নিজস্ব প্রতিবেদক:

২৩ অক্টোবর, ২০২১ ০০:১৭

হাকালুকিতে বৃক্ষ নিধন: চার মাসেও তদন্তে অগ্রগতি নেই

বাঁধ তৈরি করা হয়েছে। কাটা পড়েছে গাছ। মৌলভীবাজারে হাকালুকি হাওরের বড়লেখার মালাম বিলের পাড়। ফাইল ছবি

মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন হাকালুকি হাওরের মালাম বিলের দক্ষিণ-পূর্ব পাশের খাসজমি থেকে জলজ বৃক্ষ নিধনের ঘটনায় দায়ের করা মামলার তদন্তে দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। মামলা দায়েরের প্রায় চার মাস অতিবাহিত হলেও তদন্তে ঘটনাস্থলে যাননি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা।

তবে পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. বদরুল হুদা বলছেন, তারা শিগগীর এ মামলার তদন্ত সম্পন্ন করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করবেন।

এদিকে সূত্র জানিয়েছে, হাকালুকি হাওরের মালাম বিলের গাছ কাটার ঘটনায় যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে তাদের পেছনে কয়েকজন প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তি রয়েছেন। মূলত তারাই ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন দফতরে তদবির করছেন। এই কারণে তদন্তে ধীরগতি ও সময়ক্ষেপণ হচ্ছে।

গাছ কাটার ঘটনায় গত ২২ জুন পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে বড়লেখা থানায় একটি মামলা হয়। পরিবেশ অধিদপ্তর মৌলভীবাজার জেলা কার্যালয়ের পরিদর্শক মো. নজরুল ইসলাম বাদী হয়ে মামলাটি করেন।

পরিবেশ সংরক্ষণ আইন এবং প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ব্যবস্থাপনা বিধিমালায় মামলা করা হয়। সাতজনকে আসামি করা হয়েছে। অজ্ঞাতনামা আছে আরও ১৫ থেকে ২০ জন।

আসামিরা হচ্ছেন বড়লেখা উপজেলার মনাদি গ্রামের জয়নাল উদ্দিন, কাজীরবন্দের মক্তদির আলী, মশাঈদ আলী, রিয়াজ আলী, জয়নাল উদ্দিন, কালা মিয়া ও সুরুজ আলী।

মামলার বিবরণে বলা হয়েছে, হাকালুকি জাগরণী ইসিএ ব্যবস্থাপনা বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সদস্য ও মালাম বিল বনায়ন এলাকার পাহারাদার আবদুল মনাফ গত রোববার পরিবেশ অধিদপ্তরে একটি অভিযোগ দেন। তাতে বলা হয়েছে, হাকালুকি হাওরের মালাম বিলের দক্ষিণ-পূর্ব পাশের খাসজমির প্রায় ১২ বিঘা জমিতে পরিবেশ অধিদপ্তরের সৃজিত বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষ এবং প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো গাছ কর্তন করা হয়েছে। মালাম বিলের বাঁধ ও চাষের জমি তৈরির জন্য প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকার ক্ষতিসাধন করা হয়েছে। এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে মামলার বাদী অভিযোগকারী, হাল্লা ফরেস্ট বিটের বিট কর্মকর্তা সুমন বিশ্বাস এবং হাকালুকি ইসিএ ব্যবস্থাপনা বহুমুখী সমবায় সমিতির সদস্যরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।

পরিদর্শনে দেখা গেছে, আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে মালাম বিলের দক্ষিণ-পূর্ব পাশের খাসজমির প্রায় ১২ বিঘা জমিতে সৃজিত বিভিন্ন প্রজাতির জলজ বৃক্ষ হিজল, করচসহ অন্যান্য প্রজাতি এবং প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো ১০ থেকে ১৫ ফুট উচ্চতার আনুমানিক ১৫ থেকে ২০ হাজার গাছ কর্তন করেছেন। তারা মালাম বিলের বাঁধ নির্মাণ ও জমি চাষের জন্য উপযোগী করার কার্যক্রম গ্রহণ করেছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ (সংশোধিত ২০১০)-এর ধারা ৫-এর উপধারা ১ ও ৪–এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সরকার ১৯৯৯ সালের ১৯ এপ্রিল এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে হাকালুকি হাওরের ১৮ হাজার ৩৮৩ হেক্টর এলাকাকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইকোলজিক্যাল ক্রিটিক্যাল এরিয়া-ইসিএ) ঘোষণা এবং সুস্পষ্ট বিধিনিষেধ আরোপ করে। ইসিএ এলাকার প্রতিবেশব্যবস্থা সংরক্ষণ ও উন্নয়নের জন্য সরকার কর্তৃক ইতিমধ্যে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ব্যবস্থাপনা বিধিমালা, ২০১৬ জারি করা হয়েছে। ইসিএ এলাকা হাকালুকি হাওরের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য মৎস্য ও জলজ প্রাণী এবং পাখির বসবাসের উপযোগী রাখার জন্য পরিবেশ অধিদপ্তর হাকালুকি হাওরে বনায়ন কার্যক্রম গ্রহণ করে। প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ব্যবস্থাপনা বিধিমালা অনুযায়ী বিদ্যমান প্রাকৃতিক অবস্থা এবং জীববৈচিত্র্য, বন্য প্রাণীর আবাসস্থলসহ সংরক্ষিত বন ও রক্ষিত এলাকা, নদ-নদী, খাল-বিল, প্লাবনভূমি, হাওর-বাঁওড়, লেক, জলাভূমি, পাখির আবাসস্থল, মৎস্য অভয়াশ্রমসহ অন্যান্য জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদের জলজ অভয়াশ্রম, জলাভূমির বন, ম্যানগ্রোভ ও উপকূলীয় এলাকার অবক্ষয়–সংক্রান্ত কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

এজাহারে বলা হয়েছে, আসামিরা প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকায় আরোপিত বিধিনিষেধ লঙ্ঘন করে পরিবেশ অধিদপ্তরের সৃজিত ও প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা জলজ বৃক্ষ কর্তনের মাধ্যমে হাকালুকি হাওরের মৎস্যসম্পদ, জলজ প্রাণী, পাখির আবাসস্থল, উদ্ভিদের জলজ অভয়াশ্রমের ক্ষতিসাধন করেছেন। এর মাধ্যমে তারা বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ (সংশোধিত ২০১০)-এর ধারা ৫-এর উপধারা ৪ এবং প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ব্যবস্থাপনা বিধিমালা, ২০১৬-এর বিধান লঙ্ঘন করেছেন, যা দণ্ডনীয় অপরাধ।

এ ঘটনায় পৃথক আরেকটি অভিযোগের প্রেক্ষিতে গত ২৭ জুন বড়লেখার দায়িত্বে থাকা সহকারী কমিশনার (ভূমি) নূসরাত লায়লা নীরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন। এতে ইজারার শর্ত ভঙ্গ করায় জলমহালের লিজ বাতিলের সুপারিশ করেন তিনি।

সূত্র জানিয়েছে, বড়লেখার সহকারী কমিশনার (ভূমি) নূসরাত লায়লা নীরা সরেজমিনে সরকারি ইজারাকৃত মালাম বিলের ইজারাদার কর্তৃক দক্ষিণ-পূর্ব পাশের খাসজমিতে বাঁধ নির্মাণের জন্য মাটি খননকালে ও খননকৃত স্থানে বেশ কিছু পরিবেশ বান্ধব হিজল গাছ বিনষ্ট হওয়ার প্রমাণ পেয়েছেন। পরিবেশ বান্ধব গাছ বিনষ্ট করে ইজারাদার জলমহাল লিজ চুক্তিপত্রের ১১ নম্বর ও ২১ নম্বর এর (ক) ও (গ) নম্বর শর্ত ভঙ্গ করেন। এজন্য ইজারার শর্ত ভঙ্গের কারণে মালাম বিলের লিজ বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে।

পরিবেশ অধিদপ্তর মৌলভীবাজারের সহকারী পরিচালক মো. বদরুল হুদা বলেন, ‘এজাহারভুক্ত আসামি ছাড়াও জলজবৃক্ষ নিধন ও জীববৈচিত্র্য বিনষ্টে আরও কয়েকজন প্রভাবশালীর সম্পৃক্ততার তথ্য মিলেছে। এগুলোর যাচাই চলছে। এদের ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে তদন্ত সম্পন্ন ও অভিযোগপত্র দাখিলে সময় ব্যয় হচ্ছে। তবে দ্রুত এ মামলার তদন্ত সম্পন্ন করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হবে।’

আপনার মন্তব্য

আলোচিত