সিলেটটুডে ডেস্ক

০৬ জুলাই, ২০১৭ ১৭:০৯

ব্যর্থ হলে দেশে ৪০০ নারী বিচারক হতো না: নাজমুন আরা সুলতানা

দেশের প্রথম নারী বিচারক ও বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা বলেছেন, ‘প্রথম নারী বিচারক হিসেবে আমি ব্যর্থ হলে হয়তো আজ বাংলাদেশে প্রায় ৪০০ নারী বিচারক হতো না।’

দেশের প্রথম নারী বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা হিসেবে বৃহস্পতিবার (৬ জুলাই) আপিল বিভাগে বিচারপতি হিসেবে তাঁর শেষ কর্মদিবস। শুক্রবার অবসরে যাচ্ছেন তিনি, ওই দিন সাপ্তাহিক ছুটি থাকার কারণে বৃহস্পতিবারই ছিল তাঁর শেষ কর্মদিবস। এর মধ্য দিয়ে তাঁর ৪২ বছরের বিচারিক কর্মজীবনের ইতি ঘটতে যাচ্ছে।

দেশ ও বিচার বিভাগের ইতিহাসে নাজমুন আরা সুলতানা প্রথম নারী জেলা জজ। হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগে হওয়া প্রথম নারী বিচারপতি।

প্রথা অনুসারে অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয় ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি বিদায়ী বিচারপতিকে সংবর্ধনা দিয়ে থাকে। প্রধান বিচারপতির ১ নম্বর এজলাস কক্ষে আজ নাজমুন আরা সুলতানার বিদায়ী সংবর্ধনা হয়।

নাজমুন আরা সুলতানা বলেন, ‘আমি আমার সুদীর্ঘ বিচারিক জীবনে কখনোই জেনে-বুঝে, অবহেলা করে বা অমনোযোগী হয়ে কোনো ভুল বিচার বা অন্যায় বিচার করিনি। আমার অনেক বিচার হয়তো ভুল হয়ে গেছে। আপিলে গিয়ে হয়তো তা সংশোধিত হয়েছে। কিন্তু সে ভুল বিচার আমি জেনে-বুঝে বা অমনোযোগী হয়ে করিনি। আমি আমার সমস্ত জ্ঞানবুদ্ধি দিয়ে, সবটুকু মনোযোগ দিয়ে, সমগ্র একাগ্রতা দিয়ে বিচারকাজ করে গেছি।’

নাজমুন আরা সুলতানা বলেন, ‘৪২ বছরের বিচারিক জীবন আজ শেষ হলো। বিচার করার কঠিন কাজ ও সীমাবদ্ধ জীবন থেকে মুক্ত হওয়ার আগ্রহ ছিল আমার। কিন্তু যতই বিদায়ের দিনটি এগিয়ে আসছিল, আগ্রহ কমে আসছিল। আজকের ক্ষণটিতে আমার কষ্ট হচ্ছে এই বিচারাঙ্গণ থেকে বিদায় নিতে। আপনাদের সবাইকে ছেড়ে যেতে।’

নাজমুন আরা সুলতানা বলেন, ‘আমার বিচারক হওয়ার পেছনে আমার বাবার ইচ্ছা ও মায়ের প্রেরণা বড় ভূমিকা রেখেছে।’

নাজমুন আরা সুলতানা বলেন, পাঁচ সন্তানকে ছোট রেখে তাঁর বাবা মারা যান। তাঁর বাবার ইচ্ছা ছিল, সন্তানদের মধ্যে একজন ব্যারিস্টার হবে। কিন্তু মায়ের পক্ষে তাঁর কোনো সন্তানকে বিদেশে পাঠিয়ে ব্যারিস্টারি পড়ানো সম্ভব হয়নি।

তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয়েছিল, আমার আইন পড়ার মাধ্যমে বাবার ইচ্ছা খানিকটা পূরণ হবে।’

