নিজস্ব প্রতিবেদক

১০ ডিসেম্বর, ২০১৭ ০০:৫৩

শীতলপাটির দুর্দিনে আশার আলো

ইউনেস্কোর স্বীকৃতি উপলক্ষ্যে মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার বিলপাড় গ্রামের শীতলপাটির প্রবীণ কারিগর খিতেশ রঞ্জন দাশ বর্তমানে দক্ষিণ কোরিয়া অবস্থান করছেন। ইউনেস্কোর অধিবেশনে যোগ দিতে গত সপ্তাহে সরকারের পক্ষ থেকে কোরিয়া পাঠানো হয়েছে এই শীতলপাটি শিল্পীকে।

অথচ খিতেশ রঞ্জনের ছেলে কানাইলাল দাসের কণ্ঠেই আক্ষেপ। তিনিও শীতলপাটি তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। এটিই তাদের কয়েক পুরুষের পেশা। শুক্রবার কানাইলাল দাস আক্ষেপ করে বলেন, এবার বোধহয় পেশাটা পরিবর্তন করতে হবে। পাটি তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ অসম্ভব।

তিনি বলেন, শীতলপাটির প্রধান উপাদান মুর্তা নামের একবীজপত্রী উদ্ভিদের ছাল। যা ‘মূর্তা বেত’ নামে পরিচিত। বনায়ন ধংস হওয়ার ফলে এই বেত এখন পাওয়াই যায় না। কিছু পাওয়া গেলেও দাম অনেক বেশি। একটি পাটির জন্য ৭ থেকে ৮শ’ টাকার বেত ও রং প্রয়োজন। আর সময় লাগে প্রায় ১৫ দিন। অথচ একটি পাটি বিক্রি করে পাওয়া যায় ১২ থেকে ১৩শ’ টাকা। ফলে শীতলপাটি তৈরি করে লাভের বদলে লোকসান গুণতে হয়।

কানাইলাল দাস তবু পেশা পরিবর্তনের চিন্তা করছেন। তবে এই পেশায় জড়িত থাকা অনেকেই ইতোমধ্যে খোঁজে নিয়েছেন অন্য জীবীকা।

শীতলপাটি তৈরি জন্য বিখ্যাত ছিলো সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলার গৌরিপুর। প্রায় প্রতিঘরেই কেউ না কেউ শীতলপাটি তৈরি করতেন। অথচ এই গৌারিপুরের কেউই এখন শীতলপাটি তৈরি করেন না।

আগে শীতলপাটি তৈরি করা এই গ্রামের কারিগর রাসিন্দ্র বর্ধন এখন কৃষিকাজ করেন। তিনি বলেন, প্লাস্টিকের পাটি আশার পর এখন কেউ আর শীতলপাটি কেনে না। তাছাড়া মূর্তা বেতও পাওয়া যায় না।  ফলে শীতলপাটি তৈরির কাজ বছর পাঁচেক আগেই ছেড়ে দিয়েছেন তিনি। তাঁর মতো অনেকেই বাধ্য হয়ে এ পেশা ছেড়ে দিয়েছেন বলে জানান রাসিন্দ্র।

তবে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা সেইভ দ্যা হেরিটেজ এন্ড এনভায়রনমেন্টের প্রধান সম্বনয়কারী আব্দুল হাই আল হাদী মনে করেন, যেসব জলমহাল বেদখল আছে সেগুলো উদ্ধার করে মুর্তা চাষ বাড়িয়ে, শীতলপাটির কারিগরদের প্রশিক্ষণ প্রদান করে দক্ষতা বাড়িয়ে এবং তাদের পর্যাপ্ত মজুরি নিশ্চিত করার মাধ্যমে শীতলপাটির সুদিন ফিরিয়ে আনে সম্ভব। তিনি বলেন, এমনটি করা গেলে এই ঐতিহ্যবাহী পণ্য দেশের বাইরেও রপ্তানি করা সম্ভব।

বুধবার শীতলপাটিকে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেস্কো। সিলেটের ঐতিহ্যবাহী বয়নশিল্প এক সময় ব্যবসায়িকভাবেও সাফল্য এনেছিলো। শীতলপাটি তৈরির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন সিলেট ও মৌলভীবাজারের বিভিন্ন উপজেলার প্রায় ছয় হাজার লোক। তবে কাঁচামালের দুস্প্রাপ্যতা, উপযুক্ত মূল্য না পাওয়া, প্লাস্টিকের প্রভাবসহ নানা কারণে শীতলপাটি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন কারিগররা। গত দশবছরে বেশিরভাগ কারিগরই এ পেশা পরিবর্তন করে নিয়েছেন। বর্তমানে দুই জেলায় হাজারখানেক লোকও পাটি তৈরির সাথে সম্পৃক্ত নেই।

শীতপাটির এমন দুর্দিনে এলো ইউনিস্কের বিশ্ব স্বীকৃতি। এই স্বীকৃতিতে খুশি কারিগররা। আশা করছেন আবার ফিরবে সুদিন।

রাজনগরের তুলাপুর গ্রামের কারিগর মনোরঞ্জন দাস বলেন, শীতলপাটির ক্রেতা এখন নেই বললেই চলে। জাতীয় যাদুঘরসহ কিছু সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান মেলার ও প্রদর্শণীর জন্য শীথলপাটি কিনে নেয়। এরাই এখন আমাদের বড় ক্রেতা। ইউনিস্কের স্বৃকীতির ফলে আশা করছি শীতলপাটির প্রতি মানুষের আগ্রহ আরও বাড়বে।

জানা যায়, সিলেটের বালাগঞ্জ, বিশ্বনাথ, বিয়ানীবাজার, জৈন্তাপুর উপজেলা, মৌলভীবাজারের চুনারুঘাট উপজেলা ও সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলা শীতল পাটির জন্য বিখ্যাত।

শীতল পাটিকে বলা হতো সিলেটের মসলিন। বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান শীতল পাটি সম্পর্কে বলেছিলেন, আমাদের সংস্কৃতিতে বাঙ্গালিরা যতগুলো অবদান রেখেছে শীতল পাটি সেসবের মধ্যে একটি সময়োত্তীর্ন নিদর্শন।

গ্রামের কারিগরদের মতো ভালো নেই নগরের শীতলপাটির ব্যবসায়ীরাও। নগরীর তোপখানা, মহাজনপট্টি, দরগাহ গেইটসহ কয়েকটি এলাকায় শীতলপাটি বিক্রি হয়।
দরগাহ গেইট এলাকার মুন্নি কুঠির শিল্পের সত্ত্বাধিকারী আব্দুল কাইয়ুম রেনু বলেন, শীতলপাটির ক্রেতা মূলত কিছুসংখ্যক সৌখিন মানুষজন ও কিছু পর্যটক। দাম কম ও টেকসই সাধারণ ক্রেতারা এখন শীতল পাটির পরিবর্তে প্লাস্টিকের পাটিই ব্যবহার করেন। ফলে আরো কয়েক বছর পর আমাদের এই ব্যবসা ছাড়তে হবে।

তোপখানা এলাকার ব্যবসায়ী জহির মিয়া বলেন, এখন সিলেটের বাজারে যে শীতলপাটিগুলো পাওয়া যায় তা বরিশাল, রাজশাহী ও সিরাজগঞ্জ থেকে আনা। মূর্তার অভাবে সিলেটে চাহিদামত পাটি পাওয়া যায় না। তাছাড়া সিলেটের পাটির দামও বেশি। ফলে ক্রেতাদের আগ্রহ কম।

তিনি বলেন, সিলেটের শীতলপাটি ১১০০ থেকে ৩ হাজার টাকায় বিক্রি হয় আর অন্যান্য অঞ্চলের পাটি বিক্রি হয় ৯শ’ থেকে ২ হাজার টাকায়।

জানা যায়, শীতল পাটি তৈরির প্রধান উপকরণ মুর্তা বেত। আগে বাড়ির পাশের স্যাঁতস্যাঁতে জায়গা, জঙ্গল, অনাবাদী জমিতে হরহামেশাই পাওয়া যেতো এই মুর্তা গাছ। অপিরকল্পিত নগরায়ন, আবাসন, বন-জঙ্গল সাফ করে ফেলার ফলে বর্তমানে এই মুক্তা গাছ দু¯প্রাপ্য হয়ে গেছে। আশির দশকে সরকার মুর্তা গাছ উৎপাদনের জন্য সিলেটের কৃষকদের ঋণ দেওয়ার কথা বললেও পরবর্তীতে তা আর বাস্তবায়িত হয় নি। ১৯৮৫ সালে সিলেটের বিয়ানীবাজারে বেসরকারী উদ্যোগে বাণিজ্যিক লাভের আশায় মূর্তার চাষ শুরু হলেও দু-তিন বছর পর তা মুখ থুবড়ে পড়ে।

তবে সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এসএম মনিরুল ইসলাম বলেন, আমাদের একশ’টির মতো মূর্তামহাল রয়েছে। এগুলো দুই বছর মেয়দে লিজ দেওয়া হয়। নতুন নতুন জমিতে মুর্তা চাষও করা হচ্ছে। সম্প্রতি রাতারগুলের বেদখলকৃত জমি উদ্ধার করে মুর্তা চাষ করা হচ্ছে। এছাড়া বনবিভাগের জলাভ’মি শ্রেণীর ১৫০০ হেক্টর জমিতে মূর্তা চাষ করার জন্য ১৭০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প ঢাকা অফিসে পাঠানো হয়েছে। এটি অনুমোদন পেলে মূর্তার সঙ্কট আর থাকবে না।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত