সিলেটটুডে ডেস্ক

০৫ জানুয়ারি, ২০২০ ০১:১৭

মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতার কতটুকু প্রভাব পড়বে বাংলাদেশে?

কাসেম সোলাইমানি হত্যা

শ্রমবাজার, রেমিট্যান্সপ্রবাহ আর জ্বালানি তেলের জন্য মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর ওপর বড় ধরনের নির্ভরশীলতা রয়েছে বাংলাদেশের। পাটসহ আরো বেশ কয়েকটি পণ্যের রফতানি বাজার হিসেবেও বাংলাদেশের জন্য এসব দেশ গুরুত্বপূর্ণ। ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ডের ‘কুদস ফোর্স’প্রধান মেজর জেনারেল কাসেম সোলাইমানির হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি আরো অস্থিতিশীল হয়ে ওঠার যে শঙ্কা দেখা দিয়েছে, তাতে বাংলাদেশের ওপরও তার প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বৈশ্বিক জ্বালানি তেলের বাজারকে বেশ আলোড়িত করে তুলেছে কাসেম সোলাইমানির হত্যাকাণ্ড। অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের আন্তর্জাতিক বাজারে এই সপ্তাহের প্রথম দিনের লেনদেনেই দেখা গেছে পণ্যটি অস্বাভাবিক পরিমাণে কেনাবেচার প্রবণতা। লন্ডন ও নিউইয়র্কের বাজারে এক ধাক্কায় ৪ শতাংশের বেশি বেড়ে পণ্যটির ব্যারেলপ্রতি মূল্য দাঁড়ায় ৭০ ডলারের কাছাকাছি। এর আগে পণ্যটির আন্তর্জাতিক বাজারে সর্বশেষ আলোড়ন তুলেছিল সেপ্টেম্বরে সৌদি আরবের জ্বালানি তেল ফ্যাসিলিটিতে হামলার ঘটনাটি। এবারের ঘটনায় কোনো ফ্যাসিলিটি বা উত্তোলন কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও এ ঘটনার প্রভাব অনেক বেশি সুদূরপ্রসারী।

গত সপ্তাহে ইরান সমর্থিত ইরাকি মিলিশিয়ারা মার্কিন দূতাবাসে হামলা চালায় বলে অভিযোগ ওয়াশিংটনের। এর পর থেকেই দুই দেশের মধ্যকার উত্তেজনার পারদ চড়তে থাকে।

এ হামলার খবর প্রকাশ হওয়ার পর লন্ডনের আইসিই ফিউচার্স এক্সচেঞ্জে (আইসিই) শনিবার দিনের শুরুতেই অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের আন্তর্জাতিক বাজার আদর্শ ব্রেন্টের মূল্য এক ধাক্কায় ৪ দশমিক ৪ শতাংশ বেড়ে যায়। ওই সময় পণ্যটির মূল্য দাঁড়ায় ব্যারেলপ্রতি ৬৯ ডলার ১৬ সেন্টে। প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে পরে দিনের মধ্যভাগে পণ্যটি প্রতি ব্যারেল ৬৮ ডলার ১৯ সেন্টে কেনাবেচা হলেও ঊর্ধ্বমুখিতা বজায় থাকার সর্বলক্ষণ বাজারে বিদ্যমান।

গত কয়েক বছরে পারস্য উপসাগরে সৌদি জ্বালানি তেল ফ্যাসিলিটি ও বেশ কয়েকটি বিদেশী ট্যাংকার নানা সময়ে হামলার শিকার হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে এ ধরনের হামলা-পাল্টা হামলার মাত্রা আরো বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

বর্তমানে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার সংঘাতে লড়াইয়ের ময়দান হয়ে উঠেছে ইরাক। জ্বালানি তেল উত্তোলনের দিক থেকে দেশটির অবস্থান ওপেকভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে দ্বিতীয়। ব্লুমবার্গের তথ্য অনুযায়ী, ইরাক ও ইরান দুই দেশ মিলিয়ে গত মাসে দিনে গড়ে ৬৭ লাখ ব্যারেল করে জ্বালানি তেল উত্তোলন করেছে, যা ওপেকভুক্ত দেশগুলোর মোট উত্তোলনের এক-পঞ্চমাংশ।

দুই দেশই জ্বালানি তেল রফতানির ক্ষেত্রে হরমুজ প্রণালির ওপর নির্ভর করে থাকে। আন্তর্জাতিক জ্বালানি তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস রফতানি বাণিজ্যে অত্যন্ত গুরুত্ববহ সরু এ প্রণালিটি বরাবরই মধ্যপ্রাচ্যের যেকোনো সংকটে মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে। বিশেষ করে যেসব সংকটের সঙ্গে ইরানের নাম জড়িয়ে থাকে, সেগুলোর ক্ষেত্রে এ প্রণালির প্রতি বেড়ে যায় আরো অনেক বেশি। বর্তমান পরিস্থিতিতে এ হরমুজ প্রণালি দিয়ে জ্বালানি পরিবহন ব্যাপক মাত্রায় বাধাগ্রস্ত হবে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের। তবে এ সংঘাত পূর্ণমাত্রায় যুদ্ধে রূপ নেবে না বলেও আশাবাদী অনেকে।

মূল্যের চেয়েও লক্ষণীয় উল্লম্ফন দেখা গেছে পণ্যটি কেনাবেচার পরিমাণে। দিনের লেনদেন শেষ হওয়ার আগেই দুই বাজার মিলিয়ে ব্রেন্ট ও ডব্লিউটিআই কেনাবেচার মোট পরিমাণ দাঁড়িয়েছে গত ৩০ দিনের গড় পরিমাণের প্রায় ১৭ গুণ বেশিতে।

নিউইয়র্কভিত্তিক রাজনৈতিক ঝুঁকি গবেষণা ও উপদেষ্টা প্রতিষ্ঠান ইউরেশিয়া গ্রুপের বিশ্লেষক হেনরি রোমের মতে, ইরান এ হত্যাকাণ্ডের জবাব দেবে ঠিকই, তবে কাসেম সোলাইমানি পরবর্তী ফ্রাঞ্জ ফার্দিনান্দ (অস্ট্রিয়ার যুবরাজ, যার হত্যাকাণ্ডের ফলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছিল) হয়ে উঠবেন না। ধারণা করছি, কমপক্ষে আগামী এক মাস বেশকিছু নিম্নমাত্রার ছোটখাটো সংঘর্ষের ঘটনা ঘটবে এবং এগুলো ইরাকেই সীমাবদ্ধ থাকার সম্ভাবনা বেশি।

এক নোটে হেনরি রোম বলেন, ইরান সমর্থিত মিলিশিয়ারা মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে হামলা চালাতে পারে এবং বেশকিছু মার্কিন সৈন্যের প্রাণহানিও হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রও এর জবাব ইরাকের অভ্যন্তরে হামলা চালানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখবে। তবে দক্ষিণ ইরাকের তেলক্ষেত্রগুলোয় সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়লে অথবা ইরান জ্বালানি তেল পরিবাহী জাহাজগুলোকে হয়রানির মাত্রা বাড়িয়ে দিলে পণ্যটির মূল্য ব্যারেলপ্রতি ৮০ ডলারে পৌঁছে যেতে পারে। শেষ পর্যন্ত এটি পূর্ণমাত্রার যুদ্ধে রূপ নেবে না বলে প্রত্যাশা তার।

দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন, সেচ ও পরিবহনসহ আরো বিভিন্ন প্রয়োজনে ব্যবহার করা জ্বালানি তেলের প্রায় পুরোটাই আমদানি করতে হয়। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবও বহুমাত্রিক। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪ সালের মধ্যভাগ থেকে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম ক্রমাগতভাবে কমতে থাকে। প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম প্রায় দুই বছর ছিল ৩০ থেকে ৫০ ডলারের মধ্যে। কিন্তু দেশে দাম না কমানোয় পরের কয়েক বছরে ধারাবাহিকভাবে মুনাফা করে বিপিসি। মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতায় তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে বাংলাদেশেও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশের লেনদেন ভারসাম্যের ওপর চাপ আরো বাড়তে পারে। এলএনজি আমদানির ওপরও মধ্যপ্রাচ্যের ওপর আমাদের নির্ভরশীলতা রয়েছে। ফলে এ পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হলে গ্যাসের দামও বাড়বে। তবে তেলের দাম আরো বৃদ্ধি পেলে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সেজন্য দুই পক্ষের কেউই যুদ্ধ পরিস্থিতির পক্ষে নয়। বর্তমান অবস্থায় রেমিট্যান্সের ওপর খুব বেশি প্রভাব পড়বে না। কারণ তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে ওই অঞ্চলের অর্থনীতি আরো ভালো অবস্থানে থাকবে।

এদিকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থাকা এক কোটির বেশি প্রবাসী বাংলাদেশীর বড় অংশটির বাস মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয়। প্রবাসী বাংলাদেশীদের পাঠানো রেমিট্যান্স দেশের বৈদেশিক মুদ্রার অন্যতম উৎস। একই সঙ্গে এটি দেশের অর্থনীতিরও অন্যতম প্রভাবক। গত বছর রেমিট্যান্স হিসেবে দেশে আসা ১ হাজার ৮৩৩ কোটি ডলারের উল্লেখযোগ্য অংশ এসেছে মধ্যপ্রাচ্য থেকে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, জেনারেল সোলাইমানির মৃত্যুতে স্বস্তি পাবে ইসরায়েল ও সৌদি আরব। কারণ সোলাইমানিকে প্রতিপক্ষ হিসেবেই বিবেচনা করত তারা। তবে এ হত্যাকাণ্ডের ফলে মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সব দেশই আক্রান্ত হবে। মূলত ইরানের পরবর্তী পদক্ষেপের ওপরই নির্ভর করছে অঞ্চলটির আগামী দিনগুলোর পরিস্থিতি।

মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ, বিশেষ করে ইরানে বাংলাদেশের পাট ও পাটজাত পণ্যের চাহিদা রয়েছে। এমনিতেই অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্কারোপের ফলে ভারতে পাট রফতানি কমে গেছে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় রফতানি কমেছে সুদান ও সিরিয়ায়। এ অবস্থার প্রভাবে গত অর্থবছর পাট ও পাটজাত পণ্যের রফতানি হয়েছে ৮১ কোটি ডলার, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ২০ শতাংশ কম।

সোলাইমানির হত্যাকাণ্ডের পর মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি আরো সংকটপূর্ণ হলে, তা অঞ্চলটিতে বাংলাদেশের পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলবে।

এ হত্যাকাণ্ডে বৈশ্বিক শেয়ারবাজারেও বেশ তোলপাড় তুলেছে। মার্কিন ও এশীয় শেয়ারবাজারে দেখা গেছে মন্দাভাব। অন্যদিকে স্বর্ণ, ইয়েন ও সরকারি সঞ্চয়পত্রের বাজারে দেখা গেছে বড় ধরনের উল্লম্ফন। অনিশ্চিত পরিস্থিতির আশঙ্কায় সেফ হ্যাভেন হিসেবে শেয়ারবাজারের বদলে এগুলোতেই বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। প্রতিবেশী ভারতের শেয়ারবাজারেও দেখা গেছে নিম্নমুখিতা। গতকাল দিনের প্রথমার্ধে সেনসেক্স ও নিফটি সূচকের পতন হয়েছে প্রায় দশমিক ২৫ শতাংশের কাছাকাছি।
সূত্র: বণিক বার্তা

আপনার মন্তব্য

আলোচিত