শোয়েব উদ্দিন, জৈন্তাপুর

১৮ মার্চ, ২০২৪ ০৩:২৯

চোরাকারবারিদের দখলে তামাবিল মহাসড়ক, দুর্ঘটনায় বাড়ছে প্রাণহানি


সংগীতে গুরুমুখী বিদ্যার কথা জানা থাকলেও গাড়ি চালানোয় এ বিদ্যার কথা অনেকের জানা ছিল না। আজকাল সিরিজ দুর্ঘটনার মূল কারণ হিসেবে বেরিয়ে আসছে চালকের গুরুমুখী বিদ্যার কথা। তবে সংগীতে সাত স্বরে হাতেখড়ি তারপর দীর্ঘ সময় প্রায় জীবনজুড়ে সাধনা চলে। মোটরযান শাস্ত্রে সাধনা বলে কিছু নেই। স্টিয়ারিং, এক্সিলেটর, ব্রেক, গিয়ার ইত্যাদির সঙ্গে পরিচিত হলেই গাড়ি নিয়ে সোজা রাস্তায়। গ্রামের রাস্তায় কিছুদিন চালানোর আত্মবিশ্বাস অর্জন করতে পারলে হাইওয়ে সড়কে। এরপর দুর্ঘটনার নায়ক বা ভিলেন হয়ে আলোচনায় আসা। দুর্ঘটনার অনুঘটক হিসেবে চোরাই পণ্য পরিবহনের দিকেই থাকে অভিযোগের আঙুল।

সত্যিই কি সড়ক দুর্ঘটনার মূল দায় চালকের? হ্যাঁ, বেশিরভাগ দুর্ঘটনা নিঃসন্দেহে চালকের অদক্ষতার জন্যই হয়। কিন্তু অদক্ষ চালক স্টিয়ারিং ধরছে কেন? তাদের পেশাগত সঠিক প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা যাচ্ছে না কেন?

বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) বৈধ ছাড়পত্র নিয়ে সারাদেশে গাড়ি চালাচ্ছে এগারো লাখের বেশি চালক। আর বৈধ ছাড়পত্রে গাড়ি চলছে পনেরো লাখের বেশি। সরকারি হিসাবেই অবৈধ চালক চার লাখের বেশি। বেসরকারি হিসেবে সংখ্যা আরও বেশি হবে নিঃসন্দেহে। বৈধ ছাড়পত্রহীন এসব চালকের একমাত্র ভরসা গুরুমুখী বিদ্যা। আর এদের হাতে জীবন সঁপে মানুষ রাস্তায় চলছে। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘটছে ট্র্যাজেডি।

সড়ক দুর্ঘটনা আজকালের স্বাভাবিক খবর হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আমাদের কানে চলে আসে। মৃত্যু অনিবার্য। কেউ তা থামাতে পারবে না। তবে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু মেনে নেওয়া কঠিন। দিনে হাজারো দুর্ঘটনার শিকার হয়ে নিহত হচ্ছে মানুষ। মায়ের সঙ্গে ঘুরতে গিয়েই সড়কপথে দুর্ঘটনায় নিহত ছেলে, বিদেশ ফেরত প্রবাসী পথেই দুর্ঘটনায় নিহত, রাস্তার পাশে দাঁড়ানো অবস্থায় গাড়ির ধাক্কায় নিহত যুবক। এমন হাজারো দুর্ঘটনার সংবাদ আমাদের কানে আসে। কিন্তু এর পেছনে দায়ী কে বা কারা প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার পেছনের মূল কারণ আমরা অনেকেই জানি না।

পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, সিলেট তামাবিল মহাসড়কে গত বছর সড়ক দুর্ঘটনায় কমপক্ষে ৭০ জন নিহত হয়েছেন। এই সড়কে মৃত্যুর হার অনেকাংশেই বাংলাদেশের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌঁছে গেছে। সড়ক দুর্ঘটনা আজকাল শুধু কোনো দুর্ঘটনা নয়; বরং অনেকাংশেই এটা দুর্যোগের পর্যায়ে চলে গেছে।

সড়ক দুর্ঘটনার পেছনে অন্যতম কারণ হলো ফিটনেসবিহীন অবৈধ গাড়ির দখলে থাকা সড়কপথ। যার কারণে প্রচুর যানবাহন সড়ক দুর্ঘটনার মতো অস্বাভাবিক মৃত্যুর মুখে ঝুঁকে পড়ছে। সড়ক নিরাপত্তায় দায়িত্ব প্রাপ্ত সংস্থাগুলোর স্বেচ্ছাচারিতা, অনিয়ম-দুর্নীতি বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং তাদের জবাবদিহির অভাবে সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি বাড়ছে বলে মনে করছে সচেতন মহল। সড়কে এ ধরনের হৃদয়বিদারক ঘটনা যাতে আর না ঘটে সে বিষয়ে সজাগ দৃষ্টি রাখতে প্রশাসনের প্রতি আহবান এলাকাবাসীর। তাদের ধারণা বিগত ক্লিন হার্ট অপারেশন ও ১/১১ এর সময় তামাবিল মহাসড়কসহ বাংলাদেশের প্রতিটি মহাসড়কে আইনের প্রয়োগ থাকায় সড়ক দুর্ঘটনা শূন্যের ঘরে চলে আসে। একই আইন বর্তমানেও চলমান তারপরেও সড়ক দুর্ঘটনা রোধ না হওয়ার কারণ হিসেবে তারা দেখছেন সড়কে আইনের প্রয়োগ বাস্তবায়ন না থাকা।

স্থানীয় কিছু মাফিয়া সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে সীমান্তের অপার থেকে চোরাকারবারিদের যোগসাজশে অবৈধ পথে বাংলাদেশে প্রবেশ করে ভারতীয় চিনি, চা পাতা, মদ, ইয়াবা, পেঁয়াজ, গরু, মহিষ, কসমেটিক্স, মোটরসাইকেল, মোবাইল, টাটা গাড়ির যন্ত্রাংশ, (অপারেশনের) সারজিক্যাল সামগ্রী, ঔষধ, নবরত্ন তেল, সহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য। এসব পণ্য নিয়ে বেপরোয়া গতিতে প্রাণঘাতী (পিকআপ) ডিআই গাড়ি নিয়ে প্রতিনিয়ত তামাবিল মহাসড়ক দিয়ে চলাচল করে। এসব পণ্যবাহী গাড়ি অন্য সব গাড়ির মতো চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি করতে দেখা যায়নি তামাবিল মহাসড়কে বসা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এ সুযোগে চালকের চোখে সড়কের পাশে বা ফুটপাতে দাঁড়ানো মানুষগুলোকে কিংবা ছোট যানবাহনকে তুচ্ছ মনে করে দুর্ঘটনা ঘটাতে তাচ্ছিল্য বোধ করে না। দুর্ঘটনার পর তাদের নিয়ন্ত্রণকারি মাফিয়ারা অভিভাবক সেজে দুর্ঘটনা ধামাচাপা দিয়ে দুর্ঘটনা কবলিত স্থান থেকে গাড়ি উদ্ধার করে তাদের আস্তানায় ছুটে যায়।
জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট, সীমান্ত দিয়ে আসা ভারতীয় অবৈধ পণ্যগুলো নিয়ন্ত্রণ করে মাফিয়া চক্রটি। অবৈধ এসব পণ্যের নিরাপদ স্থান হিসেবে সীমান্তের অদূরে বেছে নিয়েছে চিহ্নিত ২টি বাজারসহ তার আশপাশ এলাকা গুলোতে। চক্রটি তৃতীয় ব্যক্তির মাধ্যমে চোরাকারবারি ও প্রশাসনের কিছু অসাধু কর্মকর্তাদের সাথে সমঝোতা করে চোরাইপথে আসা অবৈধ পণ্য চলে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। এক দিকে সরকার যেমন রাজস্ব হারাচ্ছে আপর দিকে বিভিন্ন বন্দর দিয়ে আসা পণ্য ব্যবসায়ীরা ক্ষতির মুখে পড়ছে। আর চোরাকারবারিদের নিয়ন্ত্রণহীন গাড়ির চাকায় পৃষ্ট হচ্ছে পথযাত্রীসহ সাধারণ মানুষ। বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশ হলেও তামাবিল মহাসড়ক নিয়ে মাথা ব্যথা নেই সড়ক অথরিটি সহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের।

চলতি বছরের শুরুতেই একটি পিক-আপের ধাক্কায় ৪ জন ছাত্রলীগের কর্মী চাপা পড়ে নিহত হন। ১৫ ফেব্রুয়ারি তামাবিল মহাসড়কের বাঘেরসড়ক নামক স্থানে চোরাই চিনি বোঝাই ডিআই ট্রাক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দোকানে ঢুকে পড়ে। কিছুদিন যেতে না যেতেই হরিপুর দরবস্তসহ বিভিন্ন স্থানে সড়ক দুর্ঘটনায় আরও অন্তত ৫ জনের মৃত্যু ঘটে। ৬ মার্চ তামাবিল মহাসড়কে আবারও কেড়ে নিলো উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক লিয়াকত আলীর ছেলেসহ ৩ বন্ধুর তাজা প্রাণ। এর রেশ কাটতে না কাটতে সিলেট গ্যাসফিল্ড সংলগ্ন উমনপুর এলাকায় ট্রাক ও বাসের সংঘর্ষে নিহত হন ২ জন। ১৪ মার্চ রাতে হরিপুর বাজার ব্রিজে চোরাই পণ্য বোঝাই ডিআই ২টি ট্রাকের মধ্যে সংঘর্ষ হয় একই দিনে জৈন্তাপুর বাচার স্টেশনে ডিআই ট্রাকের ধাক্কায় অটোরিকশার যাত্রী গুরুতরও আহত হন। ১৭ মার্চ বিকাল ৪টার দিকে দরবস্ত দিঘীরপার নামক স্থানে ট্রাক চাপায় সিএনজিচালিত অটোরিকশার ২ যাত্রী গুরুতর আহত হন।

এসব দুর্ঘটনায় দেশব্যাপী মানুষের হৃদয়ে নাড়া দিলেও তামাবিল সড়কে প্রশাসনের চেক পোষ্ট থাকলেও অবৈধ ফিটনেসবিহীন গাড়ি কিংবা চোরাই পণ্য বোঝাই ট্রাক আটকের কোন দৃশ্য দেখা যায় না। ২০২৩ সালের তুলনায় চলতি বছর সিলেট তামাবিল হাইওয়ে এলাকায় দুর্ঘটনা এবং হতাহতের পরিমাণ বেড়েছে।

বাস চালক কামাল আহমদ বলেন, তামাবিল মহাসড়কে প্রাণহানি কমাতে ভারতীয় অবৈধ পণ্যবাহী ফিটনেসবিহীন গাড়ি ও চালকদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের কঠোর পদক্ষেপ দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে পারে। তামাবিল মহাসড়কে তাদের বেপরোয়া চলাচল দুর্ঘটনার প্রধান কারণ।

ভারী যানবাহনের চালক দাবি করেছেন, মহাসড়কে দুর্ঘটনার জন্য প্রধানত দায়ী নিষিদ্ধ ডিআই ট্রাক। মোটরসাইকেল, প্রাইভেট কারসহ অন্যান্য ভারী যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণে না থাকলে দুর্ঘটনা অনিবার্য। যে কারণে চালকদেরও সচেতন হওয়া জরুরি। সে ক্ষেত্রে যারা ট্রাক, কাভার্ডভ্যানসহ বিভিন্ন গাড়ি চালান তাদের নির্ধারিত সময়ে বিশ্রাম নিতে হবে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত