নিজস্ব প্রতিবেদক

১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ২৩:২৩

সারদা হলে সিসিকের ভাগাড়, আন্দোলনে নামছেন সংস্কৃতিকর্মীরা

সিলেটের ঐতিহ্যবাহী সারদা স্মৃতি ভবনকে ভাগাড়ে পরিণত করেছে সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক)। সংস্কৃতি চর্চার জন্য নির্মিত শতবর্ষী এই ভবন প্রায় ১০ বছর ধরে দখল করে নিজেদের আবর্জনা আর পরিত্যক্ত জিনিসপত্র রাখছে সিসিক।

এ নিয়ে ক্ষুব্ধ স্থানীয় সংস্কৃতিকর্মীরা। ঐতিহ্যবাহী ভবনটি উদ্ধারে এবার আন্দোলনে নামছেন তারা। মঙ্গলবার (২০ সেপ্টেম্বর) বিকেলে সম্মিলিত নাট্য পরিষদে, সিলেটের উদ্যোগে ভবনটি সংস্কৃতি চর্চার জন্য ফের উন্মুক্ত করে দেয়ার দাবিতে প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।

এ ব্যাপারে সম্মিলিত নাট্য পরিষদ ও সিলেটের সাধারণ সম্পাদক রজতকান্তি গুপ্ত বলেন, ‘এই হলটি একজন ব্যক্তি সংস্কৃতি চর্চার জন্যই নির্মাণ ও দান করেছিলেন। এই ভবনকে ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা অনৈতিক। এ ছাড়া এটি সিলেটের একটি ঐতিহ্যবাহী ভবন। এটি রক্ষা করা আমাদের সবার দায়িত্ব।’

তিনি আরও বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে এই ভবনটি সংস্কার করে পুরো এলাকা নিয়ে একটি সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স করার দাবি জানিয়ে আসছি আমরা। সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের কাছেও এ দাবি জানিয়েছি। তারা সরেজমিনে পরিদর্শন করে আমাদের দাবির সঙ্গে একমতও হয়েছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণের জন্য সিসিকের মেয়রের কাছে ডিও লেটারও (সরকারি বিষয়ে অনানুষ্ঠানিক পত্র) দিয়েছেন। তবে তাতেও কোনো কাজ হয়নি। সিসিক মেয়র নানা অজুহাতে এ ব্যাপারে কেবল সময়ক্ষেপণ করেই চলছেন। বারবার দাবি জানিয়েও কাজ না হওয়ায় আমরা বাধ্য হয়েই এবার আন্দোলনে নামছি।’

সারদা হল সংস্কৃতি চর্চার জন্য উন্মুক্ত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ধারাবাহাহিকভাবে আন্দোলন চলবে বলে জানান তিনি।

এ ব্যাপারে সিসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বিধায়র রায় চৌধুরী বলেন, ‘করপোরেশনের নিজস্ব কোনো পার্কিং এলাকা নেই। ফলে আমাদের গাড়ি নদী তীরবর্তী এলাকায় পার্কিং করা হয়। পার্কিং প্লেসের জন্য একটি জায়গা অধিগ্রহণের পরিকল্পনা আমাদের আছে। সেখানে গাড়ি মেরামতের ব্যবস্থাও থাকবে। শিগগিরই এ ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ে ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) পাঠানো হবে। নিজস্ব পার্কিং প্লেস হয়ে গেলে নদী তীরবর্তী জঞ্জাল আর থাকবে না।’

সরদা হল সংস্কার ও সংস্কৃতি চর্চার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ বিষয়টি মেয়র দেখভাল করছেন। তিনিই এ ব্যাপারে ভালো বলতে পারবেন।

সারদা হলের পার্শ্ববর্তী সিলেটের আরও দুটি ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা ক্বীন ব্রিজ ও আলী আমজদের ঘড়ি। এই দুই স্থাপনার আশপাশের এলাকাকেও নিজেদের পার্কিং জোনে পরিণত করেছে সিসিক। দিনভর সিসিকের বিভিন্ন পরিষেবার গাড়ি দাঁড় করানো থাকে এই এলাকায়। এতে দুর্ভোগ পোহাতে হয় এসব এলাকায় ঘুরতে আসা দর্শনার্থী ও পর্যটকদের।

জানা যায়, ১৯৩৬ সালে সিলেট শহরের সুরমা নদীর তীরবর্তী চাঁদনীঘাট এলাকায় নির্মিত হয় ‘সারদা স্মৃতি ভবন’। সংস্কৃতি চর্চার বিকাশে সিলেটের একটি ঐতিহ্যবাহী ব্যবসায়ী পরিবার ৩৯ শতক ভূমিতে কলকাতা ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটের আদলে এই মিলনায়তনটি নির্মাণ করে। এরপর থেকে দেশের প্রথম এই মিলনায়তনে নিয়মিত গান ও নাটকসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক অনুষ্ঠানের আয়োজন হতো।

পরবর্তী সময়ে সিলেট পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনের যৌথ ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হয়ে আসছিল এ ভবনটি। তবে গত প্রায় এক দশক ধরে ভবনটিকে ভাগাড়ে পরিণত করেছে সিসিক। সারদা হল প্রাঙ্গণে ফেলে রাখা হয়েছে সিসিকের বিকল গাড়িসহ বিভিন্ন যন্ত্রাংশ। মিলনায়তনের ভেতরে ফেলে রাখা হয়েছে বইয়ের স্তূপ। দীর্ঘদিন ধরে অযত্ন আর অবহেলায় নষ্ট হয়ে পড়েছে ভবনটি। এর ফলে বন্ধ হয়ে গেছে সাংস্কৃতিক সব কর্মকাণ্ড।

সিসিক সূত্রে জানা যায়, নগরীর বন্দরবাজার এলাকার পুরোনো নগরভবন ভেঙে নতুন ভবনের নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১২ সালে। ওই সময় সুরমা নদীর তীরে তোপখানা এলাকায় সিটি করপোরেশন পরিচালিত ‘পীর হাবিবুর রহমান’ পাঠাগারে সিসিকের অফিস অস্থায়ীভাবে স্থানান্তর করা হয়। আর পাঠাগারের বই এনে স্তূপ আকারে রাখা হয় সারদা হলের ভেতরে। এ ছাড়া হলের মূল ভবনের পাশের ছোট ভবনগুলোতে সিসিকের কয়েকটি দপ্তরের কার্যক্রম চালু করা হয়। সে সময় সিসিকের কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন, নতুন নগর ভবনের কাজ শেষ হওয়ার পর পুনরায় পীর হাবিবুর রহমান পাঠাগার চালু হবে এবং সারদা হল সংস্কৃতি চর্চার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হবে।

এরপর ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে সিসিকের নবনির্মিত ভবনের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর থেকে স্থায়ী ভবনেই চলছে সিসিকের সব কার্যক্রম। তবে স্থায়ী ভবনে আসার প্রায় সাড়ে চার বছর পরও চালু হয়নি পীর হাবিবুর রহমান পাঠাগার। আর সংস্কৃতি চর্চার জন্য উন্মুক্ত হয়নি সারদা হলও।

গত বৃহস্পতিবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সারদা হল কমপ্লেক্সের ভেতরে বিশৃঙ্খলভাবে সিসিকের বিকল হয়ে যাওয়া গাড়িগুলো ফেলে রাখা হয়েছে। পানির গাড়ি ও বুলডোজারের যন্ত্রাংশও ফেলে রাখা হয়েছে আঙিনাজুড়ে। সিসিকের কয়েকজন কর্মচারীর আবাসন ব্যবস্থাও করা হয়েছে এই চত্বরে। আর পীর হাবিবুর রহমান পাঠাগার থেকে আনা বই দীর্ঘদিন ধরে হলরুমে স্তূপ করে ফেলে রাখা হয়েছে। এতে বেশির ভাগ বই-ই ইতিমধ্যে নষ্ট হয়ে গেছে। একসময় সিলেটের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের এই পীঠস্থানটি এখন পরিণত হয়েছে আবর্জনার ভাগাড়ে। মূল ভবনটিও অবহেলায় নষ্ট হয়ে পড়ছে।

সারদা হলের পাশের ক্বীন ব্রিজ ও আলী আমজদের ঘড়ি এলাকায়ও একই চিত্র। যদিও প্রায় এক যুগ আগে সুরমা নদী তীরের সব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে নগরবাসীর বেড়ানো ও বিনোদনের জন্য স্থানটিকে দৃষ্টিনন্দনভাবে সাজিয়েছিল সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত