সিলেটটুডে ডেস্ক

২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০১:৪১

জাতিসংঘে ভাষণ: টিকা বৈষম্য দূর করার আহবান প্রধানমন্ত্রীর

জাতিসংঘে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করোনা মোকাবেলায় গোটা বিশ্বকে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় কার্যকর বৈশ্বিক উদ্যোগের ঘাটতির বিষয়কে সামনে নিয়ে এসেছে কভিড-১৯ মহামারি। একই সঙ্গে এটি বৈশ্বিক সংহতি ও সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তার ওপরও আলোকপাত করেছে। সর্বজনীন বিষয়গুলোয় বিশ্বকে অবশ্যই একসঙ্গে কাজ করতে হবে। নতুন নতুন অংশীদারত্ব ও সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে হবে।

শুক্রবার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের (ইউএনজিএ) ৭৬তম অধিবেশনে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। করোনা সংকট, জলবায়ু পরিবর্তন ও রোহিঙ্গা সংকটসহ অন্যান্য ইস্যুতে ছয় দফা প্রস্তাব তুলে ধরেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, কভিডমুক্ত একটি বিশ্ব গড়ে তুলতে সবার জন্য সর্বজনীন ও সাশ্রয়ী মূল্যে টিকার প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। জরুরি ভিত্তিতে টিকা নিয়ে বৈষম্য দূর করতে হবে। অবিলম্বে টিকা প্রযুক্তি হস্তান্তর টিকার সমতা নিশ্চিত করার একটি উপায় হতে পারে।

বাংলাদেশ সময় শুক্রবার রাত ১২টার কিছুক্ষণ আগে প্রধানমন্ত্রী ভাষণ দিতে শুরু করেন। এ বিশ্বসভায় তিনি প্রায় আধা ঘণ্টা ভাষণ দেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা তার বাবা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে বরাবরের মতো এবারও বাংলায় ভাষণ দেন।

ইউএনজিএর ৭৬তম অধিবেশন গত ১৪ সেপ্টেম্বর শুরু হয়। শতাধিক রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান নীতিনির্ধারণী এ বৈঠকে সশরীরে অংশ নিচ্ছেন। ভাষণের শুরুতে ইউএনজিএর ৭৬তম অধিবেশনের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ায় মালদ্বীপের আবদুল্লাহ শহিদ এবং ৭৫তম অধিবেশনে নেতৃত্ব প্রদানের জন্য বিদায়ী সভাপতি ভলকান বজকিরকে অভিনন্দন জানান প্রধানমন্ত্রী। সেইসঙ্গে এ নিয়ে ১৭ বার জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করার কথাও তুলে ধরেন তিনি।

বিশ্বজুড়ে করোনার প্রাদুর্ভাবের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, সাধারণ পরিষদের এই ৭৬তম অধিবেশনটি এমন এক সময় অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যখন কভিড-১৯ বিশ্বজুড়ে অব্যাহতভাবে মানুষের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে। করোনার নতুন ধরনের মাধ্যমে অনেক দেশ বারবার সংক্রমিত হচ্ছে। এ মহামারিতে গোটা বিশ্বের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।

এই সংকটকালে নিবেদিত সেবা ও আত্মত্যাগের জন্য সম্মুখসারির সব করোনাযোদ্ধার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি বলেন, কভিড-১৯-এর নির্মম বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে এ অধিবেশনের প্রতিপাদ্য 'প্রত্যাশা' অত্যন্ত সময়োপযোগী হয়েছে। বহুপাক্ষিকতাবাদ ও জাতিসংঘ ব্যবস্থার দৃঢ় সমর্থক হিসেবে বাংলাদেশ এই সংকটকালে জাতিসংঘকে আশা ও আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হিসেবে দেখে। সব ধরনের মতভেদ ভুলে গিয়ে আমাদের অবশ্যই 'অভিন্ন মানবজাতি' হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াতে হবে; সম্মিলিত শক্তিকে কাজে লাগিয়ে সবার জন্য আবারও এক সমৃদ্ধ বিশ্ব গড়ে তুলতে হবে।

করোনার প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় সদস্য দেশগুলোকে একযোগে কাজ করানোর ক্ষেত্রে জাতিসংঘকে কার্যকর ভূমিকা রাখার আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে বিভিন্ন অঞ্চলের সদস্য দেশগুলো এই জাতিসংঘের মঞ্চ থেকেই তা শুরু করতে পারে। তবেই সহনশীল ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উত্তরণের লক্ষ্যে একটি অর্থবহ সহযোগিতা অর্জন করতে পারব। এই ক্রান্তিলগ্নে জাতিসংঘই হোক সবার ভরসার সর্বোত্তম কেন্দ্রস্থল। আসুন, সেই ভরসাকে বাঁচিয়ে রাখার প্রত্যয়ে সবাই হাতে হাত মিলিয়ে একযোগে কাজ করি।

বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতি ও এই সংকট মোকাবিলায় তার সরকার গৃহীত পদক্ষেপগুলো তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে কভিড-১৯ মহামারির প্রকোপ আশঙ্কার চেয়ে অনেক কম হয়েছে। তৃণমূল পর্যায় থেকে দেশের শক্তিশালী স্বাস্থ্যব্যবস্থার কারণে এটা সম্ভব হয়েছে। এ ছাড়া এ মহামারি মোকাবিলায় তার সরকারের সময়োচিত, সমন্বিত ও বহুমুখী উদ্যোগ কার্যকর ভূমিকা রেখেছে।

তিনি বলেন, অর্থনীতিকে সচল রাখতে বিভিন্ন সময় তার সরকার ২৮টি প্রণোদনা প্যাকেজের মাধ্যমে প্রায় এক হাজার ৪৬০ কোটি মার্কিন ডলার বরাদ্দ দিয়েছে, যা মোট দেশজ উৎপাদনের ৪ দশমিক ৪৪ শতাংশ। করোনাভাইরাসের টিকা সংগ্রহের জন্য চলতি অর্থবছরে বাজেটে ১৬১ কোটি মার্কিন ডলারের সংস্থান রাখা হয়েছে। সময়োচিত পদক্ষেপ ও জনগণের বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবিলার সক্ষমতার কারণে ২০২০ সালেও বাংলাদেশ ৫ শতাংশের বেশি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, অনাদিকাল থেকে মানবজাতি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারি এবং মানবসৃষ্ট নানা সংঘাত ও দুর্যোগ মোকাবিলা করে আসছে। তা সত্ত্বেও বুকে আশা এবং আত্মবিশ্বাস নিয়ে মানবজাতি এসব পাহাড়সম সমস্যা অতিক্রম করে টিকে রয়েছে। এই মহামারিও এমনি একটি সংকট, যেখান থেকে বহু মানুষের টিকে থাকার অনুপ্রেরণামূলক এবং উদারতার উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে।

তিনি বলেন, দুঃখজনক হলেও এই মহামারি আরও বেশ কিছুদিন স্থায়ী হবে বলে মনে হচ্ছে। সে জন্য এ অভিন্ন শত্রুকে মোকাবিলা করার জন্য অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন সবাইকে অনেক বেশি নতুন, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বৈশ্বিক পরিকল্পনা নিতে হবে।

এ ক্ষেত্রে বিশ্বনেতাদের উদ্দেশে ছয়টি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, গত বছর এ অধিবেশনে তিনি কভিড-১৯ টিকাকে 'বৈশ্বিক সম্পদ' হিসেবে বিবেচনা করার আহ্বান জানালে বিশ্বনেতাদের অনেকে এ বিষয়ে সহমত পোষণ করেছিলেন। সে আবেদনে তেমন সাড়া পাওয়া যায়নি। বরং ধনী ও দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যে টিকা বৈষম্য বেড়েছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, এ পর্যন্ত উৎপাদিত টিকার ৮৪ শতাংশ উচ্চ ও উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশগুলোর মানুষের কাছে পৌঁছেছে। অন্যদিকে, নিম্নআয়ের দেশগুলো ১ শতাশেরও কম টিকা পেয়েছে।

তিনি বলেন, 'জরুরি ভিত্তিতে এ টিকা বৈষম্য দূর করতে হবে। লাখ লাখ মানুষকে টিকা থেকে দূরে রেখে কখনোই টেকসই পুনরুদ্ধার সম্ভব নয়। আমরা পুরোপুরি নিরাপদও থাকতে পারব না। তাই আমি আবারও আহ্বান জানাচ্ছি, সবার জন্য ন্যায়সংগত ও সাশ্রয়ী মূল্যে টিকার প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। অবিলম্বে টিকা প্রযুক্তি হস্তান্তর টিকার সমতা নিশ্চিত করার একটি উপায় হতে পারে। প্রযুক্তি সহায়তা ও মেধাস্বত্বে ছাড় পেলে বাংলাদেশও ব্যাপক পরিমাণে টিকা তৈরি করতে সক্ষম।'

তিনি বলেন, মহামারির প্রকোপে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা চরমভাবে বিপর্যস্ত। জাতিসংঘ শিশু তহবিলের তথ্য অনুযায়ী, করোনাকালে আংশিক বা পুরোপুরি বিদ্যালয় বন্ধের কারণে বিশ্বের প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নিম্নআয়ের দেশগুলোর লাখ লাখ ছাত্রছাত্রীর দূরশিক্ষণে অংশগ্রহণের সক্ষমতা ও প্রযুক্তি না থাকায় ভর্তি, সাক্ষরতার হার ইত্যাদি অর্জন হুমকির মুখে পড়েছে। ডিজিটাল সরঞ্জামাদি ও সেবা, ইন্টারনেটের সুযোগ-সুবিধার সহজলভ্যতা ও শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে বিনিয়োগ করতে হবে। এ জন্য জাতিসংঘকে অংশীদারিত্ব ও প্রয়োজনীয় সম্পদ নিশ্চিত করার জন্য আহ্বান জানাই।

প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, কভিড-১৯ অতিমারির নজিরবিহীন প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণের পথে রয়েছে। তবে এ মহামারি অনেক দেশের উত্তরণের আকাঙ্ক্ষাকে বিপন্ন করেছে। স্বল্পোন্নত দেশের টেকসই উত্তরণ ত্বরান্বিত করার জন্য উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে বাংলাদেশ প্রণোদনাভিত্তিক উত্তরণ কাঠামো প্রণয়নে আরও সহায়তা আশা করে। এলডিসি-৫ সম্মেলনের প্রস্তুতিমূলক কমিটির অন্যতম সভাপতি হিসেবে বাংলাদেশ আশা করে, দোহা সম্মেলনের সুনির্দিষ্ট ফলাফল আরও বেশিসংখ্যক দেশকে সক্ষমতা দান করবে। যেন তারা স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে টেকসইভাবে উত্তরণ করতে পারে।

তিনি বলেন, মহামারিকালে প্রবাসীরা অপরিহার্য কর্মী হিসেবে স্বাস্থ্য ও অন্যান্য জরুরি সেবা খাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। তারাও সম্মুখসারির যোদ্ধা। তবুও তাদের অনেকে চাকরিচ্যুত, বেতন কর্তন, স্বাস্থ্য ও অন্যান্য সামাজিক সেবার সহজলভ্যতার অভাব ও বাধ্যতামূলক প্রত্যাবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এই সংকটকালে অভিবাসী গ্রহণকারী দেশগুলোকে অভিবাসীদের সঙ্গে ন্যায়সংগত আচরণ করার এবং তাদের কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্য এবং কল্যাণকে নিশ্চিত করার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত