মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান

১২ মার্চ, ২০২৪ ০৩:৩১

আহলান-সাহলান হে মাহে রমজান

“মানব জীবনে মানুষ আল্লাহ তায়ালার আনুগত্য ও দাসত্ব প্রকাশের যত পন্থা বা আনুষ্ঠানিক পদ্ধতি রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে রমজান একটি অন্যতম পন্থা। দিগন্তের মাগরিব প্রান্তে জেগেছে এক ফালি কুমড়োর মত রমজানের শুভ্র সমুজ্জ্বল নয়া চাঁদ আল হেলাল। “আর বয়ে নিয়ে এসেছে বিশ্ব মুসলিমের দ্বারে আমাদের জাতীয় জীবনে এক বেহেস্তি সওগাত ও মহান আল্লাহতালার অফুরন্ত রহমতের ডালি। তার সাথে সাথে জেগেছে দিকে দিকে অপূর্ব প্রাণ চাঞ্চল্য এবাদত বন্দেগীর সাড়া।

মাহে রমজান আমাদের জীবন এ অপরিসীম গুরুত্ব ও গভীর তাৎপর্যবহ। আভিধানিক অর্থে রমজান (রমাদান) শব্দটি হতে উৎকলিত। এর অর্থ হচ্ছে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়া। রমজান এর সিয়াম সাধনা যেহেতু বান্দার কৃত সকল গুনাহ জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয় এজন্য এ মাসের নাম রাখা হয়েছে রমজান। আর ব্যবহারিক অর্থে রমজান এর রোজা বলা হয় সুবহে সাদিক হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সকল প্রকার পানাহার ও যৌনতৃপ্তি থেকে বিরত থাকাকে। মানুষ সংযম সাধনার মাধ্যমে নিজেকে পাক ও পরহেজগার করে গড়ে তুলবে এ উদ্দেশ্যই আল্লাহ তায়ালা রমজান মাসে রোজাকে বান্দাদের জন্য ফরজ করে দিয়েছেন। তাই আল্লাহপাক পবিত্র কোরানে পাকে এরশাদ করেছেন: হে ঈমানদারগণ তোমাদের প্রতি রোজা ফরজ করা হয়েছে যেমন করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। যেন তোমরা মুত্তাকী হতে পার। এ আয়াতে “লাআল্লাকুম তাত্বাকুন” বাক্যে আল্লাহপাক রমজান এর মূল উদ্দেশ্য, গুরুত্ব ও তাৎপর্যকে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করে দিয়েছেন যে, তাকওয়া পরহেজগারি তথা গোনাহ থেকে বেচে থাকার ট্রেনিং এর উদ্দেশ্যই রমজান মাস এর শুভাগমন। আর তাকওয়া এমন একটি বস্তু যা মানব সমাজকে সকল অবস্থায় গুনাহ থেকে বিরত রাখে। আর তাই আমরা দেখতে পাই, হাতে কাছেই রকমারি সুস্বাদু খাদ্যের প্রাচুর্য, হাত বাড়ালেই সুপের পানি পাওয়া যায়, ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলে লোক লজ্জারও ভয় নেবই, তবু ও মর্দে মুমিন রমজান এর দিনে তা কেন, কার ভয়ে স্পর্শ করে না?

নির্জন সুন্দরী ষোড়শী তরুণীর ডাকে ও কেন সাড়া দেয় না? কে তাকে এ দুর্বল মুহূর্ত গুলোতে পাহারা দেয়? কে তার রক্ষা কবচ? তা হচ্ছে একমাত্র মহান আল্লাহর ভয়ে “তাকওয়া”। আর সেই তাকওয়ার ছবকই হাতে কলমে শিক্ষা দেয় মাহে রমজান। এদিক থেকে রমজান সত্যিই নিগুঢ় তাৎপর্যমণ্ডিত। “এ জন্মেই প্রত্যেক এবাদত আল্লাহর জন্য হওয়া সত্ত্বেও একমাত্র রোজা সম্পর্কেই আল্লাহপাক বলছেন- রোজা একান্তই আমার জন্ম এবং আমি নিজেই এর পুরস্কার হবো” (ছোবাহানাল্লাহ) এক্ষেত্রে আমাদের প্রিয় নবী রাসুলে পাক (দ.) এরশাদ করেছেন “রোজাদার মানুষের মুখের গন্ধ আল্লাহ পাক এর নিকট মিশকের সুগন্ধি অপেক্ষা অধিকতর প্রিয়”। মাহে রমজান হলো নৈতিক উৎকর্ষের একটি সার্থক সাধনার নাম। আল্লাহপাক মানুষের মধ্যে দুটি পরস্পর বিরোধী চাহিদা রেখে দিয়েছেন। একটি হলো জৈবিক চাহিদা, আরেকটি হলো নৈতিক, খানাপিনা, যৌনকামনা ইত্যাদি জৈবিক চাহিদা মানুষকে নৈতিক অধঃপতন ও অবক্ষয়ের পথে টেনে নিতে থাকে। এ জন্যই আল্লাহ পাক দীর্ঘ এগার মাস পর পর একটি মাস নির্দিষ্ট সময়ে খানাপিনা থেকে নিজেকে বিরত রেখে আত্মসংযম তথা নৈতিক উৎকর্ষ সাধনের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এ জন্য অন্য এক হাদিসে রাসুলে পাক (দ.) এরশাদ করেছেন ‘রোজা মুমিনের জন্য ঢাল স্বরূপ”।

এছাড়াও দেহের পরিপাকতন্ত্র যখন ১১টি মাস ধরে ক্রমাগত কাজ করতে করতে আড়ষ্ট ও শ্রান্ত হয়ে আসে তখন রোজার সময়ে বিশ্রাম নিয়ে তা আবার সতেজ ও সক্রিয় হয়ে উঠে। রমজানের সিয়াম সাধনার মধ্যে আল্লাহ পাক মানবতা মমত্ববোধ ও সহমর্মিতা জাগ্রত করার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। আমাদের সমাজে এমন লোকের অভাব নেই যে দুগ্ধ ফেননিভ বিছানায় আরামে আয়েশে অট্টালিকায় কাটায়, কিন্তু গাছতলায় শায়িত ক্ষুৎপিপাসায় কাতর জীর্ণ দেহ চক্ষু কোটারাগত প-ুর চেহারা, বীভৎস কঙ্কালসার আদম সন্তানদের প্রতি ফিরে তাকায় না, বুঝে না জটর জ্বালার তীব্র দহন। তাদের কে আল্লাহ তায়ালা রোজার মাধ্যমে বাস্তবে সেই অনুভূতিকে অনুভব করার শিক্ষা দেন। যাতে করে ধনী ব্যক্তির মধ্যে তার আরেক গরীব ভাইয়ের প্রতি সমবেদনা ও সহানুভূতি জেগে উঠে। এ জন্যই প্রিয় নবী রাসুলে পাক (সা.) এরশাদ করেছেন “সে ব্যক্তি আমার উম্মত নয় যে নিজের তৃপ্তি সহকারে পানাহার করে আর তার প্রতিবেশী অনাহার থাকে’ হুজুরে পাক (দ.) বলেছেন এ মাস টাকা পয়সা তারা গরীবকে সাহায্য করার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাষ।

“মানব সমাজকে আল্লাহপাক রূহানিয়ত ও নফছানিয়ত অন্য কথায় ফেরেশতা খাসলত ও শয়তানী খাসলত এ দুটি পরস্পর বিরোধী গুন দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। যখন কোন বান্দা নফছে আম্মারার মত খারাপ কাজ করার অত্যন্ত কুপরামর্শদাতার বিরোধিতা করে তাকে নিজের গোলাম বানিয়ে নিতে পারে তখনই সূচিত হয় রূহানিয়তের গৌরবোজ্জ্বল বিজয়। এজন্যই নফছের বিরোধিতা করে সকল প্রকার খারাপ তথা অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকা তথা আত্ম সংযমের প্রশিক্ষণ রয়েছে সিয়াম সাধনায়। তাই প্রিয় নবী রাসুলে পাক (দ.) এরশাদ করেছেন “রোজাদার ব্যক্তির মিথ্যা বলা উচিত নয়” রোজাদার ব্যক্তি কাউকে গালি দেবে না ও কোন খারাফ কাজে জড়িত থাকবে না। যদি কেউ তার সাথে ঝগড়া করতে চায় অথবা কোন খারাফ কথা বলে তখন সে শুধু এই বলে উত্তর দেবে যে “আমি রোজাদার”। বাস্তবিক পক্ষে আত্মসংযম ইমানদারের জন্য খুবই প্রয়োজনীয়। এটা মানুষের আত্মাকে বলিয়ান করে।

একটি দেশ চালাতে যেমন বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত পুলিশ ও মিলিটারির প্রয়োজন হয় তেমনি মহান আল্লাহপাক তাঁর দুনিয়াতে দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আমাদের কে খলিফা বানিয়ে পাঠিয়েছেন। তাই একমাস ধরে দিনে রোজা রাখতে হয় আবার রাত্রে তারাবীর নামাজ পড়তে হয়। নামাজে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনতে হয় মহান আল্লাহ তায়ালার দেয়া বিধান গ্রন্থ আল কোরআন যাতে করে আমাদের মনে আল্লাহ তায়ালার অনুশাসন সম্বন্ধে নতুন চেতনা জাগে। আবার রাতের শেষ ভাগে সেহরি খাওয়ার জন্য উঠতে হয়। যেন যুদ্ধ ক্ষেত্রের অতন্দ্র প্রহরী মুজাহিদ। কুফরির বিরুদ্ধে তার এ জেহাদ। এ জেহাদ মহান রাব্বুল আলামিন ও তাঁর প্রিয় হাবিব (দ.) এর সন্তুষ্টি অর্জনের জেহাদ। এজন্যই এটা পরীক্ষিত সত্য যে যদি নিবেদিত প্রাণ নিয়ে সম্পূর্ণ রমজান মাস “সিয়াম সাধনা” করা হয় তাহলে বাকী এগার মাস-এর প্রভাব থাকে। অন্য দৃষ্টিতে আমরা দেখতে পাই রমজান আমাদের কে ভ্রাতৃত্ব ও একতা শিক্ষা দেয়, এক সাথে সেহরি খাওয়া, একই সাথে রোজা রাখা একই সময়ে একই সাথে ইফতার করা আবার সকলে একই সাথে তারাবীর নামাজ পড়া এ সবই একতার ছবক। এ মাসের গুরুত্বকে বর্ণনা করতে গিয়ে মহান রাব্বুল আলামিন বলেন এ সেই রমজান মাস যাতে বিশ্ব মুসলমানদের সংবিধান কোরানে পাক নাযিল করা হয়েছে। আর কোরানে পাক ও রমজানের মৌল লক্ষ্যে আমরা দেখতে পাই উভয়টা একই উদ্দেশ্যে আগত মানব সমাজ কে হেদায়েত ও পরিশুদ্ধ করা। রমজান কোরআনের অনুশাসন পালনে বান্দাকে উপযোগী করে তোলে।

আর এ মাসেই মহান রাব্বুল আলামিন দান করেছেন অসংখ্য অসীম নেয়ামত পরম মুবারক রাত্রি “লাইলাতুল কদর”। হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম যে রাত্রি। একমাত্র উম্মতে মোহাম্মদীর জন্যই আল্লাহপাকের বিশেষ অনুগ্রহ। পাপী তাপী বান্দাদেরকে নাজাত দেয়ার এক বিরাট উছিলা। আল্লাহ পাক রেখে দিয়েছেন তাই এ রাত্রের জন্যও রমজান বিশেষ গুরুত্বের দাবীদার। সুতরাং সম্পূর্ণ রমজান মাসটাই যেন আল্লাহপাকের রহমত এক অসীম সাগর। এ রহমতের মাসকে মানুষ মেনে চলে গুনাহগার বান্দাহ সহজেই নবজাত শিশুর মত নিষ্পাপ হয়ে যেতে পারে। তাই রমজান মাসকে সম্বোধন করে প্রিয় নবী রাসুলে পাক (দ.) এরশাদ করেছেন যখন রমজান মাস আরম্ভ হয় তখন আসমানের দরজা সমূহ খুলে দেয়া হয়, জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেয়া হয় এবং শয়তানের পায়ে বেড়ী লাগানো হয়।

অন্যত্র প্রিয় নবী এরশাদ করেছেন রমজানের প্রথম দশদিন রহমতের, দ্বিতীয় দশদিন মাগফেরাতের এবং শেষ দশদিন জাহান্নাম থেকে নাজাতের জন্য বিভক্ত। বাস্তবিক পক্ষে রমজান ছওয়াব অর্জন তথা আল্লাহর নৈকট্য লাভের এক শ্রেষ্ঠ মাধ্যম এতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। তাই প্রিয় নবী রাসুলে পাক (দ.) এরশাদ করেছেন জান্নাতে রাইয়ান নামক একটি দরজা আছে, তা কিয়ামতের দিন রোজাদারের জন্য খুলে দেয়া হবে এবং ঢাক শুনা যাবে কোথায় রোজাদার ব্যক্তিরা। যখন রোজাদারদের প্রবেশ করা শেষ হবে তখন সে দরজা বন্ধ করে দেয়া হবে। আরও সুখের বিষয় রোজাদারের জন্য রয়েছে নিশ্চয়ই সুসংবাদ। আরও একটি সুসংবাদ আল্লাহর রাসুল (দ.) এভাবে দিয়েছেন রোজাদারদের জন্য রয়েছে দুটি শুভ মুহূর্ত মাগরিবের সময় যখন সে ইফতারের মাধ্যমে প্রশান্তি লাভ করে এবং যখন আখেরাতে সে “আল্লাহ তায়ালার (সাক্ষাত) দিদার লাভ করবে” (আলহামদুলিল্লাহ) এছাড়া ইফতারের সময় দোয়া কবুল করা হয়। আর একটি সুসংবাদ হুজুর পাক (দ.) এভাবে দেন “যে ব্যক্তি রোজা রাখবে এবং কালামে পাক তেলাওয়াত করবে তার জন্য কোরআন ও রোজা কেয়ামতের দিন সুপারিশ করবে। রোজা তার পক্ষ হয়ে বলবে “হে আল্লাহ আমি তাকে সর্ব প্রকার খারাপ কাজ ও সারাদিন পানাহার থেকে বিরত রেখেছি” সুতরাং তার জন্য আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন”। এবং কোরআনে পাক তার পক্ষ হয়ে বলবে “আমি তাকে ঘুম থেকে বিরত রেখেছি”। এ ছাড়া আর ও সুসংবাদ রয়েছে রমজান মাসে যে কোন ভাল কাজ করলে অন্য মাসের সত্তরটির ছওয়াব পাওয়া যায়।

“এ মাসের নফল কাজগুলির ছওয়াব অন্য মাসের ফরজ কাজের সমান ছওয়াব পাওয়া যায়। এদিক থেকে চিন্তা করলে বুঝা যায় রমজান আমাকের জীবনে অসীম গুরুত্ববহ ও অফুরন্ত তাৎপর্যমণ্ডিত। সুতরাং আমাদেরকে এ মাসের সম্মান রক্ষা করা অতি প্রয়োজন তাই হালাল উপার্জন তথা যাবতীয় অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। এবং দিনের বেলায় সকল হোটেল রেস্তোরা বন্ধ রাখতে হবে। কিন্তু এসব ফজিলত ও ছাওয়াব আমরা তখনই লাভ করবো যখন আমাদের রোজা হবে সকল প্রকার গুনাহ থেকে বিরত ও সংযত। কাজেই যে সুমহান লক্ষ্যে যখন রাব্বুল আলামিন আমাদের এ মুবারক মাহে রমজান দান করেছেন, এর শোকরিয়া যেন আমরা আজীবন করতে পারি আল্লাহ আমাদেরকে সে তৌফিক দিন।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত