রিপন দে

০৮ নভেম্বর, ২০১৯ ০১:২৩

স্যানেটারি প্যাড সহজলভ্য করতে এক নারীর লড়াই

মেয়েদের ঋতুস্রাব নিয়ে সমাজে রয়েছে একধরণের শুচিবায়ুগ্রস্ততা। এ নিয়ে প্রকাশ্য কথা বলায় অভ্যস্ত নয় কেউ। রয়েছে নারীর জীবনপ্রক্রিয়ার এই আবশ্যিক বিষয়কে আড়াল করে রাখার প্রবণতা। এমন গোপনীয়তার সুযোগে তৈরি হচ্ছে নানা অপব্যাখ্যা-অপপ্রচার। এছাড়া ঋতুস্রাবের সময় স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটারি প্যাড ব্যবহারেও রয়েছে বাধা। ফলে দেখা দিচ্ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি।

সকল বাধা কাটিয়ে নারীদের জন্য একটি স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ তৈরিতে কাজ করে যাচ্ছেন এক নারী। তার নাম মারজিয়া প্রভা। ঋতুস্রাব নিয়ে সামাজিক ট্যাবু ভেঙে স্বাস্থ্যসম্মত স্যানেটারি ন্যাপকিন সকলের জন্য সুলভ করে তুলতে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি।

জানা যায়, বাংলাদেশে স্যানিটারি প্যাডের প্রতি প্যাকেটের দাম গড়ে ১০০ থেকে ১৬০ টাকা। এতো দামে প্যাড কেনা নিম্ন আয়ের মানুষদের কাছে প্রায় অসম্ভব। তাই তারা পুরোনো কাপড়, অস্বাস্থ্যকর তুলা দিয়েই কাজ চালাতে হয় তাদের। কাপড় ব্যবহারের সঠিক ব্যবস্থাপনা না মানায় অনেকক্ষেত্রে তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি দেখা দেয়।

ঋতুস্রাব চলাকালে অব্যবস্থাপনার জন্য প্রায় ৭৩ শতাংশ নারী জরায়ু, জরায়ুমুখ ও মূত্রনালির সংক্রমণের শিকার হন, যা পরে ক্যানসারেও রূপ নেয়। শহরাঞ্চলে প্যাডের ব্যবহার ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ হলেও সারা দেশে সেই হার মাত্র ১২ থেকে ১৫ শতাংশ।

বাংলাদেশ ন্যাশনাল হাইজিন বেসলাইন সার্ভের তথ্য বলছে, ৪১ শতাংশ নারী ঋতুস্রাবের সময় স্কুল-কলেজে অনুপস্থিত থাকেন। তবে বর্তমানে পরিস্থিতি কিছুটা পাল্টাচ্ছে। এই পাল্টানোর নেপথ্যে যারা কাজ করছেন তাদের একজন মারজিয়া প্রভা। ২০১৫ সাল থেকেই দেশের নানা প্রান্তে ছুটে চলেছেন তিনি। স্কুলে স্কুলে স্থাপন করেছেন প্যাড কর্নার। সেই সাথে ঋতুস্রাব নিয়ে সচেতনতা, স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার, স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে কাপড় ব্যবহারসহ সার্বিক স্বাস্থ্য সচেতনতার বিষয়টি নিয়ে কাজ করছেন তিনি।

মারজিয়া জানান, স্কুলে যাওয়ার পর যদি হঠাৎ ঋতুস্রাব শুরু হয়- শিক্ষার্থীদের মনে এই ভয় সবচেয়ে বেশি কাজ করে। স্কুলে পিরিয়ড বা ঋতুস্রাব শুরু হলেও শিক্ষার্থীদের ভয় দূর করার জন্য দেশের ১৬ টি জেলার ১৬টি উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে জরুরি প্যাড কর্নার চালু করেছেন তিনি। এমন বিষয় নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তিনি ও তাঁর দলের সদস্যদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক থেকে শুরু করে বিভিন্ন জায়গায় বাজে মন্তব্য শুনতে হয়।

প্রশাসনের পক্ষ থেকে যথাযথ অনুমতি নিয়ে কোনো স্কুলে কর্মশালা বা অন্য কোনো কার্যক্রম চালানোর সময় এলাকার লোকজনের বাধার সম্মুখীন হতে হয়। এসব কারণে ২০১৭ সালে কার্যক্রম অনেকটাই মুখ থুবড়ে পড়ে। তবে দমে যাননি মারজিয়া ও তাঁর দলের সদস্যরা। সারা দেশে এখন পর্যন্ত ৮০ জন স্বেচ্ছাসেবক এ কার্যক্রমে যুক্ত হয়েছেন। মারজিয়া বাংলাদেশে ঋতুস্রাব নিয়ে সচেতনতামূলক নানা কর্মসূচিতে কাজ করে যাচ্ছেন দিনের পর দিন।

নিজের এই উদ্যোগ নিয়ে কথা বলেছেন মারজিয়া প্রভা। তিনি জানান, শুরুতে তার উদ্যোগের নাম ছিল ‘ডোনেট
আ প্যাড ফর হাইজিন বাংলাদেশ’ (স্বাস্থ্যসম্মত বাংলাদেশের জন্য একটি প্যাড দান করুন)। বাংলাদেশে ঋতুস্রাব বা এ সময় স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার নিয়ে যে ‘ট্যাবু’ বা গোপনীয়তা আছে, তা ভাঙতে কাজ করছেন তিনি ও তাঁর দলের সদস্যরা।

মারজিয়া জানান, প্রথমে নিজেদের বেতনের টাকা, পরিবারের সদস্য, বন্ধুদের সহায়তায় কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছিল। বর্তমানে কিছু সংগঠন এবং ব্যক্তি এ কার্যক্রমে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। তবে টাকার জন্য এই কার্যক্রম আটকে থাকবে না জানিয়ে তিনি বলেন, সর্বশেষ যত দিন নিজের আয় থাকবে এই কার্যক্রম বন্ধ হবে না।

দেশের বিভিন্ন জেলার স্কুলগুলিতে জরুরী প্যাড কর্নারের চালুর বিষয়ে তিনি বলেন, প্রথমে একটি বিদ্যালয়ে প্যাড কর্নারের জন্য ২০০ স্যানিটারি প্যাড পৌঁছে দেওয়া হয়। শিক্ষার্থীদের জরুরি ভিত্তিতে প্যাড প্রয়োজন হলে পাঁচ টাকা বা যার সামর্থ্য আছে সে বেশি টাকা দিয়ে একটি প্যাড কিনে ব্যবহার করবে। সমবায় পদ্ধতিতে প্যাড বিক্রির টাকা জমা হবে। আর পুরো কার্যক্রম তদারকির জন্য একজন নারী শিক্ষককে দায়িত্ব দেয় স্কুল কর্তৃপক্ষ। জমানো টাকা থেকে আবার প্যাড কিনে রাখা হয়। ব্যবহারের পর প্যাড নির্দিষ্ট স্থানে ফেলার জন্যও ব্যবস্থা করে দেয় মারজিয়ার দলের সদস্যরা। কর্নার চালু হয়ে গেলে পরে স্কুলের তত্ত্বাবধানে কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এ উদ্যোগ দেখে অন্যরাও উৎসাহিত হচ্ছে। তিনি চান প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে একটি করে প্যাড কর্নার গড়ে তুলবেন।

মারজিয়া জানালেন, শুধু প্যাড কর্নার চালু নয়, বিদ্যালয়ে বিভিন্ন কর্মশালার আয়োজন করেন তাঁরা। এতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা উপস্থিত থাকেন। শিক্ষার্থীরা ঋতুস্রাব নিয়ে বিভিন্ন অভিজ্ঞতার কথা বলে, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা পরামর্শ দেন। মারজিয়া বললেন, ‘কার্যক্রম শুরুর দিকে বিভিন্ন স্কুলে গিয়ে দেখতাম, মেয়েরা লজ্জায় কথা বলত না, আর এখন মেয়েরা মাইক্রোফোনেও কথা বলে।’

এবার অন্যরকম এক আন্দোলন শুরু করেছেন মারজিয়া প্রভা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং কমিউনিটি ক্লিনিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে বিনামূল্যে স্যানেটারি প্যাড প্রদানের দাবিতে দেশব্যাপী গণস্বাক্ষর কর্মসূচি হাতে নিয়েছেন । ৬ নভেম্বর দুপুরে নারীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা ফোরাম (নাসাসু) এর উদ্যোগে মৌলভীবাজার সরকারী মহিলা কলেজে মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত ওয়ার্কশপের মধ্য দিয়ে গণস্বাক্ষর কর্মসূচীর উদ্বোধন করেছেন।

এই কর্মসূচি নিয়ে তিনি জানান, মূলত মোট সাতটি দাবিতে দেশব্যাপী তারা এই গণস্বাক্ষর কর্মসূচী চালাবেন। তাদের দাবিগুলো হচ্ছে- ১. প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ও কমিউনিটি ক্লিনিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে বিনামূল্যে স্যানেটারি প্যাড প্রদান।

২. আগামী ২০২০-২১ বাজেটে স্বাস্থ্য খাত, সামাজিক সুরক্ষা খাত এবং কল্যাণমূলক খাত থেকে বিনামূল্যে প্যাড প্রদানের জন্য বরাদ্দের ব্যবস্থা করা।

৩. অতিসত্বর ঋতুস্রাব ব্যবস্থাপনা নীতিমালা তৈরি করা।

৪. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে নারীদের জন্য আলাদা ওয়াশরুম এবং ডাস্টবিনের ব্যবস্থা করা।

৫. শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন কিশোরী ক্লাবে শিক্ষার্থীদের ঋতুস্রাব স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান।

৬. নারীদের মধ্যে ঋতুস্রাব সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং কমিউনিটি ক্লিনিকে দক্ষ স্বাস্থ্য কর্মী নিয়োগ।

৭. বাজারে উৎপাদিত জেল প্যাডকে সম্পূর্ণ না করে, পরিবেশবান্ধব এবং স্বাস্থ্যসম্মত অর্গানিক কটন স্যানেটারি প্যাড তৈরির জন্য সরকারের আইন প্রণয়ন।

দেশের সচেতন মানুষকে এই আন্দোলনে সাথে পেতে এবং সরকারকে এই দাবি মেনে নিয়ে নারীদের স্বাস্থ্যের প্রতি গুরুত্ব দিতে আহ্বান জানান মারজিয়া প্রভা।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত