আজ ৬ ডিসেম্বর; বিজয়ের ঊষালগ্নে ১৯৭১ সালের এই দিনে মৌলভীবাজারের সীমান্তবর্তী কমলগঞ্জ উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়েছিলো। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের এই দিনে মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্র বাহিনীর সাড়াশি অভিযানের মুখে বিপর্যস্ত হয়ে কমলগঞ্জের দখলদারিত্ব ছেড়ে পালিয়ে যায় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী।

এই দিনে কমলগঞ্জের মুক্তিপাগল বাঙালিরা ওড়ায় বিজয়ের পতাকা। এই দিনটি নিয়ে বিতর্ক থাকলেও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা ডেপুটি কমান্ডার জয়নাল আাবেদীন জানান, প্রকৃতপক্ষে ৬ ডিসেম্বরই কমলগঞ্জ হানাদারমুক্ত হয়। পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে কমলগঞ্জ উপজেলায় প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কমলগঞ্জে সর্ব দলীয় সংগ্রাম পরিষদ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর থেকেই এখানে শুরু হয় সশস্ত্র প্রতিরোধের প্রস্তুতি। মুক্তিযুদ্ধের প্রতি অনুগত ৬০ জনের একটি দল তৈরি করে উপজেলার শমশেরনগর বিমান ঘাটিতে ট্রেনিং এর কাজ চলতে থাকে। ১০ মার্চ ক্যাপ্টেন গোলাম রসুলের নেতৃত্বে এক দল পাক সেনা মৌলভীবাজারে অবস্থান নেয়। ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসে তৎকালীন ছাত্রনেতা নারায়ণ পাল ও আব্দুর রহিম পাকিস্তানী পতাকা পুড়ানোর দায়ে গ্রেপ্তার হন।

পরে অবশ্য জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। কমলগঞ্জ উপজেলা ছিল বামপন্থিদের সুদৃঢ় ঘাটি। তারা মওলানা ভাসানী ও হক তোহারা গ্রুপের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা লগ্নে নকশাল পন্থিদের নির্মূল করার অজুহাতে মেজর খালেদ মোশাররফকে কমলগঞ্জে পাঠানো হয়। তিনি ছিলেন বাঙালি সেনা কর্মকর্তা। ২৫ মার্চ গণহত্যা শুরু হলে তিনি পাক বাহিনীর সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে জনতার কাতারে সামিল হন।

ঢাকায় এ গণহত্যার প্রতিবাদে ২৬ মার্চ কমলগঞ্জে সর্ব দলীয় সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে স্বতঃস্ফূর্ত মিছিল বের হয়। পাক সেনারা সেই মিছিলের উপর গুলি চালালে সিরাজুল ইসলাম নামে একজন বৃদ্ধ শহীদ হন। এ হত্যাকাণ্ডে উপজেলাবাসীর মনে জ্বলে উঠে প্রতিশোধের আগুন। স্থানীয় বাঙালি ইপিআর ও পুলিশ ফাঁড়ির সদস্যরাও একাত্মতা ঘোষণা করে সংগ্রাম পরিষদের সাথে।

২৮ মার্চ শমশেরনগর পুলিশ ফাঁড়ির সমস্ত অস্ত্র উঠিয়ে আনা হয়। মালগাড়ির বগি দিয়ে ভানুগাছ-শমশেরনগর-মৌলভীবাজার রাস্তায় ব্যারিকেড দেওয়া হয়। ২৯ মার্চ পাক বাহিনী খবর পেয়ে আবারও কমলগঞ্জে আসে। সন্ধ্যায় পাক সেনারা ভানুগাছ থেকে শমশেরনগরে এলে মুক্তিসেনাদের অতর্কিত আক্রমণে ক্যাপ্টেন গোলাম রসুল সহ ৯ জন পাক সেনা নিহত হয়। বিজয়ের ঊষালগ্নের এই প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধে প্রচুর অস্ত্র গোলাবারুদসহ পাক সেনাদের ২টি গাড়ি মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়।

মুক্তিযুদ্ধের সর্বপ্রথম এই সশস্ত্র যুদ্ধে বিজয় লাভের পরদিনই কমলগঞ্জে মুক্তিপাগল জনতার এক বিরাট সমাবেশে গঠিত হয় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা পরিষদ। এর পর থেকেই নিয়মিত চলতে থাকে দলে দলে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ। ২৮ মার্চের পর পাক বাহিনী জল স্থল ও আকাশ পথে কমলগঞ্জে সাঁড়াশি আক্রমণ শুরু করে। মুক্তি বাহিনী তাদের অত্যাধুনিক অস্ত্রের মোকাবিলায় অসীম সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করেছে।

এ উপজেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ৩টি ঘটনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো হচ্ছে পাত্রখোলা, ধলাই ও ভানুগাছের যুদ্ধ। ন্যাপ নেতা মফিজ আলী, ক্যাপ্টেন মোজাফফর আহমদ, আওয়ামী লীগ নেতা এম, এ, গফুর, ময়না মিয়া, ক্যাপ্টেন সাজ্জাদুর রহমান প্রমুখের সাহসী নেতৃত্বে কমলগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধারা অসীম সাহসিকতার সাথে লড়েছেন।

এখানকার বিভিন্ন রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেছেন বঙ্গবীর এমএজি ওসমানী, বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান, মেজর খালেদ মোশাররফ, ব্রিগেডিয়ার আমিন আহম্মদ ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমাননের মত ব্যক্তিরা।

এ উপজেলার বিভিন্ন রণাঙ্গনে যুদ্ধ করে শহীদ হয়েছেন বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান, ল্যান্সনায়েক জিল্লুর রহমান, সিপাহী মিজানুর রহমান, সিপাহী আব্দুর রশিদ, সিপাহী শাহজাহান মিয়াসহ নাম না জানা অনেকেই।

ক্যাপ্টেন মোজাফফর আহমেদের নেতৃত্বে পরিচালিত বিভিন্ন গেরিলা অপারেশনের লোমহর্ষকর পর্যায়গুলো শুধু দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা সহ বিভিন্ন বেতার মাধ্যম থেকে তার উপর মন্তব্যও করা হয়েছে বহু বার।

সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি শমশেরনগর মুক্ত হওয়ার সময়। শমশেরনগর যুদ্ধের আরও এক অগ্রসেনানি ছিলেন সৈয়দ মতিউর রহমান। শমশেরনগর মুক্ত হবার প্রাক্কালে তার অসম সাহসী যুদ্ধ পরিচালনা দেখে চমৎকৃত হয়েছিলেন শমশেরনগর ডাক বাংলোয় অবস্থানকারী তৎকালীন সময়ের মিত্র বাহিনীর ক্যাপ্টেন চাতওয়াল সিং। মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ৪ ডিসেম্বরে ভানুগাছ এলাকায় প্রচণ্ড যুদ্ধের পর কমলগঞ্জ সদর থেকে পাক হানাদাররা পিছু হটতে বাধ্য হয়।

৫ ডিসেম্বর শমশেরনগর এলাকা শত্রুমুক্ত করে মুক্তিযোদ্ধারা কমলগঞ্জের মাটিতে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করলেও গোটা কমলগঞ্জ উপজেলা শত্রুমুক্ত হয় ৬ ডিসেম্বর তারিখে।