নিজস্ব প্রতিবেদক

৩০ অক্টোবর, ২০১৫ ০০:০৮

সিলেট বিএনপিতে শূন্যতা, চরম নেতৃত্ব সঙ্কট

বিএনপি নেতৃত্বাধীন গত জোট সরকারের আমলে অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী ছিলেন এম সাইফুর রহমান। তখন একটা কথা খুব প্রচলিত ছিলো- অন্য কোনো এলাকার মন্ত্রী-এমপিরা নিজেদের এলাকার জন্য কোনো উন্নয়ন প্রকল্প সাইফুর রহমানের কাছে নিয়ে আসলে সাথে সিলেটের জন্য একই রকমের একটি প্রকল্প প্রস্তাব নাকি নিয়ে আসতে হতো। সিলেটের হিস্যা না দিয়ে নিজেদের এলাকার উন্নয়ন প্রকল্প নাকি অন্য এলাকার মন্ত্রী-এমপিরা পাশ করাতে পারতেন না।

দলে ও সরকারে সাইফুর রহমানের ক্ষমতা বুঝাতে এমন গল্প করতেন তাঁর অনুসারীরা। দলে সাইফুর রহমানের প্রভাব নিয়ে আরও নানান গল্প চালু আছে সিলেট বিএনপি অনুসারীদের মাঝে।

দলে এমন প্রভাবের কারণেই সিলেট বিএনপির অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা হয়ে ওঠেছিলেন মৌলভীবাজারের বাসিন্দা সাইফুর রহমান। কেন্দ্রীয় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যের পাশাপাশি হয়ে ওঠেছিলেন সিলেটের বিএনপি রাজনীতির অভিভাবক।

২০০৯ সালের ৫ সেপ্টেম্বর সড়ক দুর্ঘটনায় সাইফুর রহমানের মৃত্যুতে নেতৃত্ব সঙ্কট দেখা দেয় সিলেট বিএনপিতে। সাইফুর রহমানের মতো প্রভাবশালী না হলেও এসময় সিলেটে বিএনপির হাল ধরেন সমশের মবিন চৌধুরী ও এম ইলিয়াস আলী।

সমশের বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান ও ইলিয়াস আলী বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মনোনিত হন। নিজেদের মধ্যে অর্ন্তকোন্দলে জড়ালেও এই দুই নেতাই ছিলেন কেন্দ্রীয় বিএনপিতে সিলেটের প্রতিনিধি।

ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হওয়ার পর আরেক দফা শূন্যতার সৃষ্টি হয় সিলেট বিএনপিতে। ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল ঢাকা থেকে নিখোঁজ  হন এম ইলিয়াস আলী। বিএনপির পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, সরকার তাকে গুম করেছে।

সর্বশেষ বৃহস্পতিবার (২৯ অক্টোবর) বিএনপি থেকে পদত্যাগ করেন সমশের মবিন চৌধুরী বীর বিক্রম। তাঁর পদত্যাগের মধ্য দিয়ে সিলেট বিএনপিতে দেখা দিয়েছে চরম শূন্যতা; নেতৃত্বের তীব্র সঙ্কট। এমনিতেই সিলেট বিভাগ জুড়ে অর্ন্তকোন্দলে বিপর্যস্ত বিএনপি। তার ওপর এই নেতৃত্ব শূন্যতা দলটিকে আরও বিপাকে ফেলেছে।

শীর্ষ পর্যায়ে সিলেটের প্রতিনিধিত্ব করার মতো বিএনপিতে বর্তমানে আর তেমন কোনো নেতাই নেই। হবিগঞ্জের ডা. সাখাওয়াত হােসেন জীবন বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটিতে সহ-সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্বে থাকলেও তিনি এখন পর্যন্ত পুরো বিভাগের নেতা হয়ে ওঠতে পারেননি।

এই শূন্যতার কথা স্বীকার করে নিয়ে সিলেট মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব বদরুজ্জামান সেলিম সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এটা শুধু বিএনপির শূন্যতা নয়, এটা পুরো সিলেটের শূন্যতা।

তিনি বলেন, যে কোনো দলের শীর্ষ পর্যায়েই সিলেটের লোকজন থাকলে এটা সিলেটবাসী হিসেবে আমাদের জন্য গর্বের। কিন্তু যখন একটি দলে শূন্যতা সৃষ্টি হয় তখন এ সংকট পুরো সিলেটের।

সমশের মবিনের পদত্যাগে সাময়িক সমস্যা সৃষ্টি হবে উল্লেখ করে বদরুজ্জামান বলেন, হাইকমান্ড নিশ্চয়ই এই শূন্যতা পূরণে উদ্যোগী হবে।

সাইফুর রহমানের আগে সিলেটে বিএনপিকে নেতৃত্ব দিয়েছেন খন্দকার আব্দুল মালিক। কেন্দ্রীয় বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যানও ছিলেন সিলেট-১ আসনের সাবেক এই সাংসদ। তাঁর মৃত্যুতে সাময়িক সঙ্কট তৈরি হলেও সিলেট বিএনপিতে সাইফুর রহমানের একচ্ছত্র প্রভাবে তা বেশি দিন স্থায়ী হয়নি।

আমলাসূলভ মনোভাব, সিলেট জেলার বাইরের লোক, তৃণমূলের নেতাকর্মীদের সাথে সম্পর্কহীনতার কারণে প্রথমদিকে সাইফুর রহমানকেও সিলেট বিএনপিতে অবস্থান করে নিতে বেগ পেতে হয়েছিলো।

তবে কেন্দ্র ও দলীয় চেয়ারপার্সনের কাছে তাঁর উচ্চাসন, সরকার ও দলের মধ্যে ব্যাপক প্রভাবের বলে দ্রুতই সিলেট বিএনপির একাধিপতিতে পরিণত হন সাইফুর রহমান। বিএনপিকে ছাপিয়ে পুরো সিলেটেরই নেতা হয়ে ওঠেছিলেন সাবেক এই আমলা।

তাঁর মৃত্যুর পর বিএনপির হাল ধরেন এম ইলিয়াস আলী। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে পৃষ্টপোষকতার ব্যাপক অভিযোগ থাকলেও নিজের সাংগঠনিক ক্ষমতা বলে এই সময়ে সিলেট বিএনপির নেতা হয়ে ওঠেন ইলিয়াস আলী।

সাইফুরপন্থী হিসেবে পরিচিত নেতারা প্রথমে ইলিয়াস আলীকে এড়িয়ে চললেও অল্পসময়েই সাংগঠনিক সক্ষমতা বলে বিরোধীদেরও নিজের অনুসারী করে তুলেন ইলিয়াস। এই সক্ষমতার বলেই দলের সিনিয়র নেতা হয়ে সমশের মবিন চৌধুরী সেসময় সিলেট বিএনপিতে তেমন সুবিধা করতে পারেননি।

ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হওয়ার পর ফের নেত্বতৃ সঙ্কটে পড়ে সিলেট বিএনপি। এখনো সিলেটে বিএনপি ইলিয়াস আলীর শূন্যতা পুরণ করতে পারেনি বলে মনে করেন তাঁর অনুসারীরা।

ইলিয়াস আলী নিখোঁজের পর স্বাভাবিকভাবেই সিলেট বিএনপির অভিভাবকতুল্য নেতা হয়ে ওঠেন সমশের মবিন চৌধুরী। সিলেটে দলীয় কর্মকাণ্ডে তেমন সক্রিয় না থাকলেও এবং তৃণমূলের নেতাদের সাথে তেমন সম্পৃক্ত থাকলেও কেন্দ্রে অবস্থানের কারণে সমশের মবিনই হয়ে ওঠেন সিলেট বিএনপির নেতা।

বৃহস্পতিবার তাঁর আকস্মিক পদত্যাগে সিলেটে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় নেতৃত্ব সঙ্কট দেখা দিয়েছে বিএনপিতে।

সিলেটে বিএনপিতে বর্তমানে নেই কোনো হাই প্রোফাইল নেতা। স্থানীয় যে নেতারা রয়েছেন তারাও বহুধা বিভক্ত। অর্ন্তকোন্দলে বিপর্যস্ত। এমনিতে সিলেটে বিএনপির সাংগঠনিক কোনো কর্মকাণ্ড নেই, তবু রয়েছে কোন্দল। পারষ্পরিক বিরোধ। নেতৃত্ব সঙ্কটের কারণেই এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। সমশের মবিনের পদত্যাগ এই সঙ্কট আরো ঘনীভূত হবে বলে আশঙ্কা তাদের।  


তবে ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি আব্দুল আহাদ খান জামাল মনে করেন সিলেট বিএনপির এই নেতৃত্বের সঙ্কট বেশিদিন থাকবে না। প্রাকৃতিক নিয়মেই তা পূরণ হয়ে যাবে।

তাঁর মতে, যখনই নেতৃত্বের শূন্যতা দেখা দেয় তখনই নতুন নেতৃত্ব ওঠে আসে।

এ ব্যাপারে সাবেক সাংসদ ও সিলেট বিএনপির সিনিয়র নেতা দিলদার হোসেন সেলিম বলেন, সমশের মবিনের পদত্যাগে আমরা মর্মাহত। বর্তমান সরকার তাকে বিনাদোষে জেলে ঢুকিয়েছে। একারণে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।

সাইফুর-সমশের-ইলিয়াসের অনুপস্থিতিতে সিলেট বিএনপিতে নেতৃত্বের সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে বলেও মনে করেন তিনি।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত