জীবন পাল

১০ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ২৩:৩৭

প্রধানমন্ত্রীর সাথে আলাপ: এখনও স্বপ্ন মনে হচ্ছে মুনমুনের

'প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথা বলাটা অবশ্যই ভাল লাগার মতোই একটা বিষয়। কথা বলে ভাল লেগেছে। কিন্তু একদিক দিয়ে খারাপও লেগেছে। কেন না, আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের চা বাগান এবং চা শ্রমিকদের নিয়ে কোন কথা বলতে পারিনি। চা শ্রমিকদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে কিছু চাইতে পারিনি। বক্তব্য দিয়েছি, সেটা আনন্দের বিষয়। প্রধানমন্ত্রীর সাথে বক্তব্য দেওয়া সেটা তো অনেক আনন্দের বিষয়।  

কথাগুলো মুনমুন ঘোষের। যিনি গত ৩ সেপ্টেম্বর চা শ্রমিকদের ভিডিও কনফারেন্সে বক্তব্য দেন। মুনমুন চা শ্রমিকদের সন্তান।

সেদিনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে মুনমুন বলেন, 'আমি তো রীতিমতো অবাক হয়েছিলাম। বক্তব্য দেওয়ায় আমি পুরোপুরি একজন অনভিজ্ঞ মানুষ। তার মধ্যে আমি না কোন আলোচিত কেউ। সেই জায়গা থেকে আমার মতো একজন যে কথা বলার সুযোগ পাবে, তাও আবার দেশের প্রধানমন্ত্রীর সাথে সেটা আমার কাছে এখনও স্বপ্ন মনে হচ্ছে।'

তিনি আরো বলেন, 'আমি তো নিজেও জানতাম না যে সেখানে আমাকে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে। একদম আনপ্রিপিয়ার্ড অবস্থায় আমি আমার বক্তব্য তুলে ধরেছি। যা আমার ভাবনার বাইরে ছিল। তাছাড়া আমি এর আগে কখনও কোথাও বক্তব্য দেই নি। তবে বক্তব্য দেবার পর আমার মনে হয়েছে আমার জায়গায় অভিজ্ঞ একজনকে বক্তব্য দিলে আরো ভাল হতো।'

আপনার আমন্ত্রণে প্রধানমন্ত্রী সাড়া দিয়ে চলে আসলে কেমন হবে প্রশ্ন করা হলে মুনমুন জানান, 'আমার আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে প্রধানমন্ত্রী আমাদের চা বাগানে চলে আসলে নিজেকে অনেক ভাগ্যবান মনে করবো। প্রধানমন্ত্রী যদি আমাদের চা শ্রমিকদেরকে এসে দেখে যান তাহলে সেটা আমাদের জন্য অনেক বড় একটি প্রাপ্তি হবে।'

ফেনুয়া টি স্টেট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক, শাহানগর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক এবং কাটিড়হাট মহিলা ডিগ্রি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন মুনমুন। যিনি এসএসসি ও এইচএসসি দুটিতেই বিজ্ঞান বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। মুনমুন বর্তমানে হাটহাজারী কলেজে বিএসএস ২য় বর্ষে অধ্যয়নরত। সেই সাথে কর্ণফুলি চা বাগানের কুতুব ছড়ি ডিভিশনের কুতুব ছড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছেন। সিটি গ্রুপ পরিচালিত নতুন এ বিদ্যালয়ে মুনমুনের চাকরীর বয়স ৯ মাস।

মুনমুনরা ৬ ভাইবোন। যাদের মধ্যে মুনমুন ৩য়। বড়বোন ও মেঝো বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। তার এই দুইবোনের মধ্যে বড়বোন বৃষ্টি ঘোষ গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেছেন। আর মেঝো বোন শম্পা ঘোষ মাস্টার্স ১ম বর্ষে অধ্যয়নরত বলে জানালেন মুনমুন। মুনমুনের পরে তার ছোট ভাই সৈকত ঘোষ। সৈকত শারীরিক প্রতিবন্ধী। তার ছোট দুই বোন বাঁধন ঘোষ ও কাঁকন ঘোষ। বাঁধন ৮ম শ্রেণীতে আর কাঁকন পড়ে ৭ম শ্রেণীতে।

প্রধানমন্ত্রীর সাথে দিদির কথা বলার বিষয় নিয়ে বেজায় খুশি বাঁধন ও কাঁকন। এ নিয়ে তাদের দুজনের স্কুলের সহপাঠীসহ শিক্ষকরাও অনেক খুশি হয়ে তাদের দিদির প্রশংসা করছেন। যা শুনে তাদের দুই বোনের নাকি মহা আনন্দ। এ বিষয়টি গর্বিত বোধ করছে তারা।

মুনমুনের বোন বাঁধন বলে, সেদিন তো সেখানের অনুষ্ঠানে সবাইকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। তাই সরাসরি দেখার ভাগ্য আমাদের হয়নি। আমাদেরকে ঢুকতে না দেওয়ায় আমরা বাসায় এসে টিভিতে দেখেছি। আমার দিদিকে প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথা বলতে দেখে আমাদের কি যে আনন্দ লেগেছে।

বাঁধন বলে, ক্লাসের সবাই দিদির সুনাম করেছে। সব মিলিয়ে বিষয়টি আসলে আমাকে ও আমাদের পরিবারকে অনেক আনন্দ ও খুশির মুহুর্ত উপহার দিয়েছে।

এদিকে পড়ার টেবিল থেকে উঠে এসে মুনমুনের আরেক বোন কাঁকন বলেন, আমার স্কুলের সকলেই দেখেছে। পরেরদিন স্কুলে যাওয়া মাত্র ক্লাসের সবাই দিদির বিষয় নিয়ে বলাবলি করছে। সকলেই অনেক খুশি যে আমার দিদি প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথা বলেছেন। তাদের সকলের মুখে দিদির প্রশংসা শুনে আমার অনেক ভাল লেগেছে।

কাঁকন বলে, 'পরের দিন দেখি পত্রিকায় দিদির ছবি। সেটা দেখে আনন্দ দিশেহারা হয়ে গেছি। আমি তো সেই পত্রিকাটি আমার স্কুলে ব্যাগে ঢুকিয়ে স্কুলে নিয়ে গেছি। আমার সহপাঠীদের সবাইকে দেখিয়েছি।'

দিদির আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে প্রধানমন্ত্রী যদি চলে আসেন তাহলে প্রধানমন্ত্রীকে কি খাওয়াবে এমন প্রশ্ন করলে কাঁকন বলে, 'আমি তো ছোট মানুষ। আমার বাসার মানুষজন অনেক কিছু রান্না করে প্রধানমন্ত্রীকে খাওয়াবেন।'

৭ম শ্রেণীর এই ছাত্রী বলে, সত্যি সত্যি যদি প্রধানমন্ত্রী আমাদের এখানে আসেন তাহলে স্কুল থেকে আসার সময় আমি আমাদের প্রধানমন্ত্রীর জন্য চকলেট নিয়ে আসবো।'

প্রধানমন্ত্রী সাথে নিজের মেয়ের কথা বলতে পারার বিষয়টি নিয়ে খুবই গর্বিত মুনমুনের মা পারুল ঘোষ।

তিনি বলেন, 'আমার মেয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথা বলেছে, মা হিসেবে আমি গর্বিত। এটা তো আসলে একটি ভাগ্যের বিষয়। কেননা, প্রধানমন্ত্রীর সাথে তো আর যে কেউ চাইলেই কথা বলতে পারেন না। যারা আমার মেয়েকে কথা বলার জন্য সুযোগ করে দিয়েছেন তাদেরকে ধন্যবাদ।'

বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের চট্টগ্রাম ভ্যালী সভাপতি নিরঞ্জন নাথ মন্টু বলেন, 'প্রধানমন্ত্রী আমাদের চা শ্রমিকদের সাথে কথা বলেছেন, সেটা আমাদের জন্য অনেক বড় একটি পাওয়া। প্রথমে শ্রমিকপক্ষ হয়ে প্রধানমন্ত্রী মালিকপক্ষের সাথে বৈঠকে বসে চা শ্রমিকদের মজুরি বাড়িয়েছেন। তারপর শ্রমিকদের সাথে কথা বলে আবাসনের ব্যবস্থা সহ মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণের আশ্বাস দিয়েছেন। সেজন্য প্রধানমন্ত্রীকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানায়। আশাকরি প্রধানমন্ত্রী খুব দ্রুত চা শ্রমিকদের এসবকিছুর কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া জন্য নির্দেশনা দেবেন।'

এই ভ্যালী সভাপতি আরো বলেন, চা শ্রমিক সন্তানদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষা গ্রহণ করে যাতে ভাল চাকুরীতে প্রবেশ করতে পারে সেজন্য চা শ্রমিক সন্তানদের জন্য আলাদা কৌটার বিষয়টিও দ্রুত বাস্তবায়ন হলে চা শ্রমিকরা একটি সুন্দর ভবিষ্যতের রাস্তাটাও তৈরি হয়ে যাবে।'

৩ সেপ্টেম্বর বিকালে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার লেলাং ইউনিয়নের কর্ণফুলী চা বাগান থেকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হন এই শিল্পের শ্রমিকরা।

এসময় হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের চণ্ডিছড়া চা বাগান, মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের পাত্রখোলা, সিলেট সদরের লাক্কাতুরা এবং চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির কর্ণফুলী চা বাগানের শ্রমিকরা নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরেন।

চার চা বাগানের মধ্যে সবার শেষে চট্টগ্রামের চা বাগানের শ্রমিকরা প্রধানমন্ত্রীকে নিজেদের মনের কথা বলেন।

প্রধানমন্ত্রীকে এক চোখে দেখেই কথা বলছিলেন কর্ণফুলী চা বাগানের শ্রমিক লাকী নারায়ণ। এসময় চায়ের নিমন্ত্রণ দিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লে অপর চোখের চিকিৎসার আশ্বাস দেন শেখ হাসিনা।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত