এস আলম সুমন, হাকালুকি থেকে ফিরে

২৬ জানুয়ারি, ২০১৬ ০০:৫০

হাকালুকিতে নির্বিচারে অতিথি পাখি নিধন, তৎপর সংঘবদ্ধ চক্র

প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এশিয়ার বৃহত্তম হাকালুকি হাওরে নির্বিচারে অতিথি পাখি নিধন চলছে। পাখি নিধনে সংঘবদ্ধ শিকারিচক্র বেশ তৎপর হয়ে উঠেছে। দীর্ঘদিন থেকে অরক্ষিত থাকার কারণে এই সংঘবদ্ধ শিকারি চক্রটির দৌরাত্ম্য এখন বেড়েই চলছে।

বিষটোপের মাধ্যমে শিকারের পাশাপশি অভিনব কৌশলে ফাঁদ পেতে অতিথি পাখি শিকারে লিপ্ত রয়েছে শিকারিরা। সেইসাথে রয়েছে প্রভাবশালী সৌখিন শিকারিরাও।

সুদূর সাইবেরিয়া ও হিমাচল প্রদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে শীতকালে অতিথি পাখিরা দেশের বৃহত্তম এই হাকালুকি হাওরে আসে। আগে প্রতিবছরের নভেম্বর মাস থেকেই ৫০ থেকে ৬০ প্রজাতির পরিযায়ী পাখির আগমনে মুখরিত হয়ে উঠত হাকালুকি। বর্তমানে আগের চেনা দৃশ্যপট সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে।

সরেজমিন হাকালুকির কুলাউড়া, জুড়ী ও বড়লেখা অঞ্চলের চকিয়া, নাগুয়া, ফুটবিল, পিংলা, চাতলা, ফোয়ালা, বালিজুরি ও জল্লাসহ কয়েকটি বিলে গিয়ে দেখা যায় শামুকখোল, পানকৌড়ী, লেঞ্জা, মাছরাঙা, বিভিন্ন প্রজাতির অতিথি পাখির সমাগম হয়েছে।

ওইসকল এলাকার বাসিন্দারা জানান, নিরাপদ বিচরণের অভাব ও শিকারিদের উৎপাত বৃদ্ধি পাওয়ায় গত দুই বছর ধরে পাখি কম আসছে হাওরে। তারা এজন্য প্রশাসনের উদাসীনতাকেই দায়ী করেছেন।

২০১৪ সালে যেখানে ১৭টি অভয়াশ্রম ছিলো বর্তমানে সেটার সংখ্যা কমে ১২টি অভয়াশ্রম রয়েছে। এগুলো অধিকাংশতে তদারকির অভাবে সেখানেও বেশ তৎপর পাখি শিকারী চক্র এমনটি জানালেন হাওরে কৃষিকাজ ও মৎস্য আহরণের কাজে জড়িত মামুন মিয়া, আব্দাল হোসেন, রসিম মিয়াসহবেশ কেয়েকজন কৃষক।

বিলের পাহারাদার মতিন মিয়া, হাওরের কৃষক আবু তাহের, জালাল মিয়া, বাতান ব্যবসায় জড়িত আব্দুল মাজেদসহ বেশ কয়েকজন বলেন, পাখি শিকারিরা দিনে গরু-মহিষ চড়ানো, ধান চাষ, হাঁস চড়ানোর নামে ছদ্মবেশে হাওরে ঘোরা ফেরা করে। এ সময় সুযোগ বুঝে বিষটোপের মাধ্যমে পাখি শিকার করে পাখি নিয়ে সটকে পড়ে। সন্ধ্যার পর থেকেই ১০-১২ জন সংঘবদ্ধ হয়ে পাখি শিকারে নামে। তারা এ সময় জাল দিয়ে ফাঁদ পেতে পাখি শিকার করে গভীর রাত পর্যন্ত। ভোর হওয়ার আগেই হাওর থেকে চলে যায় সংঘবদ্ধ শিকারিরা। পিংলা বিলের পাশে গরু চড়ানোয় ব্যস্ত কিশোর শরীফ, সবুজ, সজিব জানায়, শিকারিরা পুঁটি মাছের ভিতর পটাশ ভরে বিলের পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখে যায়। পাখিরা ওইসব মাছ খেয়ে মাথা ঘুরে পড়ে গেলে শিকারিরা এসে পাখিগুলো জবাই করে নিয়ে যায়। প্রায়ই শিকারিরা এক থেকে দেড়শ’ টাকার বিনিময়ে শিকারকৃত পাখি হাওর থেকে পাচারের জন্য তাদেরকে ব্যবহার করে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাওরের বনবিভাগে কর্মরত একজন গার্ড এবং হাওরের মৎসজীবি ও কৃষিকাজে জড়িতরা জানান, সৌখিন শিকারিরা প্রায়ই ভোরে মোটর সাইকেল ও গাড়িযোগে এসে পাখি শিকার করেন। প্রভাবশালী হওয়ায় কেউই তাদেরকে কিছুই বলতে পারেননা। পর্যাপ্ত অভায়শ্রম না থাকা, নিয়মিত পাখি শিকারিদের বিরুদ্ধে অভিযান এবং হাওর উন্নয়নে নিয়োজিত বেসরকারি সংস্থা ও প্রশাসনের সমন্বয়হীনতার অভাবে পাখি শিকারিদের দৌরাত্ম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে অভিমত ব্যক্ত করেন হাওর তীরবর্তী এলাকার সচেতনমহল।

হাওর উন্নয়নে নিয়োজিত বেসরকারি সংস্থা ‘সিএনআরএস’ ক্রেল প্রকল্প কর্মকর্তা তৌহিদুর রহমান বলেন, আমাদের অধীনে ৫টিসহ মোট ১২টি অভয়াশ্রম রয়েছে। এবছর শিকারীদের বিরুদ্ধে কোন অভিযান হয়নি। আমরা প্রশাসনের কাছে শিকারীদের তথ্য দিয়ে থাকি। তাদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগের ক্ষমতা নেই আমাদের। শুধুমাত্র প্রশাসনই আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।

এ ব্যাপারে মৌলভীবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) প্রকাশ কান্তি চৌধুরী মোবাইলে বলেন, সর্বশেষ জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় হাকালুকি হাওরে অবৈধ ভাবে পাখি শিকারীদের তৎপরতা বন্ধের জন্য স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

 

আপনার মন্তব্য

আলোচিত