মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান

২৫ মার্চ, ২০২৩ ০৩:০২

খেলাফতের যুগে বায়তুল মাল

ওমর (রা.) এর সময় রাজধানীর বায়তুল মাল থেকে শুধু রাজধানীর বাসিন্দাদের বেতনভাতা বাবদ যে অর্থ ব্যয় করা হতো, তার সর্বমোট পরিমাণ ছিল বছরে তিন কোটি দিরহাম। খোলাফায়ে রাশেদিন বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আদায়কৃত কর এবং গনিমত (যুদ্ধলব্ধ সম্পদ) জমা করে রাখার পক্ষপাতি ছিলেন না। যে পরিমাণ সম্পদ বায়তুল মালে আসত, তারা তা মুসলিমদের মাঝে বণ্টন করে দিতেন অথবা জনসাধারণের কল্যাণে বিভিন্ন কাজে খরচ করে ফেলতেন।

বায়তুল মাল ইসলামি আদর্শে পরিচালিত রাষ্ট্রের মূল আর্থিক প্রতিষ্ঠান। ইসলামের অর্থনৈতিক সৌন্দর্য ও রাষ্ট্রের কল্যাণ বিকাশে এ প্রতিষ্ঠান অনবদ্য ভূমিকা পালন করে। বায়তুল মাল অধুনা রাষ্ট্রীয় কোষাগার বা স্টেট ব্যাংকের সম্পূরক একটি শব্দ। এতে গচ্ছিত সম্পত্তিতে রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের কর্মকর্তা-কর্মচারী, এমনকি সাধারণ জনগণ সবার অধিকার সমানভাবে স্বীকৃত। রাষ্ট্রের সীমার মধ্যে কোনো একজন নাগরিকও যাতে তার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয়, তার নিশ্চয়তা প্রদান করাই এ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রথম এবং প্রধান দায়িত্ব। রাসুলুল্লাহ (সা.) এর আমল থেকে সর্বশেষ খেলাফতের পতন পর্যন্ত ইসলামি শাসনব্যবস্থার প্রতিটি পর্যায়ে যেসব জনকল্যাণমূলক খাতে বায়তুল মালের অর্থ ব্যবহার করা হতো, দারিদ্র্য বিমোচন তার অন্যতম।

বায়তুল মালের অর্থ ধনাগার, কোষাগার। পরিভাষায় ইসলামি রাষ্ট্রের কোষাগারকে বায়তুল মাল বলা হয়। কিন্তু এর দ্বারা শুধু সে ইমরাতকেই বোঝায় না, যেখানে সরকারি ধনসম্পত্তির কাজকারবার পরিচালনা করা হয়; বরং ইসলামি রাষ্ট্রের যে বিভাগটি রাষ্ট্রের আয়-ব্যয়ের খাতগুলোর নির্বাহ ও পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে, ব্যাপক অর্থে তাকে ‘বায়তুল মাল’ বলা হয়।

‘বায়তুল মাল’ রাষ্ট্রের সব মুসলিমের সাধারণ সম্পত্তি। ‘আল হাদিয়া’ নামের ফিকহ গ্রন্থে বলা হয়েছে, বায়তুল মালের সম্পত্তি মুসলিম জনসাধারণেরই সম্পত্তি। বায়তুল মালে সঞ্চিত রাষ্ট্রীয় অর্থসম্পদে সব নাগরিকের সমান অধিকার স্বীকৃত। রাষ্ট্রপ্রধান, রাষ্ট্রের কর্মকর্তা-কর্মচারী বা সাধারণ মানুষ কেউই একচেটিয়া এর মালিক হতে পারে না। রাসুলুল্লাহ (সা.) এর বাণীতে সে কথাই ঘোষিত হয়েছে। তিনি বলেছেন, আমি তোমাদের দানও করি না, বারণও করি না, আমি তো বণ্টনকারীমাত্র। আমাকে যেরূপ আদেশ করা হয়েছে, আমি জাতীয় সম্পদ সেভাবেই দিয়ে থাকি।

মদিনা নগরীতে মহানবী (সা.) এর পবিত্র হাতে প্রথম যেদিন ইসলামি রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপিত হয়, মূলত সেদিন থেকেই বায়তুল মালের সূচনা হয়। এর মূল নাম ছিল ‘বাইতু মালিল মুসলিমিন’ বা ‘বাইতু মালিল্লাহ’। পরবর্তীতে মুসলিমিন শব্দটি বাদ দিয়ে এটিকে কেবল ‘বায়তুল মাল’ নাম রাখা হয়। তখন এই কোষাগারে কোনোরূপ ধনসম্পদ সঞ্চয় করে রাখা হতো না। তার সুযোগও তখন ছিল না। কারণ তখন সাধারণ নাগরিক ও রাষ্ট্রের প্রয়োজনের তুলনায় আয় ছিল অতি সামান্য। ফলে রাসুলুল্লাহ (সা.) এর হাতে কোনো সম্পদ আসার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি তা অভাবীদের মাঝে বণ্টন করে দিতেন।

সর্বপ্রথম আবু বকর (রা.) এর আমলে ‘বায়তুল মাল’ বাস্তব রূপ লাভ করে এবং আবু উবায়দাকে (রা.) এর পরিচালক বা ব্যবস্থাপক নিযুক্ত করা হয়। কিন্তু তখনও জাতীয় প্রয়োজনের তীব্রতা হেতু যে মালসম্পদই তার কাছে আসত, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তিনি তা মুসলিমদের মঙ্গলার্থে ব্যয় করে ফেলতেন। আবু বকর (রা.) এর ওফাতের পর ওমর (রা.) এর খেলাফতকালে যখন মিশর এবং ইরাক থেকে খারাজ (ভূমিকর) ও জিজিয়া প্রভৃতি আসতে শুরু করে, তখন তিনি কেন্দ্রে এবং প্রদেশগুলোয় বায়তুল মালের শাখা প্রতিষ্ঠা করেন। আবদুল্লাহ ইবনে ইকরামাহকে (রা.) ‘আমিরু খাজানা’ (গভর্নর অব দ্য স্টেট ব্যাংক) নিযুক্ত করে তার অধীনে কয়েকজন সাহাবিকে কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ করেন। বায়তুল মালের জন্য ‘রেজিস্ট্রার’ এবং ‘দিওয়ান’ প্রণয়ন করা হয়।

উমাইয়াদের সময় বায়তুল মালের নাম পরিবর্তিত হয়ে ‘দিওয়ানুল খারাজ’ বা রাজস্ব বিভাগ রূপে আত্মপ্রকাশ করে। খোলাফায়ে রাশেদিনের সময় বায়তুল মাল বা সরকারি মালখানা জনগণের সম্পত্তি ছিল এবং এতে রাষ্ট্রের প্রত্যেকের অধিকার ছিল। কিন্তু উমাইয়া খলিফাদের সময় দু-একজন ব্যতিক্রম ছাড়া তা খলিফাদের নিজস্ব সম্পত্তিতে পরিণত হয়। উমাইয়া যুগে যেসব উৎস থেকে রাজস্ব গৃহীত হতো, তা হলো খারাজ, জিজিয়া, জাকাত, উশর, বাণিজ্য শুল্ক, কদর রাজ্য থেকে প্রাপ্ত কর, যুদ্ধলব্ধ সম্পত্তির এক-পঞ্চমাংশ, ফাই, বিশেষ কর প্রভৃতি। এ সময় প্রদেশের আয় থেকে প্রদেশের প্রশাসনিক ও উন্নয়নমূলক কাজে খরচ করার পর উদ্বৃত্ত অর্থ দামেস্কে কেন্দ্রীয় সরকারি তহবিলে পাঠিয়ে দেওয়া হতো। খলিফারা তাদের ইচ্ছেমতো তা থেকে খরচ করতেন।

আব্বাসীয়দের সময়ও বায়তুল মালের নাম ছিল ‘দিওয়ানুল খারাজ’। এ আমলে রাজস্বের প্রধান উৎস ছিল খারাজ, জিজিয়া, জাকাত, উশর, বাণিজ্য শুল্ক, আমদানি কর, লবণ কর, মৎস্য কর ইত্যাদি। কৃষকের উৎপাদিত কৃষিপণ্যের দুই-পঞ্চমাংশ রাষ্ট্রের রাজস্ব খাতে জমা হতো এবং তিন-পঞ্চমাংশ কৃষক পেত। তবে কৃষক নিজ ব্যবস্থাপনায় সেচকাজ করলে তাকে তিন-চতুর্থাংশ ছেড়ে দেওয়া হতো। আঙুর ও খেজুর বাগানগুলোর ক্ষেত্রে কেবল এক-পঞ্চমাংশ রাজস্বরূপে নিয়ে চার-পঞ্চমাংশই কৃষককে দেওয়া হতো। রাজ্যের বিশাল এলাকার ভূমি রাজস্ব ছিল কেবল এক-দশমাংশ। সবল-সক্ষম জিম্মিদের কাছ থেকে (যারা সামরিক বাহিনীতে দায়িত্ব পালন করত না) জিজিয়া কর নেওয়া হতো।

মুসলিমদের কাছ থেকে ‘সাদাকাত’ খাতে ট্যাক্স নেওয়া হতো। বিত্তবান মুসলিমদের কাছ থেকে জাকাত আদায় করা হতো। রাজস্বের একটি বিরাট অংশ সামরিক বাহিনীর জন্য ব্যয় করা হতো, যারা রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, সীমান্তরক্ষার কাজে নিয়োজিত থাকত। জনকল্যাণে শহর, নগর, দুর্গ, মসজিদ, মাদ্রাসা, সরাইখানা, পুল-খাল প্রভৃতি নির্মাণ করা হতো। শিল্পী, আবিষ্কারক ও কারিগর, হাকিম, চিকিৎসক, কবি-সাহিত্যিক ও শাস্ত্রবিদদের বড় অঙ্কের প্রণোদনামূলক বৃত্তি (ইনাম) ও বেতনভাতা দেওয়া হতো। সাম্রাজ্যের সব শিক্ষাব্যয় রাজস্ব থেকে নির্বাহ করা হতো।

আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় বায়তুল মালের অনুরূপ প্রতিষ্ঠান হলো ‘পাবলিক ট্রেজারি’ বা কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বর্তমানে এর আয় ও ব্যয়ের উৎস ভিন্ন ভিন্ন। সরকারের রাজস্ব বিভাগ, বৈদেশিক দান-অনুদান, বৈদেশিক ঋণ, ভ্যাট, আমদানি-রপ্তানি শুল্ক, প্রাকৃতিক সম্পদ প্রভৃতি বহু খাত থেকে আধুনিক রাষ্ট্র আয় করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় তা ব্যয় করে। মহাহিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার অধীনে সরকারি একটি বিভাগ এগুলোর হিসাব সংরক্ষণ করে। অন্যদিকে খোলাফায়ে রাশেদার সময় সব আয় বায়তুল মালে জমা হতো এবং সেখান থেকে সব ব্যয় নির্বাহ করা হতো। খেলাফাতের প্রয়োজনীয় ব্যয় মেটানোর পর অতিরিক্ত অর্থ সাধারণের মাঝে বণ্টন করে দেওয়া হতো। যদিও বায়তুল মাল খলিফা এবং তার প্রতিনিধিদের হেফাজতে থাকত; কিন্তু বায়তুল মালের অর্থের ওপর ব্যক্তিগতভাবে খলিফার অধিকার ছিল অত্যন্ত সীমিত। প্রকৃতপক্ষে তিনি বায়তুল মালের আমিন (রক্ষণাবেক্ষণকারী) ছাড়া কিছুই ছিলেন না। তার হাতে মুসলিম জনসাধারণের সম্পত্তি আমানত হিসেবেই থাকত।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত