শাকিলা ববি

২৬ ফেব্রুয়ারি , ২০১৯ ০০:২৭

অবৈধ গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবসায় সয়লাব সিলেট, দুর্ঘটনার আশঙ্কা

বিস্ফোরক পরিদপ্তরের লাইসেন্স নেই বেশিরভাগ ব্যবসায়ীর

গাস সংযোগ বন্ধ থাকায় নগরজীবনে বেড়েছে সিলিন্ডার গ্যাসের চাহিদা। এই চাহিদাকে পুঁজি করে নগরীতে গজিয়ে ওঠেছে গ্যাস সিলিন্ডারের ব্যবসা।

গাস সংযোগ বন্ধ থাকায় নগরজীবনে বেড়েছে সিলিন্ডার গ্যাসের চাহিদা। এই চাহিদাকে পুঁজি করে নগরীতে গজিয়ে ওঠেছে গ্যাস সিলিন্ডারের ব্যবসা।

অনেক আবাসিক এলাকায়ও সিলিন্ডারের দোকান খুলে বসেছেন ব্যবসায়ীরা। অনুমোদন ছাড়াই ঝুঁকিপূর্ণভাবে গ্যাস সিলিন্ডারের দোকান খুলে বসায় বাড়ছে ঝুঁকি। সম্প্রতি রাজধানীর চকবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের পর ঝুঁকিপূর্ণভাবে সিলিন্ডার বিক্রির বিষয়টি ফের আলোচনায় ওঠে এসেছে।

চকবাজারের এই অগ্নিকান্ডে প্রাণ হারান ৭০ জন। দদ্ধ হন আরও অনেকে। এই অগ্নিকান্ডের সুনির্দিষ্ট কারণ এখেনা জানা না গেলেও গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে আগুণের সূত্রপাত হতে পারে বলে অনেকের মত।

এদিকে, সিলেট নগরের পান দোকান, মুদি দোকান, ওষুধের দোকান, লন্ড্রির দোকান, সিমেন্ট বিক্রির দোকান, কসমেটিকের দোকান, লাইব্রেরিসহ ফুটপাতের ছোটখাটো দোকানেও অবাদে গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছে। প্রতিটি দোকানেই অন্যান্য জিনিসপত্রের পাশাপাশি ৫ থেকে ২০টি সিলিন্ডার রাখা হয় বিক্রি জন্য।

সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী, জ্বালানি কাজে ব্যবহার্য সিলিন্ডার গ্যাস কোনো আবাসিক এলাকা বা মার্কেটে বিক্রি করা নিষিদ্ধ। গ্যাস সিলিন্ডার রোদে না রাখা, নিরাপদ দূরত্বে সিলিন্ডার মজুদ করা, উপড় থেকে সিলিন্ডার নিচে না ফেলার নির্দেশনাও রয়েছে। এছাড়াও এই সিলিন্ডার বিক্রি করতে গেলে ট্রেড লাইসেন্স ছাড়াও বিস্ফোরক পরিদপ্তরের লাইসেন্স ও অগ্নিনির্বাপক কর্তৃপক্ষের ছাড়পত্র নিতে হয়।

তবে এসব নিদের্শনা আর নিষেধাজ্ঞা মানছেন না সিলেটের ব্যবসায়ীরা।

সরজমিনে দেখা যায়, সিলেট নগরে সিলিন্ডার বিক্রি ও ব্যবহার কোনো ক্ষেত্রে কোনো বিধিনিষেধই মানা হচ্ছে না। কোনো নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা ও লাইসেন্স ছাড়াই সিলেট নগরে বানিজ্যিক এলাকার পাশাপাশি আবাসিক এলাগুলোতেও ঝুঁকি নিয়ে চলছে সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবসা। নগরের বন্দরবাজার, মহাজনপট্টি, দক্ষিনসুরমা, সুবহানিঘাট এলাকায় প্রখর রোদে ফুটপাতে মজুদ করে গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা। এসব এলাকার সিলিন্ডার ব্যবসায়ীদের মধ্যে বেশিরভাগের নেই বিস্ফোরক পরিদপ্তরের লাইসেন্স ও অগ্নিনির্বাপক কর্তৃপক্ষের ছাড়পত্র। যাদের ছাড়পত্র ও লাইসেন্স আছে তারাও নিয়ম মেনে ব্যবসা করছেন না।

সিলেট বিস্ফোরক পরিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সিলেট জেলায় ৪৮৭ টি প্রতিষ্ঠানের নামে বিস্ফোরক লাইসেন্স নেওয়া আছে। এর মধ্যে প্রায় ৩০টি লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে অ্যামোনিয়া গ্যাসের এবং ৪০টির অধিক প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। সিলেট বিস্ফোরক পরিদপ্তর থেকে ৪০টি সিলিন্ডারের কম ব্যবসাকারী কোনো ব্যবসায়ীকে অনুমোদন দেওয়া হয় না।

তবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলছে, সারা জেলায় যে পরিমান অনুমোদন দেওয়া হয়েছে এর চেয়ে বেশি গ্যাস সিলিন্ডারের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সিলেট নগরেই রয়েছে। অবৈধ ব্যবসায়িদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর নির্দেশনা থাকলেও জনবল সংকটের কারনে অভিযান পরিচালনা করতে পারছেন না বলে জানান সিলেট বিস্ফোরক পরিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

নগরের মহাজনপট্টির ইকবাল চুলা ঘরের প্রোপাইটর মো. নুরুল ইসলাম খাঁন বলেন, ‘বিস্ফোরক পরিদপ্তরের লাইসেন্স নিয়েই ব্যবসা করছি তবে এই এলাকায় অসংখ্য ব্যবসায়ী আছেন যারা বিস্ফোরক লাইসেন্স ছাড়াই ব্যবসা করছেন। এটা ব্যাপক লাভজনক ব্যবসা। একটি সিলিন্ডার বিক্রি করলে ১০০ টাকা লাভ হয় তাই সবাই এই ব্যবসা করছে। তাছাড়া এই সিলিন্ডার ব্যবসায় সরকার বড় অঙ্কের ট্যাক্স নিচ্ছে। বিক্রেতা ও সরকার দুপক্ষই সুবিধাভোগ করছে এই ব্যবসা করে। যে জন্য যত্রতত্র সিলিন্ডার ব্যবসা নিয়ে কেউ কোনো কথা বলে না।’

মহাজনপট্টির আরেক ব্যবসায়ী বিসমিল্লাহ চুলাঘরের প্রোপাইটর মোস্তফা কামাল বলেন, ‘অবৈধ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের অভিযান পরিচালনা করা উচিত এবং ডিলারদেরও উচিত নিয়ম মেনে সিলিন্ডার সরবরাহ করা।’

সিলেট ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অফিস সূত্রে জানা যায়, গ্যাস সিলিন্ডার পরিবেশকদের বেশিরভাগ ফায়ার সার্ভিসের লাইসেন্স নিয়েছেন। পাইকারি ব্যবসায়ীদের মধ্যে অধিকাংশই লাইসেন্স নেননি।

এ ব্যাপারে সিলেট ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অফিসের সহকারী পরিচালক তন্ময় বিশ্বাস বলেন, ‘অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রপাতি এবং সরঞ্জামাদি ছাড়া গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবসা করা অনেক বিপদজনক। গ্যাস সিলিন্ডার ডিলাররা ফায়ার সার্ভিসের লাইসেন্স নিয়ে ব্যবসা করলেও খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা শুধুমাত্র ট্রেড লাইসেন্স দিয়েই ব্যবসা করছেন।
 
বিস্ফোরক আইন ১৮৮৪-এর বিধির ৭১নং ধারায় বলা আছে, আগুন নেভানোর জন্য স্থাপনা বা মজুদাগারে যথেষ্ট পরিমাণে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রপাতি এবং সরঞ্জাম মজুদ রাখতে হবে। এ আইন অমান্য করলে ওই ব্যবসায়ী ন্যূনতম দু’বছর এবং অনধিক পাঁচ বছরের জেল এবং অনধিক ৫০ হাজার টাকার অর্থদন্ডে-দন্ডিত হবেন এবং অর্থ অনাদায়ী থাকলে অতিরিক্ত আরো ছয় মাস পর্যন্ত কারাদন্ডের বিধান রয়েছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেট শাখার সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম বলেন, ‘বাংলাদেশের মত অধিক জনসংখ্যার দেশে অগ্নিকান্ডে ব্যাপক প্রাণহানীর ঘটনা ঘটে। এর জন্য আমাদের দাহ্য পদার্থ ব্যাবহারের অবাধ স্বাধীনতা দায়ী। সিলেটে যত্রতত্র গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রির জন্য মজুত করে রাখা হয়। আবাসিক এলাকায় গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি করা হচ্ছে। এমনও দেখেছি ওয়েল্ডিং কারখানা, খাবার হোটেলের পাশে গ্যাস সিলিন্ডার মজুত করে রাখা। এসব দেখতে বেশি দূর যাওয়া লাগে না। মহাজনপট্টি এলাকায় গেলেই দেখা যায় হোটেলের বাইরে রান্না হচ্ছে আর দুই পাশে দুই দোকানের সিলিন্ডার মজুদ করা আছে। বড় ধরনের কোনো দুর্ঘটনা ঘটার আগে অনুমোদন ছাড়া নিয়মনীতিহিন এসব গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রয় কেন্দ্র অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।’

ঝুঁকিপূর্ণ সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবসায় উদ্বেগ প্রকাশ করে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এর সভাপতি, ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘সিলেটে পাড়া মহল্লায় গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছে। এটা অনেক বিপদজনক। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি অবশ্যই ব্যবসায়ী ও সাধারণ জনগনকে সতর্ক হতে হবে। ব্যবসায়ীদের মনিটরিংয়ের জন্য বিস্ফোরক পরিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিসসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। কারণ একটি ছোট দূর্ঘটনাকে অনেক বড় করে দিতে পারে রাস্তার পাশে মজুদ করে বিক্রি করা সিলিন্ডার। এক্ষেত্রে অবশ্যই নিয়ম মেনে নিরাপদ দূরত্বে গ্যাস সিলিন্ডার মজুদ ও ব্যবসা করা দরকার।’

গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি জনসাধারনকে সিলিন্ডার ব্যবহারে সতর্ক থাকার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘শুধু ব্যবসায়ীদের নয় সিলিন্ডার ব্যবহারকারীদেরও সতর্ক হতে হবে। রাস্তার পাশে চা, সিগারেটের টং দোকানেও সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার হচ্ছে। যততত্র সিলিন্ডার ব্যবহাকারীদেরও নিয়ন্ত্রনে আনতে হবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে।’

এ ব্যাপারে সিলেট বিস্ফোরক পরিদপ্তরের সহকারী বিস্ফোরক পরিদর্শক মো. আলীম উদ্দিন বলেন, ‘বিস্ফোরক লাইসেন্স ১ বছরের মেয়াদে দেওয়া হয়। প্রতি বছর এই লাইসেন্স নবায়ন করতে হয়। সিলেটে অনেক ব্যসায়িরাই বিস্ফোরক লাইসেন্স ছাড়া সিলিন্ডার গ্যাসের ব্যবসা করছেন। অনেকেই লাইসেন্স নবায়ন ছাড়াই ব্যবসা করছেন। এসব অপরাধের জন্য দন্ডের বিধানও আছে। এসবের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করারও নিদের্শনা আছে আমাদের কিন্তু জনবল সংকটের কারণে আমরা অভিযান পরিচালনা করতে পারছি না।’

তিনি বলেন, ‘এই পদে আমি দুই মাস হল জয়েন করেছি। আমাদের প্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শক ঢাকায় কর্মরত আছেন এবং সিলেটে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন। ২০১৮ সাল পর্যন্ত সারা বাংলাদেশে মাত্র ৬ জন কর্মকর্তা দায়িত্বে ছিলেন। এবার আরো ৭ জন নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, ‘মূলত জনবল সংকটের কারনে বেশিরভাগ সময় মাঠ পর্যায়ে পরিদর্শনেও যেতে পারি না। এসব বিষয়ে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করা হয়েছে। সিলেটের অবৈধ ব্যবসায়ী ও যারা নিয়ম মেনে ব্যবসা করছেন না তাদের জন্য শীঘ্রই অভিযান পরিচালনা করা হবে।’

এ ব্যাপারে সিলেটের জেলা প্রশাসক এম কাজী এমদাদুল ইসলাম বলেন, ‘যততত্র সিলিন্ডার গ্যাস বিক্রি করা অনেক বিপদজনক। এই কারণে যে কোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এই সমস্যা নিয়ে গত শনিবার সিলেট বিস্ফোরক পরিদপ্তরের পরিচালকের সাথে কথা হয়েছে। তিনি ঢাকা ও সিলেটের দায়িত্বে আছেন তাই তিনি বর্তমানে ঢাকায় অবস্থান করছেন। এ সপ্তাহে তিনি আসলেই অবৈধ সিলিন্ডার ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হবে।

তিনি বলেন, কে বৈধ কে অবৈধ ব্যবসায়ী এর তালিকা বিস্ফোরক পরিদপ্তরের কাছে আছে। তাছাড়া সিলিন্ডার ব্যবসায়ের নিয়মনীতি সর্ম্পকেও তারা অবগত আছে। তাই তাদের সাথে নিয়েই অভিযান পরিচালনা করতে চাই।’

আপনার মন্তব্য

আলোচিত