবেষণা করে। কে পুরোনো দিনের গান গায় খুঁজতে খুঁজতে অম্বরিষ দত্ত আমার কাছে নিয়ে এলেন। ও আমার কাছ থেকেও কিছু কিছু গান সংগ্রহ করেছে।

গানের পাখির গুছিয়ে কথা বলার কথা নয়। চলুন, আমরা নিজেরা নিজেদের মতো করে গুছিয়ে ভেবে নিই: মৌসুমি ভৌমিক নামের প্রখ্যাত গায়িকা ভারত থেকে পুরোনো দিনে গান খুঁজে খুঁজে সিলেট এলেন আর খোঁজ পেলেন চন্দ্রাবতী রায় বর্মণ ‘মাসিমা’র। তাঁর মনে হল, এই মহিলার অবশ্যই সম্মাননা পাওয়া উচিত। তিনি তাঁকে কোলকাতা বাউল উৎসবের আয়োজকদের মাধ্যমে আমন্ত্রণ জানালেন। মৌসুমী ভৌমিকের সাথে তাঁর প্রায়শই যোগাযোগ হয়।

বাউল উৎসবের অভিজ্ঞতা জানতে চাইলে তিনি বললেন, ও বাবারে! অনেক বাউল, অ-নেক-ক বাউল। কত গান শুনতে হবে, অনেক সুন্দর সুন্দর গান। আমিও গাইলাম।

বহু বৈচিত্রময় অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ চন্দ্রাবতী রায় বর্মণ। গান করেছেন শাহ আবদুল করিম, গিয়াসউদ্দিন, রামকানাই, বিদিতলাল, সুষমা দাশ, হিমাংশু বিশ্বাস, কতোজনের সাথেই। গান শুনে শাহ আবদুল করিম এলেন তাঁর বাসায়। সুস্থাবস্থায় প্রায়ই আসতেন। বলতেন- চলেন, আমার একত্র হয়ে যাই!
একত্র মানে!
এই জাতি, বিভেদ, হিন্দু, মুসলমান...
বটে! বাদশা আকবরের স্বপ্ন, আদিমতম মানুষের স্বপ্ন। অনাস্তিকের ঈশ্বরজয়ী গল্প।

চন্দ্রাবতী রায় বর্মণ জন্মগ্রহণ করেন ১৩৩৮ সনের ২৬ ফাল্গুন। পিতার নাম সহদেব বর্মণ, মাতা মুক্তা রানী বর্মণ। জন্ম সুনামগঞ্জের নদীঘেঁষা গ্রাম জগন্নাথপুরে। ছেলেবেলা-মেয়েবেলার কথা বললে সবাই যেমন ভাবালুপ্ত হন, তিনিও তেমন।

অনেক দুরন্ত ছিলেন, গান ভালবাসতেন। তৃতীয়মানের পরীক্ষায় বৃত্তি পেয়েছিলেন। কিন্তু ‘যাব আমি অনেক দূরে, বিলম্ব সহেনা প্রাণে...’ তাঁর গানের মতোই বিলম্ব সইলো না। তেরো বছর বয়সে ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় তাঁর বিয়ে হয়ে যায়। বর সুনামগঞ্জের কালাগোজা গ্রামের সরকারি চাকুরিজীবি ভারতচন্দ্র রায় বর্মণ। অদম্য ইচ্ছার কারণে নাইওর গেলে গান আর স্বামীর সহযোগিতায় মেট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন চন্দ্রাবতী।

ছোটবেলায় তাঁর দিদিমা রাজেশ্বরী বর্মণের কাছ থেকে গান শিখতেন। দিদিমার দিদিমা। মজার তথ্য। তিনি গান গাইতেন পাড়াগাঁয়ের বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানে। কার গান? নিদেনপক্ষে রাধারমণের? হ্যাঁ রাধারমনেরও গাইতেন।
আপনি রাধারমনকে দেখেছেন?
না, তবে আমি যখন গাইতাম তখন সম্ভবত তিনি বেঁচেছিলেন।

পল্লীগীতি, পদ্মপুরাণ, সর্যব্রতের গান, ধামাইল এসব গানই গাইতেন। গ্রামে যখন কেউ গ্রমোফোন নিয়ে বেড়াতে আনতেন, বান্ধবিদের নিয়ে গ্রামোফোনের সাথে গলা মেলাতেন, মন মেলাতেন। পাঠশালায় পরিদর্শনে আসতে পরিদর্শক, চন্দ্রাবতী বেণি দুলিয়ে পাঠশালার পক্ষ থেকে গান শুনিয়ে তাদের মুগ্ধ করতেন। স্বামীর চাকুরীসূত্রে সিলেট আসেন একসময়। ১৯৬৯ সালে রেডিওতে অডিশন দেন। গান গাওয়ার জন্য মনোনীত হন।

রেডিওপ্রধান সেই যুগে নিজেকে আবার ভাল করে আবিষ্কারের আগেই চলে আসে স্বাধীনতা সংগ্রাম। নয় মাস দেশছাড়া থাকার পর আবার ফেরেন। নতুন করে শুরু করেন।

আপনার গানের ক্যাসেট বের হয়েছে কখনো?
নারে ভাই।
বের করেন একটা।

হা হা করে হাসনে তিনি। কোনো খেদ নেই। বললেন, অনেক মানুষ আছে ভাই, ভাল গায়, তাদের ক্যাসেট হোক। আমি বুড়ো মানুষ, আমি আর কয়দিন।

কিন্তু আপনি তো এখনো অনেক ভাল গান করেন। বসন্ত উৎসবে শ্রীহট্ট সংস্কৃত কলেজ মাঠ মাতিয়ে দিয়েছিলেন।
তাই নাকি! হা হা হা
আবার হাসলেন তিনি।

নিজে গিয়ে চা নিয়ে এলেন। বিস্কুট প্রথম দিন। দ্বিতীয় দিন নুডল্স আর চা। চানাচুর এবং অতি অবশ্যই পান-সুপারি। হাঁটুর সমান বয়সীদের পান-সুপারি খেতে সাধেন দ্বিতীয় দিনও। কম্পমান ট্রে-ভর্তি খানা নিয়ে তিনি যখন রুমে ঢুকেন, মনে হয়, এই পড়ল এই পড়ল। পড়েনা। সামলে নেন তিনি দক্ষ হাতে।
লোকগান বলতে আপনি কী বুঝেন দিদি?
লোকগান আর কী- গ্রামের মানুষের গান, পুরোনোদিনের গান।
-মানে গ্রাম্যভাষা থাকলেই সেটা লোকগান?
-না, সেটা তো পল্লীগান।
-তো, পল্লী আর লোকগানে তফাৎ কী?

তিনি এবার হাসলেন। সেই হাসিতে সৌন্দর্যের পাশাপাশি তাচ্ছিল্য। কয়েকজন তরুণের প্রতি ভৎর্সনা, যারা লোকগান কী তা না জেনেই চলে এসেছে নিছকই এক লোকগানের গায়িকার সাথে কথোপকথনে।
-লোকগানে অনেক সুন্দর সুন্দর কথা থাকে। সত্য থাকে। লোভ-লালসা থাকে না। ইতিহাস থাকে।
-এসবের প্রেমেই পড়েছিলেন?
-হ্যাঁ, সুন্দর সুন্দর কথা আর সুর।
-তার পর?

-তার পর আর কি! প্রতিবেশির বাড়িতে কেউ গ্রামোফোন নিয়ে গ্রামে বেড়াতে এলে মন দিয়ে গ্রামোফোনের গান শুনতাম। গাইতাম। তেরো বছরে বিয়ে হয়ে গেল। সব বন্ধ। বাবার বাড়ি গেলে আবার শুরু করতাম। তবে স্বামী পছন্দ করত, এটা ছিল সুবিধা। স্বামীর সাথে যখন সিলেট আসলাম, সহযোগিতা করলেন। রেডিওতে অডিশন দিলাম।
-তার পর এগিয়ে চলা।
-না, তার পর যুদ্ধ শুরু হল। স্বাধীনতা সংগ্রাম। সব ফেলে ভারতে চলে গেলোম। নয়মাস পর ফিরলাম।
-আপনার গানের গলা ভাল। গানের অন্য কোনো শাখা বেছে নিলেন না কেন? রবীন্দ্রসঙ্গিত, নজরুলসঙ্গিত, আধুনিক গান।
-ওরে বাবা! ও-গুলোতে সাধন লাগে না!
-লোকগানে লাগে না?
-লাগে। আমি তো শুনে শুনে, নিজের চেষ্টায় শিখেছি। রেডিওতে কখনো কখনো সাহায্য নিয়েছি। আধুনিক গান আমার কর্ম নয় আমি তো রেওয়াজও করি না, শুধু গান গাই।
-আপনি পাখি, গানের পাখি। পাখির ওস্তাদ নেই। পাখি শুনে শুনে গায়।
-হা হা হা।
-মনে হয় না যে, অন্য কোনো গান গাইলে চন্দ্রাবতী রায় বর্মণ আরো অনেক বড় নাম হতে পারত। নাম, যশ...।
-ওরে বাবা! এখন কম কী। এসব দিয়ে আমি কী করব?
-কোনো দুঃখ নেই? খেদ?
-না, সংসারে সুখি আমি। তবে আরো ভাল করে গাইবার ইচ্ছেটা ছিল মনে। লেখাপাড়া করার ইচ্ছেটা আরো অনেক বেশি ছিল। হল না।
-কেন?
-সবাইকে দিয়ে কি আর সবকিছু হয়! যা হয়েছে তা নিয়ে সুখি থাকতে হয়। হলে ভালো। না-হলে যে সব গেল তেমন তো নয়।
-বাধা পাননি গান গাইতে গিয়ে?
-কত! কত নিন্দা, কত সমস্যা। তবে কিছু দমাতে পারেনি। তখন কি আর এখনের মতো সময় ছিল! তবে সেসময়েও সমঝদার মানুষ ছিলেন।

চন্দ্রাবতী রায় বর্মণকে দুঃখাক্রান্ত করা যাচ্ছে না। জৌলুসের প্রতি তার কেন লোভ থাকবে না? আমরা এ যুগের, তৃতীয়বিশ্বের তরুণরা দমে যাই না। আমরা জানি অগ্রসর যন্ত্রময় সময়ে দুরন্তগতিতে ছুটন্ত মানুষের চূড়ান্ত লক্ষ্য কী। প্রচারের বিশাল মাধ্যম হাঁ করে আছে কিসের জন্য।

-গান গেয়ে জীবনে কত টাকা রোজগার করেছেন?
প্রশ্নটা বুঝতে একটু সময় লাগল চন্দ্রাবতীর। বুঝতে পেরে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন। না, এবারের হাসিতে কোনো তাচ্ছিল্য নেই। করুণা আছে। দয়াদ্র তাঁর হাসি।
-অনেক পেয়েছি। মানুষ আমাকে চেনে, ভালোবাসে। আচার অনুষ্ঠানে ডাকে।
-কত টাকা নেন আপনি অনুষ্ঠান প্রতি?
-আমাকে কে টাকা দেবে? রেডিওতে দেয়। একক গানে ৫শ’ ৬৮ টাকা। সমবেত হলে তিনদিনে এক হাজার ৬৮।
-বাঃ! অনেক টাকা। মাসে কয়টা অনুষ্ঠান পান?
এবার প্রশ্নের বাঁকটা ধরতে পারলেন তিনি।
-কম কী! রেডিওতে শুরু করেছিলাম কুড়ি টাকা দিয়ে। এখন মাসে দুটো অনুষ্ঠানতো পাই-ই।

বিপ্লব সাহা চন্দ্রাবতীকে গান শুনাচ্ছেন। খুব ধীর লয়ে। আমরা ভাবছি চন্দ্রাবতীকে আর কী কী প্রশ্ন করা যায়। তাঁকে মোটামুটি তুলে আনার ইচ্ছে আমাদের। এই শহরের বুড়োরা তাঁর গান শুনেছেন। তরুণরা তাঁকে দেখে বিস্মিত হয় -এর বেশি চন্দ্রাবতী কিছু নয়। আমাদের আপ্রাণ চেষ্টা তাঁর আরো কিছুকে সামনে নিয়ে আসা। বিপ্লব সাহা কোন অঞ্চলের বাউলের গান শোনাচ্ছেন কে জানে। মন দিয়ে শুনলেন চন্দ্রাবতী।
বললেন, আহা কী সুন্দর!

বিপ্লব সাহা বললেন, বাউলরা ঈশ্বরকে চিন্তা করে গান লিখেন। চন্দ্রাবতী মেনে নিলেন। তার পর বললেন, তাদের একটা জগত আছে। অভিযোগ আছে, সৃষ্টিকর্তার প্রতি। অনেক অনুযোগ জানায়। মানতে চায় না। দেহতত্ত্বের গান আছে।
বিপ্লব সাহা ক্ষান্ত দিলেন।
-কার কার গান গেয়েছেন।
-কতোজনের। সব কি মনে আছে!
-কয়েকটা।
-কতোরকম গান...রাধারমণ, দুর্বিণশাহ, হাসন রাজা...
-আবদুল করিমের
-হ্যাঁ, উনি একজন ক্ষণজন্মা মানুষ ছিলেন।
-দিলওয়ারের?
-হ্যাঁ, ঐ যে একটা গান...তিনি আমাকে মা বলে ডাকেন। তার জন্মদিনে তার বাড়িতে গিয়েছিলাম শুভেচ্ছা জানাতে।

বললাম, ছবি দেন। নিয়ে এলেন ছবি। সব বুড়ো বয়সের। পুরোনো কিছু নেই? আপনি তো অনেক সুন্দরী ছিলেন।
- নয়ন জুড়াবে তেমন কিছু নাই ভাই, যুদ্ধে সব নিয়ে গেছে।
দেবাশীষ দেবু মাত্রা ছাড়িয়ে যায়।
প্রেম করেছেন দিদি?
করবো কখন, তেরোতে তো বিয়েই হয়ে গেল।
-মন্দ কী! তেরো হলেও তো বিয়ে। আগেভাগে শ্বশুরবাড়ি। কী মনে হয় দিদি এখন সময়টা ভাল, নাকি আগে?
-এখনই ভাল। বিয়ের সময় তো কিছু বুঝতে পারা যায় না। শ্বশুরবাড়িতে প্রথম রাত, যখন আর পরিচিত কাউকে দেখতে পাওয়া যায়না...তখন কেমন লাগে...একটা তেরো বছরের মেয়ের কাছে...আহারে...নিজেকে যে সামলাতে পারেনা, সংসার সামলামে কিভাবে?
-আপনি তো পেরেছেন।
-কষ্ট কি হয়নি! এখন ভাল, অন্তত একটু বুঝেশুনে যেতে পারছে শ্বশুরবাড়ি।
-এখনকার গান শুনেন দিদি?
-শুনি।
-কেমন লাগে?
-ভালই তো।
-মমতাজের গান শুনেন।
-হ্যাঁ হ্যাঁ, ভাল গায়।
-ফাইট্টা যায়?

হাসলেন চন্দ্রাবতী। বললেন, খুব খারাপ লাগে। একদিন হাঁটতে গেছি, একলোক চিৎকার করে গাইছে, মনে হচ্ছে ইয়ার্কি করছে। গান কি ইয়ার্কির জিনিস।
-একটু আগে তো বললেন ভাল গায়!
-এসব গান গাওয়ায় মানুষ। শিল্পী কী করবে!

এমন সহজ যুক্তির পেছনে কিছু দাঁড় করানো যায় না বলেই মনে হল। ‘আপনার গানের অনুষ্ঠান করব’ বলে প্রস্তাব দেয়া হলে যে চন্দ্রাবতী ভাবিত হয়ে পড়েন গানের আসরের বাদকদের আমরা কোথা থেকে টাকা দেব, বলেন, বাদক লাগবে না, তোমরা টাকা পাবে কোথায়, আমি খালি গলায় গাইব, হবে তো! এই যুক্তিহীন চন্দ্রালোকের কাছে অনেক অভিযোগই খেলো।
-ব্যাণ্ডের গান শুনেন।
-শুনি তো।
-কেমন?
-ভালই তো।
-কেমন ভালো?
-খালি চিৎকার। কী বলে যেন, মিউজিক।
-আর কথা?
-উঁহু! কথা তো শোনাই যায় না। এই গানের একটুকরো, ঐ গানের এক টুকরো দিয়ে গান বানানো হয়।
-মনে হয় না, লোকগানটা হারিয়ে যাচ্ছে?
- না না, হারাবে কেন!
-এই যে ব্যান্ডের প্রভাব।
-সবকিছুরই একটা ভালমন্দ আছে। এইটাও খারাপ না। বড়লোকের ছেলেরা যারা এসবের মধ্যে থাকছে, কিছুদিন অন্তত ভাল থাকছে। সমাজটা তো তা-না হলে নষ্ট হয়ে যাবে। কতোরকমের কুকাজ ছড়াবে। পত্রিকায় আসে না মেয়েদের সমস্যা করে। এসব বাড়বে।
-কিন্তু যেটা চর্চা হচ্ছে সেটা কি ঠিক?
-ঠিক হয়ে যাবে।
-কিভাবে?
-গাইতে গাইতে একসময় প্ররিশ্রান্ত হয়ে যাবে না! নিজের ভেতর জিজ্ঞাসা আসবে।

জিজ্ঞাসা আসলে লোকগানের কাছে ফিরে আসবে মানুষ। এমনটা উপলব্ধি করেছেন চুরাশিতে পা রাখা চন্দ্রাবতী রায় বর্মণ। কিশোরী বিকেল তার ভরযৌবনের এলোচুল বিছিয়ে দিয়েছে সংসারে। প্রগাঢ় সন্ধ্যা নামছে চরাচরে। আমাদের যেতে হবে কর্মক্ষেত্রে। বাইরে হালকা মেঘের গরজানি। ঝড় হবে রাতে।
-আপনার একটা প্রিয় গান শোনান।
-অনেক প্রিয় গান। কোনটা বলব?
-যেকোনো একটা, খুব প্রিয়
দুর্বিণ শাহের দু’কলি গাইলেন চন্দ্রাবতী:
‘জন্মে জন্মে অপরাধি তোমারই চরণে
আমারেনি আছে তোমার মনে...।’


নোট: লোকগানের শিল্পী চন্দ্রাবর্তী রায় বর্মনের প্রথম মৃত্যুবির্ষিকী আজ। ধামাইল গানের 'মাসিমা' খ্যাত এই কিংবদন্তী শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সজল ছত্রীর লেখাটি পুনপ্রকাশ করা হলো। লেখাটি ২০১১ সালে শাহ আলম গ্যালারি ও প্রান্তিক পর্ষদ প্রকাশিত 'চন্দ্রাবতী' নামক সংকলন থেকে সংগৃহিত।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত