সিলেটটুডে ডেস্ক

১৪ আগস্ট, ২০২২ ২২:২৭

১৭ বছর ধরে পরিত্যক্ত ছাতকের দুই গ্যাসকূপ খননের উদ্যোগ

উৎপাদনে এলে দিনে মিলবে ৪০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস

সুনামগঞ্জের ছাতক গ্যাসক্ষেত্রটি দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে পরিত্যক্ত। সেটিকে দ্রুত উৎপাদনে আনার তাগিদ জ্বালানি সংশ্লিষ্টদের বহুদিনের। কিন্তু আইনি জটিলতায় এগোতে পারেনি জ্বালানি বিভাগ। তবে নাইকোর সঙ্গে যে অংশ নিয়ে আইনি জটিলতা রয়েছে, তার বাইরে দুটি এলাকায় কূপ খননের উদ্যোগ নিয়েছে পেট্রোবাংলা।

দোয়ারাবাজার ইস্ট-১ ও দোয়ারাবাজার ওয়েস্ট-১—এ দুটি এলাকায় অনুসন্ধান কূপ খনন করবে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রডাকশন কোম্পানি লিমিটেড (বাপেক্স)। তাতে সফল হলে এ সংকটের সময় জাতীয় গ্রিডে দৈনিক ৪০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস যুক্ত করা সম্ভব হবে। খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ছাতকে এখনো ৪৫০ বিসিএফ (বিলিয়ন কিউবিক ফুট) গ্যাসের মজুদ রয়েছে।

বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী বলেন, গ্যাসক্ষেত্রটিতে শুরু থেকেই নাইকোর সঙ্গে রাষ্ট্রীয় কোম্পানি হিসেবে বাপেক্স কাজ করেছে। ফলে তারা (নাইকো) চলে গেলেও এখন মামলার রায় হওয়ার ফলে আমরা সেখানে কাজ করতে পারব। ছাতকে পূর্ব ও পশ্চিম দুটি ব্লক রয়েছে। যে এলাকায় বিস্ফোরণ ঘটেনি, আমরা ওই এলাকায় থ্রিডি সিসমিক সার্ভে করব। এরপর সেখানে অনুসন্ধান কূপ খনন করা হবে। এরই মধ্যে দুটি এলাকায় অনুসন্ধান কূপ খননের জন্য ডিপিপি (ডিটেইলড প্রজেক্ট প্ল্যান) নেয়া হয়েছে।

সম্প্রতি বাপেক্সের এক কার্যপত্র সূত্রে জানা যায়, ছাতক গ্যাসক্ষেত্রের তিনটি এলাকায় থ্রিডি সিসমিক সার্ভে করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ডিপিপি প্রণয়ন করা হয়েছে ছাতক, দোয়ারাবাজার ও কোম্পানীগঞ্জ এলাকায়। তবে এক্ষেত্রে আইনগত কোনো জটিলতা আছে কিনা, সে বিষয়টি দেখার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে দোয়ারাবাজার ইস্ট-১ ও দোয়ারাবাজার ওয়েস্ট-১ অনুসন্ধান কূপ খননের জন্য ৪৫২তম সভায় ডিপিপি অনুমোদন দিয়েছে বাপেক্স। সেই পরিকল্পনার কপি পাঠানো হয়েছে পেট্রোবাংলায়ও। সংস্থাটির আইন বিভাগের সামগ্রিক মতামত বিশ্লেষণ করে অনুমোদন দিলে ছাতকে অনুসন্ধান কূপ খননে আর কোনো বাধা থাকবে না বলে জানিয়েছেন পেট্রোবাংলার শীর্ষ এক কর্মকর্তা।

গ্যাস উৎপাদন বাড়াতে বাপেক্স ২০৪১ সাল পর্যন্ত যে পরিকল্পনা করেছে তার মধ্যে ছাতক গ্যাসক্ষেত্রের বিষয়টিও রয়েছে। যেখান থেকে  ২০২৪ সালের মধ্যে জাতীয় গ্রিডে গ্যাস যুক্ত করার পরিকল্পনা তাদের। বাপেক্স সূত্রে জানা গিয়েছে, ছাতক গ্যাসক্ষেত্র এলাকায় দুটি অনুসন্ধান কূপ খননে প্রাক্কলিত ব্যয়ে ধরা হয়েছে ১৯৮ কোটি টাকা। আর সেই অর্থ আসবে গ্যাস উন্নয়ন তহবিল (জিডিএফ) থেকে। ওই কূপ দুটিতে গ্যাসের মজুদ রয়েছে ২৯৫ বিসিএফ। বাণিজ্যিকভাবে তা আবিষ্কৃত হলে সেখান থেকে দৈনিক ৪০ এমএমসিএফ কম-বেশি গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে।

বাপেক্সের সঙ্গে ২০০৩ সালে যৌথ উদ্যোগে একটি চুক্তির আওতায় ছাতকের টেংরাটিলায় গ্যাসকূপে গ্যাস উত্তোলনের দায়িত্ব পায় কানাডার প্রতিষ্ঠান নাইকো। কূপ খনন শুরু হলে ২০০৫ সালে গ্যাসক্ষেত্রটিতে দুই দফায় বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণের পর গাফিলতি ও অদক্ষতার কারণে নাইকোর বিরুদ্ধে মামলা ও অভিযোগ করা হয়। দীর্ঘ আইনি লড়াই শেষে ২০২০ সালে এ মামলায় জয় পায় বাংলাদেশ। জয়ের পরই মূলত সেখানে নতুন করে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের পরিকল্পনা শুরু করে বাপেক্স। তবে এখনো বেশকিছু আইনি জটিলতা রয়েছে। কেননা মামলার রায়ে বাংলাদেশকে যে ১ বিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দেয়ার কথা বলা হয়, সেটির বিষয়ে নাইকোর পক্ষ থেকে এখনো কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। যে কারণে আইনি কাঠামোর মধ্য থেকে ছাতকে গ্যাস অনুসন্ধান চালাতে চায় জ্বালানি বিভাগ।

পেট্রোবাংলার গ্যাস মজুদের তথ্য অনুযায়ী, ছাতকে নাইকোর ফেলে যাওয়া কূপে ৪৪৭ বিলিয়ন ঘনফুট (বিসিএফ) গ্যাসের মজুদ রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারমূল্য হিসাব করলে প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাসের মূল্য ১৫ ডলার ধরে মজুদ থাকা গ্যাসের আর্থিক মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ৬৭০ কোটি ডলারের বেশি। সেই হিসেবে ছাতকের দুটি গ্যাসক্ষেত্রে ২৯৫ বিসিএফ গ্যাসের আর্থিক মূল্য ৪৪২ কোটি ডলারের বেশি। গ্যাস সংকটের এ সময় জাতীয় গ্রিডে সেই গ্যাস সরবরাহ হলে তা পেট্রোবাংলাকে কিছুটা হলেও স্বস্তিতে ফেরাবে।

ছাতকে দুটি গ্যাসকূপ খননের বিষয়ে জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার শীর্ষ এক কর্মকর্তা নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে  বলেন, ছাতক গ্যাসক্ষেত্র নিয়ে নাইকোর সঙ্গে আমাদের আইনি জটিলতা এখনো রয়েছে। তবে তাদের অংশের বাইরে দুটি এলাকায় পেট্রোবাংলা অনুসন্ধান কূপ খননের উদ্যোগ নিয়েছে। যত দ্রুত সম্ভব ছাতকের কূপে পড়ে থাকা গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করাই আমাদের পরিকল্পনা। তাই চলতি বছরেই কূপ দুটি খননের উদ্যোগ নেয়া হবে।

পাকিস্তান পেট্রোলিয়াম করপোরেশন ৭৫ কিলোমিটার সিসমিক সার্ভে করে ১৯৫৯ সালে ছাতকে গ্যাসের সন্ধান পায়। ১৯৬০ সাল থেকে একটি কূপে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গ্যাস উত্তোলন শুরু হয়। তখন দৈনিক ৪০ লাখ ঘনফুট গ্যাস তুলে দেয়া হতো ছাতক সিমেন্ট ও পেপার মিলে। ২ হাজার ১৩৫ মিটার পর্যন্ত খনন করা সেই কূপটির ১ হাজার ৯০ থেকে ১ হাজার ৯৭৫ মিটারের মধ্যে নয়টি গ্যাসসমৃদ্ধ স্তরের সন্ধান মেলে। তবে সেই গ্যাস কাঠামোর মধ্যে একটি ফাটল থাকায় ক্ষেত্রটিকে ছাতক পূর্ব ও ছাতক পশ্চিম নামে দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়। ১৯৮৪ সালের পর ছাতক থেকে গ্যাস উত্তোলন বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৮৫ সালে ‘ওয়ার্কওভার’ করা হলেও তা সফল হয়নি। এরপর গ্যাসক্ষেত্রটিতে আর অনুসন্ধান কাজ চালানো হয়নি। ১৯৯৮ সালে কানাডার কোম্পানি নাইকো ছাতকসহ কয়েকটি গ্যাসক্ষেত্র প্রান্তিক (পরিত্যক্ত) দেখিয়ে গ্যাস অনুসন্ধানের প্রস্তাব দেয়। ১৯৯৯ সালে বাপেক্সকে সঙ্গে নিয়ে একটি যৌথ সমীক্ষা চালায়।
সূত্র: বণিকবার্তা

আপনার মন্তব্য

আলোচিত