সিলেটটুডে ইন্টারন্যাশনাল ডেস্ক

১৮ জুন, ২০১৬ ১০:৩৮

‘ফুর্তি’ ও ‘যুদ্ধে’ শিশুদের ব্যবহার করছে তালেবানরা

আফগানিস্তানে সন্ত্রাসী হামলায় শিশু 'যৌনদাস'দের ব্যবহার করছে তালেবানরা। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে সামরিক ক্ষমতার লড়াইয়ে পুলিশের বিরুদ্ধে এই ছোট ছোট বালককে তারা ব্যবহার করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ওই এলাকায় পুরুষতান্ত্রিক সমাজে ‘বাচা বাজি’ নামের একধরনের সংস্কৃতির চর্চা রয়েছে। যুগের পর যুগ ধরে শিকড় গেড়ে আছে তা। সেখানে ছোট ছোট বালককে মেয়ের সাজে সাজিয়ে নাচগান করিয়ে মজা লোটে পুরুষেরা। তাদের সঙ্গে যৌনাচারও করে থাকে তারা।

আফগান মুলুকে একটি প্রবাদ আছে—‘শিশু পালনে নারী, ফুর্তির জন্য বালক’। ‘বাচা বাজি’ নামে যৌনদাসত্বের এই প্রথার মাধ্যমে শিশুদের ওপর চলছে ভয়াবহ যৌন নিপীড়ন। বাচা বাজির চর্চা চলে ভয়াবহভাবে। বাচা বাজির শিশুদের বলা হয় ‘বাচা’। আফগানিস্তান স্বাধীন মানবাধিকার কমিশনের (এআইএইচআরসি) প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাচারা সাধারণত ১০ থেকে ১৮ বছর বয়সী ছেলে হয়। কখনো তারা অপহরণের শিকার হয়ে এ কাজে ব্যবহৃত হয়। আবার কখনো দারিদ্র্যের কারণে পরিবার তাদের বাচা হিসেবে বিক্রি করে দেয়। এই বাচাদের সুবিধামতো ব্যবহার করছে বিভিন্ন পক্ষ।

আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর কিছু সদস্যের বাচা বাজির আসক্তি রয়েছে। এই সুযোগটাকে কাজে লাগাচ্ছে তালেবান। জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত চার মাসে এসব শিশুকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করে তালেবান পুলিশের ওপর কমপক্ষে ছয়টি হামলা চালিয়েছে। প্রাণ হারিয়েছে শতাধিক পুলিশ। সম্প্রতি অরল্যান্ডোতে সমকামীদের নাইট ক্লাবে বন্দুক হামলায় ৪৯ জনকে হত্যার ঘটনাকে সমর্থন করে আইএস বলেছিল, সমকামিতা ইসলামে নিষিদ্ধ। অথচ সেই সমকামিতার চর্চাই ব্যাপকভাবে চলে আসছে মুসলিম রাষ্ট্র আফগানিস্তানে।

বলা হয়ে থাকে, আফগানিস্তানে শতবর্ষ ধরে ছেলেশিশুদের ব্যক্তিগত আনন্দের জন্য যৌন ক্রীতদাস হিসেবে রাখার চর্চা চলে আসছে। এটাকে দেশটির মানবাধিকার লঙ্ঘনের সবচেয়ে খারাপ উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরা হয়।

১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তালেবান শাসনামলে বাচা বাজি নামের এই প্রাচীন প্রথা নিষিদ্ধ করা হয়। সম্প্রতি সেই কুৎসিত চর্চাই ফিরে এসেছে। বলা হয়ে থাকে, আফগানিস্তানের দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চলের গ্রাম এলাকা পশতুন এবং উত্তরাঞ্চলে তাজিক নামের একটি সম্প্রদায়ের মধ্যে বাচা বাজির চর্চা বেশি ছিল। প্রভাবশালী যোদ্ধা, যুদ্ধবাজ নেতা, রাজনীতিবিদ ও সমাজের বিত্তশালীদের মধ্যে বাচা রাখার বিষয়টি ছিল বিত্তবৈভবের প্রতীক। মেয়েদের পোশাক পরিয়ে সাজিয়ে-গুজিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বাচাদের দিয়ে নাচগান করানো হতো। এর মধ্যে যৌনতা তো আছেই।

এআইএইচআরসির ২০১৪ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আফগান সমাজে নারী-পুরুষের মধ্যে ব্যাপক বৈষম্য ও নারীর সঙ্গে পুরুষের মেলামেশার সুযোগ কম থাকার কারণে বাচা বাজি এত ছড়িয়েছে। আইনের শাসন না থাকা, দুর্নীতি, বিচার পাওয়ার সুযোগ কম থাকা, অজ্ঞতা, দারিদ্র্য, নিরাপত্তাহীনতা, সশস্ত্র জঙ্গিগোষ্ঠীর তৎপরতা ইত্যাদি কারণও এই পীড়নকর সংস্কৃতির বিস্তার ঘটিয়েছে।

এআইএইচআরসি বলেছে, আফগান আইনে ধর্ষণ এবং বিয়ের আগে ছেলেমেয়েদের প্রণয় ও যৌন সম্পর্ক স্থাপন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে বাচা বাজির ক্ষেত্রে আইনে সুস্পষ্ট কোনো ধারা উল্লেখ করা নেই। এ ধরনের ব্যক্তিদের সঙ্গে আইনের লোকদেরও সুসম্পর্ক থাকে। প্রভাব খাটিয়ে, ঘুষ দিয়ে তারা শাস্তি থেকে রেহাই পায়।

এ ধরনের শিশুরা বিষণ্নতার শিকার হয় বলে মন্তব্য করেছেন লন্ডনভিত্তিক দাতা সংস্থা চাইল্ড সোলজার্স ইন্টারন্যাশনালের পরিচালক চারুলতা হগ। তিনি বলেছেন, ওই শিশুরা কাউকে বিশ্বাস করতে পারে না, কোনো কিছুতে ভরসা পায় না। তারা একধরনের আতঙ্কের মধ্যে থাকে। তাদের মধ্যে বৈরী মনোভাব ও প্রতিশোধস্পৃহা থাকে। তারাও একসময় বাচা রাখা শুরু করে।

আফগান কর্তৃপক্ষের মতে, উরুজগান প্রদেশের মতো কয়েকটি এলাকায় তালেবান জঙ্গিরা আফগান বাহিনীর বাচা বাজির সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে। প্রতিরক্ষাব্যূহ অতিক্রম করছে। উরুজগানের সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা ঘুলাম সাখি রোঘ লিওয়ানি বলেন, তালেবান আফগান পুলিশের সবচেয়ে দুর্বল জায়গাটি খুঁজে বের পেয়েছে। আর তা হচ্ছে বাচা বাজি আসক্তি। সুন্দর ছেলেদের বিভিন্ন তল্লাশি চৌকিতে পুলিশের কাছে বিনোদনের জন্য পাঠাচ্ছে টোপ হিসেবে। ওই শিশুরাই পুলিশ সদস্যদের হত্যা করছে।

গত বছর এই ধরনের হামলা থেকে রক্ষা পাওয়া ২১ বছর বয়সী পুলিশ মতিউল্লাহ বলেছেন, তালেবান পুলিশের বিরুদ্ধে বাচাদের ‘মধুফাঁদ’ হিসেবে ব্যবহার করছে। তাঁদের তল্লাশি চৌকির কমান্ডারের বাচা জাবিউল্লাহ মধ্যরাতে ঘুমন্ত কমান্ডারসহ সাতজন পুলিশকে গুলি করে হত্যা করে।ৱ

সূত্র: এএফপি, দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত