দোদুল খান

৩১ জুলাই, ২০১৬ ২৩:৫৫

এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে অগ্নিসংযোগ মামলা চার বছরেও গতি পায়নি

ঐতিহ্যের মুরারি চাঁদ কলেজ-২

২০১২ সালের ৮ জুলাই রাতে ছাত্রলীগ ও ছাত্রশিবির মধ্যকার সংঘর্ষের সময় আগুনে পুড়েছিলো মুরারি চাঁদ কলেজের ছাত্রাবাসের ৩টি ব্লকের ৪২টি কক্ষ। পরদিনই দায়ের করা হয় মামলা, তারপর ৪ বছর কেটে গেলেও এখন পর্যন্ত এ মামলায় আটক করা হয়নি কাউকেই। মামলার পরিণতি কী হবে, তাও জানে না কোন কর্তৃপক্ষ।

কলেজের সুপ্রাচীন ছাত্রাবাসটি ছাত্রশিবিরের দখল থেকে সরাতে সে রাতে ছাত্রাবাস প্রাঙ্গণে সমাবেশের ডাক দেয় ছাত্রলীগ। তারপরই সংঘর্ষে জড়িয়ে পরে ছাত্রলীগ ও ছাত্রশিবির। আততায়ীদের দেয়া আগুনে ভস্মীভূত হয় ছাত্রাবাসের তিনটি ব্লক। অভিযোগ ওঠে, ছাত্রশিবির কর্মীদের তাড়াতে অগ্নিসংযোগ করে ছাত্রলীগের কর্মীরা।

আরও পড়ুন- এমসি কলেজ : আলোর মুখ দেখছে পুনর্নির্মিত ছাত্রাবাস
এ ঘটনায় শাহপরান থানায় একটি মামলা দায়ের করেন কলেজ ছাত্রাবাসের তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক বশির আহমদ। এ ঘটনার পর জেলা প্রশাসন, কলেজ কর্তৃপক্ষ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পৃথক তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন। তাছাড়া পরবর্তীতে মামলার তদন্তের দায়িত্বে দেয়া হয় ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট-সিআইডিকে।

সবকটি তদন্ত কমিটিই তাদের তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে দীর্ঘদিন আগেই, আর তদন্ত কমিটি সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, সবকটি তদন্ত প্রতিবেদনেই এটা প্রমাণিত হয়েছে যে ছাত্রলীগের কর্মীরাই শিবির তাড়াতে ছাত্রাবাসে অগ্নিসংযোগ করেছিলো। তবে সিআইডির দেয়া চার্জশিটে ছাত্রলীগের সম্পৃক্ততার কোন বক্তব্য নেই।

শাহপরান থানার সহকারি পুলিশ কমিশনার একেএম সাজ্জাদ সিলেটটুডে টুয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, ২০১৩ সালের ৩১ অক্টোবর সিআইডি শাহপরান থানায় চার্জশিট জমা দিয়েছে। এ চার্জশিটে এমসি কলেজের ছাত্রাবাস পোড়ানোর জন্য ৩ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।

অভিযুক্তরা হচ্ছেন এমসি কলেজের তৎকালীন শিক্ষার্থী মনোয়ার হোসেন, মঞ্জুর আলম ও ইয়াসিন খান। তবে চার্জশিট দাখিলের পর প্রায় তিন বছর কেটে গেলেও এখন পর্যন্ত অভিযুক্ত কাউকে আটক করা হয়নি। এছাড়াও মামলায় কোন রাজনৈতিক সংগঠনের নাম উল্লেখ করা হয়নি বলেও জানিয়েছেন সহকারি কমিশনার সাজ্জাদ। তবে মামলার অগ্রগতির ব্যাপারে কোন মন্তব্য করেননি তিনি।

এদিকে কলেজের বেশ কিছু শিক্ষার্থীর সাথে কথা বলে জানা যায় মনোয়ার হোসেন, মঞ্জুর আলম ও ইয়াসিন খান বিভিন্ন মেয়াদে মুরারি চাঁদ কলেজের ছাত্র শিবিরের সভাপতি ও অন্যান্য পদে দায়িত্ব পালন করেন।

এদিকে ছাত্রাবাস আগুনে পোড়ার চারদিন পর পরিদর্শনে আসেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। এ সময় তাঁর সাথে ছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তারা দুজনেই এ কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী এবং শিক্ষামন্ত্রী এ ছাত্রাবাসেরই ১ নং ব্লকের ১০৩ নং কক্ষের আবাসিক ছাত্র ছিলেন। নিজের প্রাক্তন আবাসিক কক্ষের পুড়ে যাওয়া রূপ দেখে তিনি জনসমক্ষেই কান্না করেন এবং দ্রুততম সময়ে ছাত্রাবাস পোড়ানের সাথে জড়িতদের খুঁজে বের করে বিচার করার জন্য নির্দেশনা প্রদান করেন।

এ সময় শিক্ষামন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীকে মহানগর ছাত্রলীগের এক নেতা ছাত্রাবাস পোড়ানোর ঘটনা সম্পর্কে বলেন, “মহানগর আওয়ামী লীগের নেতা অ্যাডভোকেট রণজিৎ গ্রুপের ক্যাডার ছাত্রলীগের সিলেট জেলা সভাপতি পঙ্কজ পুরকায়স্থ, সাবেক সরকারি কলেজ সভাপতি দেবাংশু দাস মিঠু, ছাত্রলীগ নেতা এস আর রুমেলসহ শতাধিক বখাটে ছাত্রলীগ নামধারী এ ছাত্রাবাস পুড়িয়ে দিয়েছে।”

এ সময় অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, “এ ঘটনা যারা ঘটিয়েছে তারা যে দলেরই হোক, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তাদের রক্ষা নেই।”

তবে এ ঘটনার পর চার পর পেরিয়েছে গত ৮ জুলাই। কিন্তু এ মামলার দৃশ্যত কোন অগ্রগতি পাওয়া যায়নি। শিক্ষামন্ত্রীর উদ্যোগে দুই বছরের মধ্যে কলেজের ছাত্রাবাসের পুনর্নির্মাণ কাজও শেষ হয় ২০১৪ সালের অক্টোবরে। সে মাসের ১৪ তারিখ ছাত্রাবাসের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন শিক্ষামন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী।

তারপরও গ্যাস সংযোগের বকেয়া বিল সংক্রান্ত জটিলতা কাটিয়ে উঠতে না পাড়ায় ২বছর বন্ধ থাকার পর মাসে গ্যাস বিল পরিশোধ করে ছাত্রাবাসের ৬টি ব্লকের ২৪৪ আসনে ছাত্র ভর্তির উদ্যোগ গ্রহণ করে, ইতোমধ্যে সাড়ে ৪শ’ আবেদন জমা করেছে, এখন যাচাই বাছাই চলছে বলে জানিয়েছে কলেজ কর্তৃপক্ষ।

এদিকে এখন পর্যন্ত এ ঘটনার বিচার না হওয়ায় উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে কলেজের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে স্নাতকোত্তর বিভাগের শিক্ষার্থী ও সংস্কৃতিকর্মী ইয়াকুব আলী বলেন, “ছাত্রলীগ ও ছাত্রশিবিরের সংঘর্ষের সময় আগুনে পুড়েছিলো ছাত্রাবাস। সে সময় পুড়ে যাওয়া ছাত্রাবাস দেখে কান্নাও করেছিলেন সাবেক শিক্ষার্থী ও শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। দ্রুত বিচারের আশ্বাসও দেন তিনি। কিন্তু এ ঘটনার পর চার বছর চলে গেছে, এখন পর্যন্ত মামলার দৃশ্যত কোন অগ্রগতিও দেখা যায়নি”।

তিনি বলেন, “মন্ত্রী, প্রশাসন ও কলেজ কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা থাকলে এতদিনে এ ঘটনার সাথে যে দলের মানুষই জড়িত থাকুক না কেনো, তাকে বিচারের আওতায় নিয়ে আসা হতো”।

মামলার অগ্রগতির ব্যাপারে কলেজের অধ্যক্ষ নিতাই চন্দ্র চন্দ বলেন, “এ ঘটনার দীর্ঘদিন পরে আমি কলেজ অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করি। তাছাড়া আইন তার নিজস্ব গতিতে চলে, মামলার অগ্রগতিও আইনের বিষয়। তবে আমরা আশাবাদী যে এ ঘটনার সাথে জড়িত যেই হোক, তাদের শাস্তি নিশ্চিত হবে”।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত