নিজস্ব প্রতিবেদক

০১ জুলাই, ২০২২ ২২:৫৬

সাপ আর আফালের ভয়

যতদূর চোখ যায় কেবল পানি আর পানি। রহিমা খাতুনের ঘরটি যেনো পানির উপরই ভাসছে। পানি ঘরের ভেতরেও। তবু স্বামী-সন্তান নিয়ে ঘরেই থাকেন তিনি।

রহিমা বলেন, ঘর ছেড়ে গেলে তো গরীবের যে সামান্য মাথাগোঁজার ঠাঁই আছে আছে তাও ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। পানি ভাসিয়ে নেবে। চোরেরা লুটে নেবে। কোনরকমকে জোড়াতালি দিয়ে টিকিয়ে রেখেছি ঘরটি। 

কখনো পানির উপরে আবার কখনো নৌকায় বা চৌকিতে উঠে কোনরকমে দিন চলে যায় রহিমার। কিন্তু রাত হলেই তার মনে ভয় ঢুকে পড়ে। সাপের ভয়।
 
রহিমা বলেন, দিনেই অনেক সাপ ঘরের আশপাশ দিতে ভেসে যেতে দেখি। একদিন ঘরেও ঢুকে পড়েছিলো একটি। বিষাক্ত সাপ। তাই রাত হলে আর সাপের ভয়ে ঘুমাতে পারি না। রাতে তো অন্ধকারের কারণে কিছু দেখা যায় না। তাই ভয়ে থাকি। ছেলেকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকি।

সুনামগঞ্জের সদর উপজেলার কাঠইর ইউনিয়নের নোয়াগাওয়ে বাড়ি রহিমার। এই পুরো ইউনিয়নটিই এখন জলের উপর ভাসছে। প্রতিটি ঘরেই পানি। পানির বড় বড় ঢেউয়ে ভেঙে পছে মাটির ঘরবাড়ি।

ঢেউয়ে ঘর ভাঙার ভয়ের সাথে আছে সাপের ভয়। খাবার সঙ্কট তো আছেই। রোগে-শোকেও ঘর থেকে বের হওয়ার উপায় নেই। মাঝেমাঝে নৌকায় করে দেবদূতের মতো কিছু লোক আসেন এখানে। খাবার ও পানি নিয়ে। ওষুধও দিয়ে যান কেউ কেউ। এসব খেয়েই কোনরকমে চলছে সুনামগঞ্জ শহর লাগোয়া এই ইউনিয়নটি বানভাসিদের।

রহিমা খাতুনের ঘর থেকে বেরিয়ে নৌকায় করে কিছুদূর এগোতেই দেখা মেলে আরেক বৃদ্ধের। পানিতে প্রায় ভেসে আসছেন। মানুষ নয়, জলে ভাসা কচুরিপানা যেন।

বৃদ্ধের নাম আসকর আলী। কাছে যেতেই বললেন, ১৫ দিন ধরে ঘরসহ পুরো এলাকা পানিতে তলিয়ে আছে। পানি কিছুতেই কমছে না।

আসকর বলেন, ঘরে বসে থেকে তো আর চলছে না। তাই কাজের সন্ধানে বেরিয়েছি। দেখি কোথাও কিছু পাই কি না।

পানিতে ভেসে ভেসে মূল সড়কে উঠে কাজের সন্ধান করবেন বলে জানান আসকর।

এই ইউনিয়নের কলাইয়া গ্রামের শহিদুলও রাতে ঘুমাতে পারেন না। তার ঘরেও পানি। শহিদুল ভয় ঢেউয়ে। হাওর অঞ্চলে এসব বড় বড় ঢেউকে আফাল বলে।

শহিদুল বলেন, আফালের কারণে ঘরের বেড়া ভেঙে পড়েছে। একেকটা আফাল আসে আর মনে হয় এই বুঝি পুরো ঘর ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। এই ভয়ে রাতে ঘুমাতে পারি না। সারারাত জেগে-আল্লাহ আল্লাহ করি।
 
একই অবস্থা পাশ্ববর্তী মোহনপুর ইউনিয়নেরও। ইউনিয়নের দেওয়াননগর গ্রামের আসলাম মিয়া বলেন, দুদিন আগে আমার মেয়ে খুব অসুস্থ হইছিলো। কিন্তু তারে কোন ডাক্তার দেখাতে পারিনি। ওষুধ কিনে দিতে পারিনি।

পানির কারণে এই এলাকায় কোন ফার্মেসি ও দোকানপাট খোলা নেই জানিয়ে আসলাম বলেন, কারো অসুখ বিসুখ করলেও ঘরে বসে মরা ছাড়া কোন উপায় নেই আমাদের।

কাঠইর ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত নারী সদস্য জ্যোৎস্না বেগমের ঘরেও পানি। তিনি বলেন, এখন আর কি পানি দেখছেন। আর পাঁচ ছয়দিন আগে এলে দেখতেন অবস্থা। অনেক মানুষ ঘরের চালে উঠে তীরে ধরে বসেছিলো। পুরো ঘরই তলিয়ে গিয়েছিলো পানিতে।

এখন আবার পানি বাড়ছে বলে জানান জ্যোৎস্না।

আসলে এই দুই ইউনিয়নের নয়, এমন অবস্থা এখন পুরো সুনামগঞ্জেরই। কেবল শহর থেকে পানি নেমেছে। শহরছাড়া জেলার বাকি এলাকা এখনো তলিয়ে আছে পানিতে। গত ১৫ জুন থেকেই পানিবন্দি পুরো সুনামগগঞ্জ এবং সিলেট। সরকারি হিসেবেই এই দুইজেলায় অন্তত ৪০ লাখ মানুষ পানিবন্দি আছেন। বেসরকারি হিসেবে এই সংখ্যা আরও বেশি।

সুনামগঞ্জ শহরে ঢুকতেই দেখা যায়, বিভিন্ন সড়কের পাশে লেপ, তোষক, জাজিম স্তুপ আকারে ফেলে রাখা। চৌকিসহ আসবাবপত্রও ফেলে রাখা আছে কয়েক জায়গায়।

ঘর থেকে তোষক এনে সড়কের পাশে স্তুপ করে রাখছিলেন শহরের নতুন পাড়া এলাকার বাসিন্দা সুজক নন্দী। তিনি বলেন, প্রায় ১০ দিন ঘরের ভেতরে পানি ছিলো। পানি এতো দ্রুত বেড়েছে যে কোন আসবাবপত্র সরানো যায়নি।

তিনি বলেন, পানি নামার পর আজ ঘরে এসে দেখি লেপ-তোষক পচে গন্ধ হয়ে গেছে। তাই এগুলো ফেলে দিচ্ছি। আসবাবপত্রও নষ্ট হয়েছে অনেক।

স্থানীয় সরকার বিভাগ সুনামগঞ্জের উপ পরিচালক মো. জাকির হোসেন। সুনামগঞ্জ জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহীরও দায়িত্বে আছেন তিনি।

নিজের সরকারি বাসায় নিয়ে পানির চিহ্ন দেখিয়ে জাকির হোসেন বলেন, প্রথম তলা পুরোটাই পানিতে তলিয়ে গিয়েছিলো। পানিহীন কোন একতলা বাসা ছিলো না এখানে।

তিনি বলেন, প্রথম দুই তিন দিন তো একেবারে যোগাযেযাগ বিচ্ছিন্ন ছিলো সবাই। বিদ্যুৎ নেই, মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই। আমরাই কোন খোঁজখবর পাচ্ছিলাম না।

 
সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গির হোসেন জানান, বন্যায় জেলায় ৪৫ হাজার ২৮৮টি ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এরমধ্যে ৪ হাজার ৭৪৭টি পুরো ভেঙে গেছে। এছাড়া এখন পর্যন্ত সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৩৮৪ কিলোমিটার। পানি পুরো কমলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে।

জেলা প্রশাসক বলেন, ক্ষয়ক্ষতির তালিকা মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়েছে। যাদের ঘরবাড়ি ভেঙেছে তাদের সরকারি উদ্যোগে পুনর্বাসন করা হবে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত