রিপন দে

১৮ মে, ২০১৮ ০০:১৬

হুমকির মুখে হাকালুকির জীববৈচিত্র্য

ছবি: সুলতান মাহমুদ

বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ হাওর হিসেবে পরিচিত সিলেট বিভাগের হাকালুকির হাওর। এ হাওরটির একটি অংশ সিলেট জেলায় ও আরেকটি অংশ মৌলভীবাজার জেলায় বিস্তৃত। অন্যদিকে বাংলাদেশের প্রধান চারটি 'মাদার ফিসারিজ'র মধ্যে হাকালুকি হাওর অন্যতম। এছাড়া এ হাওরের বুকে বেশ কিছু জায়গাজুড়ে রয়েছে জলজ উদ্ভিদ হিজল, করচ ও বরুণগাছের বন। এরই সাথে সেখানে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের বন্য প্রাণীর আবাসও।

অথচ স্থানীয় কিছু সুবিধাভোগী লোকজনের লোভের ফলে ক্রমশ হুমকির মুখে পড়েছে হাওরের মধ্যে থাকা বনের জীববৈচিত্র্য। স্থানীয়রা এরই মধ্যে বনের একাংশের গাছপালা কেটে  করছে সরিষার আবাদ। এছাড়া সঠিক পরিকল্পনার অভাব এবং গরু-মহিষের অবাধ বিচরণও হাওরের জীববৈচিত্র ধ্বংসের অন্যতম আরেকটি কারণ।

বন বিভাগ ও মৎস্য কার্যালয়ের সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ হাওর এ হাকালুকি হাওর। ভৌগলিক ভাবে উত্তরে ভারতের মেঘালয় পাহাড়, পূর্বে ভারতের আসাম ও মনিপুর পাহাড় এবং দক্ষিণে ত্রিপুরা ও মিজোরাম পাহাড়ের পাদদেশে। ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের কারণে উজানে প্রচুর পাহাড় থাকায়, পাহাড়ি ঢলে প্রতি বছরই হাকালুকি হাওর প্লাবিত হয়। এসময় ছোট, মাঝারি ও বড় ২৭৬ টি বিল পানিতে পরিপূর্ণ হয়ে একটি বিশাল জলরাশিতে পরিণত হয়।

এই সময় বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ এই হাওরের আয়তন দাঁড়ায় প্রায় ১৮,১১৫ হেক্টর, আর শুষ্ক মৌসুমে (পানি শুকিয়ে গেলে) শুধুমাত্র বিলের আয়তন হয় প্রায় ৪,৯২৫ হেক্টর। হাকালুকি হাওর বৃহত্তর মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা (৪০%), কুলাউড়া ও জুড়ী (৩০%) এবং বৃহত্তর সিলেট জেলার ফেঞ্চুগঞ্জ (১৫%), গোলাপগঞ্জ (১০%) এবং বিয়ানীবাজার (৫%) অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত।

এই হাওরাঞ্চলকে ঘিরে প্রায় ১,৯০,০০০ মানুষের বাস। হাকালুকি হাওরের মৎস্য সম্পদ অত্যন্ত সমৃদ্ধ। বাংলাদেশের প্রধান চারটি “মাদার ফিসারিজ” এর মধ্যে হাকালুকি হাওর অন্যতম।

বিশাল এই হাওরের জলজ জীববৈচিত্রের ব্যাপারে জানতে হাওর পাড়ের স্থানীয়দের সাথে আলাপকালে তারা জানান, বিভিন্নভাবে এই বনকে ধ্বংস করা হচ্ছে। বনের বড় বড় গাছগুলো কেটে নিয়ে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহারসহ অন্যান্য কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে, কিন্তু বন বিভাগের কোন লোক তা দেখাশুনা করে না। আর যদিও বা দেখেন বলেন না কোন কথা।

তারা বলেন, এরই মধ্যে দুর্বৃত্তরা বনের ২০-২৫ একর জায়গার গাছপালা কেটে ফেলেছে। এমনকি গাছের শেকড়ও উপড়ে ফেলা হয়েছে। ফাঁকা হওয়া কিছু জায়গায় সরিষার বীজ রোপণ করা হয়েছে।

এ ব্যাপারে বনের পাহারাদার মাতাব উদ্দিন ও মখলিছ আলী জানান, গাছ কাটার সময় তারা বাধা দিলে দুর্বৃত্তরা তাদেরকে বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে। তবে সেখানে পুলিশ যাওয়ার পর থেকে গাছ কাটা আপাতত বন্ধ আছে বলেও জানান তিনি। কাটা গাছগুলো কোথায় যাচ্ছে জানতে চাইলে তারা বলেন, দুর্বৃত্তরা ও স্থানীয়রা গাছগুলো কেটে জ্বালানির জন্য নিয়ে যায়।

এদিকে হাওর পাড়ের স্থানীয়রে জানান বনের গাছপালা বর্ষায় হাওরের ঢেউ ঠেকায় যার ফলে তীরবর্তী বাড়িঘর-রাস্তাঘাট রক্ষা পায়। বর্ষা মৌসুমে মাছের খাদ্য ও আবাসস্থল হয়, বনের ভেতরে বন্য প্রাণী ও পাখি আশ্রয় নিয়ে থাকে।

বিভিন্ন মাছের খাবার এই জলজ উদ্ভিদ। মিঠা পানির সকল প্রজাতির ছোট-বড় সুস্বাদু মাছ, অতিথি ও দেশীয় পাখি, নানা প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ, গুল্মলতা, নলখাগড়া ইত্যাদিতে ভরপুর ছিল হাকালুকি হাওর। পাওয়া যেত নানা জাতের ঔষধি লতাপাতা। বর্তমানে এ সব কিছুই ইতিহাসের কাতারে নাম লেখাচ্ছে।

সরেজমিনে সেখানে গিয়ে দেখা গেছে, বনের ভিতরে রয়ে যাওয়া গাছগুলো প্রায় ছয়-সাত ফুট উচ্চতার হবে। এর মধ্যে ২০-২৫ একর জায়গা গাছপালাশূন্য। সেখানে মাটি খুঁড়ে গাছের শেকড় উপড়ে ফেলা হয়েছে। ফাঁকা হওয়া কিছু জায়গায় সরিষার বীজ রোপণ করা হয়েছে।

হাকালুকি হাওর পাড়ের প্রবীণ লোকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, এক সময় নানা প্রজাতির জলীয় উদ্ভিদ ও গুল্মলতায় ভরাট প্রতিটি বিল। শীতকালে প্রতিটি বিল সিংরা, (স্থানীয় ভাবে যাকে ‘হিংগাইর’ বলা হয়), পানি ফল (অর্থাৎ উফল), এরালী, শেওলা ইত্যাদি নানা প্রজাতির গুল্মলতায় ভরপুর থাকত।

এ ব্যাপারে হাওরের সাথে সম্পৃক্ত পরিবেশ কর্মী কবির আহমদ জানান, এরই মধ্যে গাছ কাটার বিষয়টি প্রশাসন, বন বিভাগ ও পুলিশের কর্মকর্তা বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। তাদের জানানোর পরও কেউ রক্ষায় এগিয়ে আসছেন না। তিনি বলেন গোপনে গাছ কাটা ও বনের ভিতর গরু মহিষের অবাধ বিচরণে এখন বন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।

তিনি জানান আমরা অভিযোগে উল্লেখ করেছি, ১৯৯৯ সালে সরকার হাকালুকি হাওরকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ বা ইকোলজিক্যালি ক্রিটিক্যাল এরিয়া) ঘোষণা করে। হাওরের বড়লেখার ইসলামপুর মৌজায় ১ নম্বর সরকারি খাসখতিয়ানভুক্ত ৪০০৩ ও ৪০১৫ নম্বর দাগে (জেএল নম্বর-৯০) ১৫০ একর এবং হাকালুকি মৌজায় ১ নম্বর খাসখতিয়ানভুক্ত ১ নম্বর দাগে (জেএল নম্বর ৮৯) ১০০ একর জায়গায় হিজল, করচ ও বরুণের বন বিস্তৃত।

এসব জায়গা সাতবিলা ও ফোয়ালা বিলের পাড়ে পড়েছে। স্থানীয় হাকালুকি জগরণী ও বোরোদল ইসিএ বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেড এ বনটি দেখভাল করে। বন পাহারায় চারজন নিয়োজিত আছেন। গত নভেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে স্থানীয় কিছু লোক বনের একাংশের গাছপালা কাটা শুরু করেন।

পাহারাদারেরা বাধা দিলেও তাঁরা শোনেননি। এ অবস্থায় বোরোদল সমিতির সভাপতি নজীব আলী ৬ ডিসেম্বর বড়লেখার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের মৌলভীবাজারের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ও বড়লেখা থানার ওসি বরাবর লিখিত অভিযোগ দেন। অভিযোগে বড়লেখার বর্ণী ইউনিয়নের কাজীরবন্দ গ্রামের মসাইদ আলী, সুরুজ আলী, মন্তাজ আলী ও লোকমান আলী বনের গাছ কাটছেন বলে উল্লেখ করা হয়।

সদ্য বদলি হওয়া সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ) মিহির কুমার দো জানান, এক জন বন রক্ষী দিয়ে গরু মহিষের অবাধ বিচরণ রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না পাশাপাশি এই বিশাল হাওরের গাছ কর্তনও বন্ধ করা যাচ্ছে না, এর জন্য সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।

এছাড়া হাওরের জীববৈচিত্র রক্ষার জন্য বন বিভাগ কাজ করছে জানিয়ে বলেন আরো কিছু বনভূমি সৃষ্টির জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রকল্প প্রস্তাব প্রেরণ করা হয়েছে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত