মুক্তাদীর আহমদ মুক্তা

১৪ এপ্রিল, ২০২০ ১৭:৫৬

বৈশাখ নিয়ে আসুক মুক্তির বারতা

স্বাগত ১৪২৭ বঙ্গাব্দ। বৈশাখ শুধু মাস বা ঋতু পরিবর্তনের ধারাবাহিকতা নয়, বৈশাখ আমাদের বাঙালি সংস্কৃতি আর সম্মিলক চেতনার বলিষ্ঠ প্রকাশ। বাংলা সন, চালু করেছিলেন মোগল সম্রাট আকবর ফসলি সন হিসেবে, যা কালের পরিক্রমায় বাঙালির সর্বজনীন উৎসবে রূপান্তরিত। এর সঙ্গে যেমন নতুনের আবাহন ও শেকড়ের ভাবনা জড়িত, তেমনি বাংলা নববর্ষ উৎসবও মূলত মৃত্তিকাশ্রয়ী অসাম্প্রদায়িক উৎসবের প্রতীক।

বৈশাখ আসে উত্তাপ নিয়ে সৃষ্টি সুখের উল্লাসে। বছরের প্রথম সূর্য উদিত হয় সম্ভাবনার গীতবিতান নিয়ে।কিন্তু এবারের পরিবেশ ভিন্ন। প্রাণঘাতী কভিড -১৯ (নভেল করোনাভাইরাস) গোটা মানবজাতিকে যখন করেছে ঘরবন্দি। গভীর অমানিশায় যখন মানব জীবন মহামারির সঙ্গে যুদ্ধ করছে। প্রাণ সংহারী ক্ষুদ্রতম ভাইরাসের কাছে যখন প্রবল প্রতাপশালী রাষ্ট্রগুলো বিপর্যস্ত। বাংলাদেশ যখন বৈশ্বিক এই দুর্যোগে ক্রান্তিকাল অতিক্রম করেছে। উৎসব আর সঙ্গ প্রিয় বাঙালি যখন সঙ্গনিরোধ নামক নতুন সংস্কৃতিতে জীবনের প্রয়োজনে অভ্যস্ত হচ্ছে। ঠিক সেই সময় বাঁধ ভাঙ্গা উচ্ছ্বাসের প্রাণের বৈশাখ গভীর বেদনা নিয়েই এসেছে। চিরাচরিত বৈশাখী মেলা, আড্ডা, পান্তাভাত আর সরষে ইলিশের স্বাদ বঞ্চিত বাঙালির বৈশাখী আয়োজন নিঃসন্দেহে পূর্ণতা পাবে না। বিচ্ছিন্নতা আর মনখারাপের গল্প হয়েই করোনাকালের বৈশাখ নিয়ে আসুক ঝড় পরবর্তী নির্মল স্নিগ্ধতা। অন্ধকার ভেদ করে বৈশাখ নিয়ে আসুক মঙ্গলালোকে নতুন বারতা। এসো হে বৈশাখ এসো, গ্লানি মুছে, জরা ঘুচে, প্রকৃতির রৌদ্রস্নাত এ ধরা শুচি হোক তোমার বদৌলতে।

নতুন বছরের প্রথম সূর্য তোমায় অভিবাদন। এই ঘোর অন্ধকারে তুমি হয়ে ওঠো আলোকবর্তিকা। মানব হিতৈষী নতুন আলোয় কেটে যাক দুর্বিপাক। প্রত্যাশা শুধু থেমে যাক মৃত্যুর মিছিল। জেগে উঠুক প্রাণের কোলাহল। করোনাবধের মঙ্গলবারতাই হোক বৈশাখের বীরত্বগাথা।

আবিষ্কার হোক করোনাবধের ভ্যাকসিন। আবির্ভাব হোক মানবিকতার উজ্জ্বল দিন।আতঙ্ক-অনিশ্চয়তা অশুভ-সাম্প্রদায়িকতা-কূপমণ্ডূকতা-হানাহানি ভুলে নতুন করে শুরু হোক জীবনের গান। মানুষ ধ্বংস হতে পারে কিন্তু পরাজিত হতে পারে না। বৈশাখের মাহাত্ম্যই জয়ী হওয়া। উৎসব, উল্লাসে উজ্জীবিত হওয়া।বৈশাখের উজ্জিবক হালখাতায় দেনাপাওনার সমীকরণ শোধ করে প্রকৃতির নিষ্ঠুরতা থেমে যাক। নির্মল হোক পথচলা আর সুফলা হোক মানবজমিন।

মিথ্যে পরিসংখ্যানের তথ্য দিয়ে প্রচারসর্বস্ব ফালতু বয়ান নয়,চাই টেকসই মানবিক উদ্যোগ।প্রয়োজন আত্মপ্রত্যয়ী বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা। যেখানে থাকবে অন্ন,বস্ত্র,বাসস্থানের ব্যবস্থাসহ জীবনের দীর্ঘমেয়াদী নিরাপত্তা, উপযুক্ত চিকিৎসার নিশ্চয়তাসহ যথাযথ বিনোদনের মাধ্যমে শুদ্ধাচার চর্চা।

নববর্ষে শান্তিনিকেতনে দেওয়া ভাষণে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘নূতনত্বের মধ্যে চিরপুরাতনকে অনুভব করিলে তবেই অমেয় যৌবনসমুদ্রে আমাদের জীর্ণ জীবন স্নান করিতে পায়। আজিকার এই নববর্ষের মধ্যে ভারতের বহুসহস্র পুরাতন বর্ষকে উপলব্ধি করিতে পারিলে তবেই আমাদের দুর্বলতা, আমাদের লজ্জা, আমাদের লাঞ্ছনা, আমাদের দ্বিধা দূর হইয়া যাইবে।’

নতুন বছরে আমাদের বুলিসর্বস্ব অর্জন আর ঝুঁলিসর্বস্ব আহরণের উন্মাদনা থেকে প্রকৃত বাঙালি মমত্ববোধ আর পরার্থপরতার সংস্কৃতি আয়ত্ত করতে হবে।ভয়ের সংস্কৃতি আর লোকরঞ্জনবাদী আপতকালীন চিন্তা বাদ দিয়ে দূরদর্শী, কল্যাণকামী সমন্বিত প্রচেষ্টাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। আদর্শহীন ধূর্ত, ভণ্ড, প্রতারক, তেলবাজ, চাটুকার, মতলববাজ, সুযোগসন্ধানীদের চিহ্নিত করতে হবে। দুর্নীতিগ্রস্ত দিশাহীন কর্মী সম্পদ নয়, বোঝা এটি সর্বত্র প্রতিফলিত হতে হবে। প্রগতির অন্তরায় সুবিধাবাদী ধর্মান্ধ মৌলবাদকে কঠোর হস্তে দমন করে দক্ষতা ও যোগ্যতাকে সকল ক্ষেত্রে মূল্যায়ন করতে হবে। সংস্কৃতি চর্চার নামে সুবিধাবাদকে পৃষ্ঠপোষকতা না করে বাঙালিয়ানার অপবাদ ঘুচাতে হবে।বাঙালি না সেজে বাঙালিত্ব ধারণ করতে হবে। একদিন বাঙালি ছিলামরে এমন মধ্যবিত্ত ভাবনা থেকে বের হয়ে আমরা করবো জয় এমন উদ্দীপ্ত ভাবনাকেই পাকাপোক্ত করতে হবে।

এই নির্দয় করোনাকালে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ যেভাবে মানবিক সাহায্য নিয়ে অসহায়দের পাশে দাঁড়িয়েছেন এটাই বাঙালির চিরন্তন সংস্কৃতি। আর্তমানবতার সেবা বাঙালির মমত্ববোধের পরম্পরা। কিন্তু এই দুর্যোগকালীন সময়েও মানবতার ক্রন্দন থেমে থাকেনি। সংকটময় মুহূর্তকে পূঁজি করে হীন উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে বাঙালিত্বকে অপমান করা হয়েছে। মানবতাকে কলঙ্কিত করা হয়েছে। বাংলাদেশের মহৎ অর্জনগুলোকে বিতর্কিত করে একটি অসহনশীল ও বিকারগ্রস্ত সমাজব্যবস্থার ছক তৈরি করা হচ্ছে। নতুন বছরে প্রয়োজন স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে উদার গণতান্ত্রিক চেতনায় নব উদ্যমে জেগে ওঠা।

গভীর অনিশ্চয়তা আর বৈশ্বিক মহামারির আগ্রাসী মহামন্দা অতিক্রম করে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাওয়া নতুন বছরের বড় চ্যালেঞ্জ।দেশের অর্থনীতির গতি নির্ধারক খাতগুলো গভীর সংকটাপন্ন।অর্জিত জিডিপি বাধাগ্রস্ত হবে চলমান সংকট মোকাবিলায়।

দেশের আর্থিক ব্যবস্থাপনাকে সংহত করে মানুষের আত্মবিশ্বাসে অটুট রাখতে না পারলে কালবৈশাখীর তাণ্ডবের মত লণ্ডভণ্ড হয়ে যাবে দেশের অর্থনীতি। রাজনীতিতে মানবিকতার যে সুবাতাস বইছে এটাকে দৃঢ় ও আস্থাশীল করে সকল অশুভ শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। দেশের বৃহত্তম স্বার্থে ক্ষুদ্রতা পরিহার করে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ধারাকে বেগবান রাখা এখন সকল দেশপ্রেমিক নাগরিকের কর্তব্য।মানুষের আস্থার সংকট দূর করতে হবে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাকে সমন্বিতভাবে সফল করে সামাজিক সুরক্ষাকে কার্যকর করতে হবে। সরকারের ঘোষিত দুর্যোগ প্রশমনের প্রণোদনার সঠিক বাস্তবায়নই নতুন চ্যালেঞ্জ। বিপর্যস্ত আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় প্রবাসীদের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে হবে। কৃষি ও গার্মেন্টস শিল্পের সংকট উত্তরণে বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা গ্রহণ অত্যাবশ্যক। বাংলাদেশের মানুষের উৎসব আয়োজন ফিরিয়ে আনতে হলে সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। সহমর্মিতা আর সহৃদয়তা বিনিয়োগ করেই কেবল এই সংকট উত্তরণ সম্ভব। বাঙালি মনে ফিরে আসুক উৎসব আবহ। দূর হোক করোনার নির্মমতা, এটাই বছর শুরুর প্রার্থনা।

আসুন কবির ভাষায় সমস্বরে উচ্চারণ করি-
‘নিশি অবসানপ্রায়, ওই পুরাতন/ বর্ষ হয় গত/ আমি আজি ধূলিতলে এ জীর্ণ জীবন/ করিলাম নত/ বন্ধু হও, শত্রু হও, যেখানে যে কেহ রও/ ক্ষমা করো আজিকার মতো/ পুরাতন বরষের সাথে/ পুরাতন অপরাধ যত।

মুক্তাদীর আহমদ মুক্তা: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ও রাজনৈতিক কর্মী।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত