বিবিসি বাংলা

১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ২২:০১

রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারত কেন চুপ?

রোহিঙ্গা সঙ্কটকে ঘিরে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের উদ্বেগকে ভারত একসাথে কীভাবে মোকাবিলা করবে, তা দিল্লির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে রীতিমতো সমস্যায় ফেলে দিয়েছে।

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, বাংলাদেশ ও মিয়ানমার ও দুটি দেশই ভারতের বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী - কিন্তু সেই দুই সম্পর্কের মধ্যে ভারসাম্য রেখে কীভাবে রোহিঙ্গা সঙ্কটের সমাধান বের করা যায় দিল্লি এখন তারই সন্ধানে ব্যস্ত।

রাখাইন থেকে যেভাবে শরণার্থীদের ঢল নেমেছে, মাত্র দুদিন আগে প্রথম তাতে উদ্বেগ ব্যক্ত করলেও রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন নিয়ে ভারত এখনও একটি শব্দও খরচ করেনি।

রোহিঙ্গা সঙ্কট কীভাবে দক্ষিণ এশিয়াতে ভারতের আঞ্চলিক কূটনীতিকে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ফেলেছে, দিল্লিতে তা নিয়ে বিবিসি কথা বলে একাধিক বিশ্লেষকের সঙ্গে।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাম্প্রতিক মিয়ানমার সফরে তিনি কেন রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন নিয়ে নীরব ছিলেন, তা হতাশ করেছে বাংলাদেশকে - যারা এই সঙ্কটের সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী।

দিল্লিতে নিযুক্ত বাংলাদেশী রাষ্ট্রদূত সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলি এরপরই ভারতের পররাষ্ট্রসচিব এস জয়শঙ্করের সঙ্গে দেখা করে অনুযোগ জানান - বলেন, এত বড় মানবিক বিপর্যয়ে ভারতের চুপ থাকাটা আদৌ শোভা দেয় না।

এদিকে, পর্যবেক্ষকরা কিন্তু পরিষ্কার বলছেন, দিল্লির এই নীতি নতুন কিছু নয় - কারণ রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারত বরাবরই মিয়ানমারকে সমর্থন দিয়ে এসেছে।

'দ্য ওয়ারে'র ডিপ্লোম্যাটিক এডিটর দেবীরূপা মিত্রর কথায়, "এই সমর্থন এতটাই জোরালো যে গত পনেরো বছর ধরে ভারত কখনও সরকারিভাবে রোহিঙ্গা শব্দটা ব্যবহারই করেনি - কারণ মিয়ানমার প্রশাসনের সেটা পছন্দ নয়।"

"আর রাখাইনের অবস্থা বা মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে যখনই মিয়ানমারের বিরুদ্ধে পশ্চিমা দেশগুলো কোনও প্রস্তাব এনেছে, ভারত কিন্তু সব সময় তার বিরোধিতা করেছে।"

তবুও গত শনিবার বাংলাদেশী রাষ্ট্রদূত সাউথ ব্লকে দেখা করে যাওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ভারত রাখাইন স্টেট থেকে আসা শরণার্থীদের স্রোতে উদ্বেগ ব্যক্ত করে নতুন একটি বিবৃতি জারি করে। তবে তাতেও রোহিঙ্গা শব্দটি ব্যবহার করা হয়নি - কোনও উল্লেখ ছিল না তাদের ওপর ঘটে চলা নির্যাতনেরও।

ভারতের নামী স্ট্র্যাটেজিক থিঙ্কট্যাঙ্ক অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সিনিয়র ফেলো জয়িতা ভট্টাচার্যের মতে ভারতের কূটনৈতিক দ্বিধা এখান থেকেই স্পষ্ট।

তিনি বলছেন, "ভারতের অবস্থাটা আসলে খুব জটিল। একদিকে বাংলাদেশ, অন্যদিকে মিয়ানমার - দুজনের সাথেই ভারতের সম্পর্ক খুব ভাল, দুজনকেই ভারতের দরকার। কিন্তু এই রোহিঙ্গা প্রশ্নটা এমন একটা ইস্যু, যাতে এই দুই সম্পর্কের মধ্যে ব্যালান্সিং করাটা ভারতের পক্ষে খুব কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।"

"একদিকে মিয়ানমার কিছুতেই চাইবে না তাদের ওপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হোক, অন্যদিকে বাংলাদেশেরও আবার জেনুইন কনসার্ন আছে, উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো সত্যিকারের কারণ আছে। ফলে ভারতের জন্য এটা এক ধরনের ক্যাচ টোয়েন্টিটু সিচুয়েশন বলতে পারি।"

আর এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মিয়ানমারে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব ঠেকাতে ভারতের মরিয়া চেষ্টাও।

জয়িতা ভট্টাচার্য বলছিলেন, "এই প্রশ্নটির সঙ্গে একটি আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে ভারতের ভূমিকাও জড়িত। ইতিমধ্যেই মিয়ানমারের মধ্যে পূর্বমুখী ঝোঁক দেখা যাচ্ছে, সেখানে চীনের বড় প্রভাবও আছে। তা ছাড়া মিয়ানমার বহুদিন ধরেও একা থাকাও শিখে গেছে। এই পরিস্থিতিতে ভারত কতদূর কী করতে পারে, তাদের কতটা সমর্থন করতে পারে সেটা খুব জটিল একটা বিষয়।"

"আমি শুধু এটুকুই বলব মিয়ানমারে ভারত নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে চাইছে। ফলে মিয়ানমারকে তারা কোনোভাবেই বিরক্ত করতে চাইবে না - কিন্তু আবার বাংলাদেশের স্বার্থও তাদের দেখতে হবে।"

বস্তুত বাংলাদেশের দাবি মেনেই যে রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে ভারত নতুন করে ভাবতে বাধ্য হচ্ছে, তা বলতেও দ্বিধা নেই দেবীরূপা মিত্রর।

তার কথায়, "বাংলাদেশের উদ্বেগকে কিন্তু ভারত আমলে নিয়েছে বলেই তারা নিজেদের অবস্থান কিছুটা পাল্টেছে।"

"গত শনিবারের বিবৃতিটা তার প্রথম পদক্ষেপ - এবং আমি এটাও জানতে পেরেছি চলতি মাসেই যে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশন বসতে যাচ্ছে, সেখানে এই রোহিঙ্গা প্রশ্নে প্রকাশ্যে ও পর্দার আড়ালে নানা কূটনৈতিক তৎপরতার জন্য ভারত তৈরি হচ্ছে।"

"নিউ ইয়র্কে ভারত এমন একটি সক্রিয় ভূমিকা নিতে চায় যাতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার দুপক্ষকেই তারা সন্তুষ্ট করতে পারে।"

ভারতীয় কূটনীতিকরা বলছেন, রাখাইন স্টেটে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখা তাদের জন্য অত্যন্ত জরুরি - কারণ কালাদান সংযোগ প্রকল্প ও আরও নানা ক্ষেত্রে সেখানে ভারতের কোটি কোটি ডলারের বিনিয়োগ আছে।

উত্তর-পূর্ব ভারতের জঙ্গি গোষ্ঠীদের মোকাবিলাতেও মিয়ানমারের সাহায্য অপরিহার্য - কিন্তু বাংলাদেশকে ক্ষুব্ধ না-করে সেটা কীভাবে বজায় রাখা যায় সেটাই এখন ভারতের বিদেশনীতির সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত