সিলেটটুডে ইন্টারন্যাশনাল ডেস্ক

১৭ জুলাই, ২০১৬ ১০:২৩

ফ্রান্সজুড়ে শোকের ছায়া

ফ্রান্সের নিস শহরে বাস্তিল উৎসব চলাকালে ট্রাক হামলায় নিহতদের স্মরণে শনিবার থেকে তিন দিনের জাতীয় শোক পালন শুরু হয়েছে। নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন চলছে। অর্ধনমিত রাখা হয়েছে জাতীয় পতাকা। শোক পালন করছে জার্মানি, ইউক্রেন, সুইজারল্যান্ড ও তিউনিসিয়াসহ কয়েকটি দেশ। মারণাস্ত্র ব্যবহার না করে এ ধরনের হামলায় হতবাক হয়েছে বিশ্ব। ঘটনাকে কেন্দ্র করে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা পরিষদের সঙ্গে সংকট উত্তরণে বৈঠকে বসতে যাচ্ছেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওঁলাদ।

 ট্রাক হামলার ঘটনায় জড়িত সন্দেহে এখন পর্যন্ত পাঁচজনকে আটক করেছে পুলিশ। যার মধ্যে ট্রাকের চালকের সাবেক স্ত্রীও রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, হামলাকারী ট্রাকচালকের সঙ্গে এদের যোগসূত্র ছিল। তাদের নিরাপত্তা হেফাজতে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। ট্রাক হামলা চালানো তিউনিসিয়ান ব্যক্তি একা ছিলেন, নাকি তার সঙ্গে আরও কেউ ছিলেন, তা তদন্ত করছে ফরাসি কর্তৃপক্ষ।

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওঁলাদ দেশটির নিরাপত্তাবিষয়ক শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক ডাকার পর সশস্ত্র বাহিনীগুলোর প্রধান ও মন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এ সময়ই এই গ্রেফতারের খবর আসে।
এদিকে হামলার ঘটনার দায় স্বীকার করেছে (ইসলামিক স্টেট) আইএস। আইএস পরিচালিত আমাক নিউজ এজেন্সির বরাত দিয়ে জঙ্গি সংগঠনগুলো অনলাইন তৎপরতা পর্যবেক্ষণকারী ওয়েবসাইট ‘সাইট ইন্টিলিজেন্স গ্র“প’ এ তথ্য জানায়।

সেখানে জানানো হয় আইএসের এক ‘সেনা’ এ হামলা চালিয়েছে। ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপির বরাত দিয়ে খবরটি নিশ্চিত করেছে ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যম বিবিসি।

বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, শুক্রবার দু’জনকে এবং শনিবার বাকি তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাতে বাস্তিল দিবস উদযাপনের জন্য ফ্রান্সের দক্ষিণাঞ্চলের ভূমধ্যসাগর তীরের নয়নাভিরাম অবকাশ শহর নিসের প্রমোনাদে দেজ অ্যাংলেইসে আতশবাজি প্রদর্শনী দেখতে জড়ো হয়েছিলেন কয়েক হাজার মানুষ। আচমকা একটি ভারি ট্রাক বেপরোয়াভাবে ওই জমায়েতের দিকে ছুটে আসে। আতংকিত লোকজন দিগি¦দিক ছোটাছুটি শুরু করেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, ওই ট্রাকচালক মানুষকে ট্রাকচাপা দিয়ে পিষে ফেলার পাশাপাশি গুলিও চলিয়েছে। একপর্যায়ে পুলিশের গুলিতে নিহত হন তিনি। ট্রাকটিও থেমে যায়।

এ হামলায় শিশু-কিশোরসহ ৮৪ জন নিহত হন, আহত হন ২০২ জন। তার মধ্যে ৫২ জনের অবস্থা আশংকাজনক। বিদেশীদের মধ্যে আছেন জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, সুইজারল্যান্ড, মরক্কো, ইউক্রেন, আর্মেনিয়া ও তিউনিসিয়ার নাগরিক।

বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, নিরাপত্তা প্রদানের সঙ্গে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া ওই বৈঠকে নিসের পরিস্থিতি মোকাবেলায় কী কী ব্যবস্থা নেয়া যায় সে ব্যাপারে পর্যালোচনা করবেন ওঁলাদ। বৃহস্পতিবার রাতে হামলার পর ট্রাকচালককে শনাক্ত করে পুলিশ। তিনি তিউনিসিয়ান বংশোদ্ভূত ফরাসি নাগরিক। তার নাম মোহাম্মদ লাহোয়েজ বুহলেল (৩১)। বৈধভাবেই নিস শহরে বাস করতেন তিনি। হামলায় ব্যবহৃত ট্রাকে মিলেছে তার পরিচয়পত্র। ছোটখাটো অপরাধের ঘটনায় তার জড়িত থাকার অভিযোগ ছিল, তবে জঙ্গি সন্দেহে তার ওপর গোয়েন্দা নজরদারি ছিল না।

পুলিশ সূত্র এবং ফরাসি গণমাধ্যমের বরাত দিয়ে ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যম গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দু’দিন আগে নিস শহরের পার্শ্ববর্তী সেইন্ট-লঁরা-দু-ভার থেকে ট্রাকটি ভাড়া করেন চালক। তিউনিসিয়ার নিরাপত্তা বাহিনীর সূত্র উদ্ধৃত করে বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রায়ই তিনি তিউনিসিয়ায় আসা-যাওয়া করতেন। সর্বশেষ আট মাস আগেও তিনি দেশটিতে গিয়েছিলেন। সাধারণ অপরাধের জন্য পুলিশের কাছে চেনামুখ হলেও তাকে কখনও সন্দেহভাজন জঙ্গিদের তালিকাভুক্ত করা হয়নি। কয়েক মাস আগে ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করা ও অন্য এক চালকের দিকে কাঠের টুকরা নিক্ষেপ করার দায়ে তাকে আদালত থেকে সতর্কতা জানানো হয়। তার ট্রাক থেকে রিভলবার ও কিছু নকল অস্ত্রও উদ্ধার করেছে পুলিশ। আইনজীবী ফ্রাঁসোয়া মলিন্স বলেন, তিনি একা ছিলেন কিনা তা খুঁজে বের করা অত্যন্ত জরুরি।

প্যারিসভিত্তিক তদন্তকারী বাহিনীর সাবেক ম্যাজিস্ট্রেট জ্যা-লুইস ব্র“গারও জানান, ফরাসি ও ইউরোপীয় গোয়েন্দাদের কেউই কোনোভাবেই বুহলেলের জঙ্গি সংগঠনে সংশ্লিষ্টতার কোনো প্রমাণ পাননি। ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী মানুয়েল ভালস শুক্রবার বলেছেন, হামলাকারী ব্যক্তি একজন ‘সন্ত্রাসী’ ছিলেন। ইসলামিক কট্টরপন্থার সঙ্গে সম্ভবত তার কোনো না কোনো যোগসাজশ ছিল। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বার্নার্ড কাজেনিউভি বলেন, এখনই এ বিষয়ে মন্তব্য করার সময় আসেনি।

হামলার এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে শুক্রবারই জরুরি বৈঠকে বসেন ফরাসি প্রধানমন্ত্রী ম্যানুয়েল ভালস। বৈঠকের পর তিনি জানান, ট্রাক হামলার ঘটনায় নিহতদের স্মরণে তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালিত হবে। তিনি বলেন, ‘সন্ত্রাসবাদ এমন একটি হুমকি যার জন্য ফ্রান্সকে ব্যাপক ভুগতে হচ্ছে। সন্ত্রাসীদের উদ্দেশ্য হল ভয় আর আতংক ছড়ানো। কিন্তু ফ্রান্স সুদৃঢ় গণতন্ত্রের দেশ। এটি নিজেকে অস্থিতিশীল হতে দেবে না।’

এর আগে ট্রাক হামলার ঘটনায় নিন্দা ও ক্ষোভ জানিয়ে চলমান রাষ্ট্রীয় জরুরি অবস্থা আরও তিন মাস বাড়ানোর ঘোষণা দেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওঁলাদ। শুক্রবার সকালে টেলিভিশনে দেয়া ভাষণে এ ঘোষণা দেন তিনি। গত বছর নভেম্বরে প্যারিসে সন্ত্রাসী হামলার পর থেকেই ফ্রান্সে জরুরি অবস্থা জারি আছে। সে জরুরি অবস্থা তিন দফা বাড়িয়ে তা ২৬ জুলাই পর্যন্ত করা হয়। কিন্তু সে জরুরি অবস্থার মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই বাস্তিল দিবসে হামলার প্রেক্ষাপটে আবারও তিন মাসের জন্য তা বাড়ানোর ঘোষণা দেয়া হল।

প্যারিসে বন্দুক হামলায় ১৩০ জনের মৃত্যুর আট মাস ব্যবধানে নিসে ৮৪ জনের মৃত্যু ফ্রান্সবাসীকে সন্ত্রস্ত করে তুলেছে। চার মাস আগে ব্রাসেলসেও ঘটে গেছে একটি সন্ত্রাসী হামলা। ওই হামলার ফলে পশ্চিম ইউরোপজুড়ে সৃষ্ট হয়েছে আতংক ও নিরাপত্তহীনতা। সূত্র : বিবিসি, এএফপি ও রয়টার্স

আপনার মন্তব্য

আলোচিত