নাজমুন আরা সুলতানা জানান, তিনি তাঁর মায়ের উৎসাহে ল কলেজে ভর্তি হন। মফস্বল শহরে ল কলেজে রাতে ক্লাস হতো। ক্লাস শেষ করে বাসায় ফিরতে রাত নয়টার বেশি হয়ে যেত। মায়ের সাহস ও প্রেরণায় তিনি পড়া চালিয়ে যেতে পেরেছিলেন।

নাজমুন আরা সুলতানা বলেন, ‘ময়মনসিংহ জজ কোর্টে আমি প্রথম যেদিন আইনজীবী হিসেবে যোগদান করি, সেদিনের কথা আমার হৃদয়ে গেঁথে আছে। এর আগে আমি কখনো কোর্টে যাইনি।’

নাজমুন আরা সুলতানা বলেন, ল কলেজের অধ্যক্ষ প্রখ্যাত আইনজীবী যোগেন্দ্র নাথ দাস তাঁকে প্রথম দিন জেলা জজের এজলাসে নিয়ে বসিয়ে দিয়ে আসেন। বিচারকাজ শুরু হলে তিনি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তা শুনতে থাকেন।

নাজমুন আরা সুলতানা বলেন, ‘ওই দিনই বোধ হয় আমার মনের কোনায় ইচ্ছাটা উঁকি দিয়েছিল, আমি কি জজ হতে পারি না! কিন্তু জানলাম, জজ হতে পারি না। বাংলাদেশের নারীরা জজ হতে পারে না। ওই সময় তারা পারত না। তারা জজ হওয়ার জন্য যোগ্যই ছিল না।’

নাজমুন আরা সুলতানা বলেন, তাঁর ওকালতি শুরুর বছর দেড়েকের মধ্যে বাংলাদেশ সরকার নারীদের বিচারক না হওয়ার বিধান তুলে নেয়। এরপর বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে দেশের প্রথম নারী বিচারক হন। ১৯৭৫ সালের শেষের দিকে খুলনার জজ শিপে মুনসেফ (সহকারী জজ) হিসেবে যোগ দেন। তখন দুই রকমের প্রতিক্রিয়া হয়। কেউ কেউ তাঁকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। অনেক আবার নাক সিটকেছিলেন।

নাজমুন আরা সুলতানা বলেন, কারও কারও কাছ থেকে অবজ্ঞা পেলেও অনেকের কাছ থেকে ভালো আচরণ পেয়েছিলেন তিনি। সাহায্য পেয়েছিলেন। ওই উৎসাহ ও সাহায্য না পেলে হয়তো তাঁর বিচারক হিসেবে টিকে থাকাই সম্ভব হতো না।

নাজমুন আরা সুলতানা বলেন, দেশের নারী বিচারকেরা অনেক সময় বেশ কিছু অসুবিধা-বিপদের সম্মুখীন হন। এগুলো দূর করার দায়িত্বে ঊর্ধ্বতন যে পুরুষ বিচারক আছেন, তাঁরা অনেক সময়ই এই অসুবিধা-বিপদ বুঝতেই পারেন না। বুঝতে চান না।

নাজমুন আরা সুলতানা বলেন, নারী বিচারকদের সুবিধা-অসুবিধা-বিপদ-সংকট ইত্যাদি কর্তৃপক্ষের কাছে তুলে ধরার জন্য ১৯৯০ সালে কিছু নারী সহকর্মীদের সহযোগিতায় গঠন করা হয় বাংলাদেশ মহিলা জজ অ্যাসোসিয়েশন। এটি এখন সারা বিশ্বের নারী বিচারকদের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও সুপরিচিত সংগঠন।

নাজমুন আরা সুলতানা বলেন, ‘আমার সুদীর্ঘ ৪২ বছরের বিচারিক জীবনের প্রথম দিকে যখনই আমি কোনো জজ শিপে জয়েন করেছি, আমি বেশ বৈরী মনোভাব ও আচরণের সম্মুখীন হয়েছি। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তা দূর হয়ে গেছে। আমার ওপরের সংশ্লিষ্টজনের বিপুল আস্থা আমি অনুভব করেছি।’

প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাসহ আপিল বিভাগের অপর ছয় বিচারপতি সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। শুরুতে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও পরে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি জয়নুল আবেদিন বিদায়ী বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানার কর্মময় জীবন নিয়ে বক্তব্য দেন। এ সময় আইনজীবীদের উপস্থিতিতে এজলাস কক্ষ পরিপূর্ণ ছিল।

সুপ্রিম কোর্ট থেকে পাওয়া তথ্য মতে, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা ১৯৫০ সালের ৮ জুলাই মৌলভীবাজারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা চৌধুরী আবুল কাশেম মইনুদ্দিন। মা বেগম রাশিদা সুলতানা দ্বীন। বাবা-মা দু’জনই প্রয়াত। মা ছিলেন ময়মনসিংহ রাধাসুন্দরী গার্লস হাইস্কুলের শিক্ষিকা। এ কারণে তার শৈশব কেটেছে ময়মনসিংহে। সেখানেই বেড়ে ওঠা। শিক্ষাজীবনও কেটেছে ময়মনসিংহেই।

তিনি ময়মনসিংহ সদরের বিদ্যাময়ী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৬৫ সালে মেট্রিকুলেশন, ১৯৬৭ সালে মুমিনুন্নেসা উইমেনস কলেজ থেকে আইএ পাস করেন। তিনি ১৯৬৯ সালে আনন্দ মোহন কলেজ থেকে বিএসসি পাস করার পর ময়মনসিংহ ল’কলেজ থেকে ১৯৭২ সালে এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর ওই বছরের জুলাইয়ে তিনি ময়মনসিংহ জেলা আদালতে আইনজীবী হিসেবে আইন পেশায় পা রাখেন।

তার স্বামী কাজী নুরুল হক। দুই ছেলে সন্তানের মা তিনি। বড় ছেলে কাজী সানাউল হক উপল থাকেন অস্ট্রেলিয়া। ছোট ছেলে এহসানুল হক সূর্য।

বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা ১৯৭৫ সালের ২০ ডিসেম্বর মুনসেফ হিসেবে (সহকারী জজ) নিয়োগ পান। তখন পর্যন্ত তিনিই ছিলেন দেশের প্রথম নারী বিচারক। এরপর ১৯৯০ সালের ২০ ডিসেম্বর জেলা জজ হিসেবে পদোন্নতি পান। এখানেও তিনিই প্রথম নারী জেলা জজ ছিলেন। পরবর্তীতে কর্মদক্ষতার কারণেই নিম্ন আদালত থেকে ধীরে ধীরে দেশের সর্বোচ্চ আদালতে পা রেখেছেন।

এরপর ২০০০ সালের ২৮ মে তিনি হাইকোর্টে অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। এর দুই বছর পর ২০০২ সালের ২৮ মে হাইকোর্টে স্থায়ী বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। ২০১১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি আপিল বিভাগে প্রথম নারী বিচারপতি হিসেবে শপথ নেন।

নারী বিচারকদের সংগঠন বাংলাদেশ উইমেন জাজেস অ্যাসোসিয়েশনের (বিডব্লিউজেএ) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন তিনি। আন্তর্জাতিক নারী আইনজীবী সংস্থায় দুইবার সদস্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ভারত, নেপাল, থাইল্যান্ড, ইতালি, জাপান, আমেরিকা, চীন, ইরান, ইরাক, ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়া, নেদারল্যান্ড, পানামা, হংকং সফর করেন।

বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা ফতোয়া বিষয়ক মামলা, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার সেনানিবাসের বাড়ির মামলা, চারদলীয় জোট সরকার আমলে বাদপড়া ১০ বিচারপতির মামলা, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার সম্বলিত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী, উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণ বিষয়ক সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী মামলাসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ মামলায় বিচারকের দায়িত্বে ছিলেন।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত