বড়লেখা প্রতিনিধি

৩১ আগস্ট, ২০১৯ ২০:০৪

বড়লেখা সীমান্তে বাড়ছে চোরাচালান

১ মাসে বিএসএফের গুলিতে আহত ২০, নিহত ১

মৌলভীবাজারের বড়লেখা সীমান্ত দিয়ে চোরাইপথে প্রতিদিনই বিপুল সংখ্যক ভারতীয় মহিষ, গরু, মোটর সাইকেল, মদ, ইয়াবা, হরলিক্স, সিগারেটসহ বিভিন্ন পণ্য আসছে। বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কাগজপত্র তৈরি করে দেশের অন্যান্য জেলায় এগুলো চালান করা হয়। মাঝে মধ্যে কিছু ধরা পড়লেও বেশিরভাগই বাজারজাত হয়। প্রতিনিয়ত বড়লেখা সীমান্তে বাড়ছে চোরাচালান।   

এদিকে বড়লেখা সীমান্তে চোরাচালান করতে গিয়ে আগস্ট মাসে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিএসএফের গুলিতে ২০জন আহত ও আব্দুর রূপ নামে একজন নিহত হয়েছেন। নিহত ব্যক্তি শরফ উদ্দিন নামে এক ব্যবসায়ীর মহিষ আনতে ভারতে গিয়ে বিএসএফের গুলিতে মারা যান বলে জানা গেছে।

সীমান্ত দিয়ে অবাধে মহিষ ও চোরাই পণ্য প্রবেশের ঘটনায় সম্প্রতি বড়লেখায় জেলা প্রশাসকের সাথে মতবিনিময় সভায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা উদ্বেগ প্রকাশ করে তা বন্ধের দাবি জানিয়েছেন। বক্তারা এসব ঘটনায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবির) দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ তোলেন।  

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বড়লেখা উপজেলার দক্ষিণ শাহবাজপুর, সদর ও উত্তর শাহবাজপুর ইউনিয়নের সীমান্ত এলাকা দিয়ে মহিষ, গরু, মোটর সাইকেল, মদ, ইয়াবা, হরলিক্স, সিগারেটসহ বিভিন্ন ভারতীয় পণ্য চোরাই পথে ঢুকছে। কেউ নগদ টাকা আবার কেউ পণ্যের বিনিময়ে মালামাল আনেন। পণ্যের মধ্যে রয়েছে স্বর্ণ।

মহিষ ও গরু অবৈধ পথে দেশে প্রবেশের পর আইনি ঝামেলা এড়াতে এগুলো বৈধ করার জন্য বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় তৈরি করা হয় কাগজ। পরে দেশের অন্যান্য জেলার ব্যবসায়ীদের কাছে এগুলো বিক্রি করা হয়। অবৈধ মহিষ বৈধ করার প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত উপজেলার একটি ইউনিয়ন এলাকার বাজারের দুজন ইজারাদার।

সীমান্তবর্তী এলাকার লোকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ভারতে যারা পণ্য আনতে ঢুকে তাদের স্থানীয় ভাষায় দৌঁড়াল (সোর্স) বলে। এরা টাকার বিনিময়ে জীবনের ঝুঁকি নেয়। এদের কেউ কেউ ধরা পড়ে আহত হয়। কেউ গুলিতে মারা যায়। কিন্তু যারা নেপথ্যে টাকা বিনিয়োগ করে তারা থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে।

রাত ১২টা থেকে ভোররাতের মধ্যে চোরাই পথে এসব মালামাল আনা হয়। প্রতি রাতে ওপারের ব্যবসায়ীর সাথে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীর মুঠোফোনে আলোচনা মাধ্যমে শুরু হয় মালামাল আনার প্রক্রিয়া। এরপর পণ্য আনার জন্য ব্যবসায়ীর বিশ্বস্ত দৌঁড়াল লোকজন যোগাড় করে সীমান্তের দিকে রওয়ানা দেয়। সীমান্তে বাংলাদেশী সিমের নেটওয়ার্ক থাকে না। তাই যোগাযোগের জন্য দৌঁড়াল ভারতীয় সীম ব্যবহার করে। সেখানে পৌঁছে দুদেশের দৌঁড়াল মুঠোফোনে কথা বলে। সুবিধামত সময় হলেই শুরু হয় তার কাটার কাজ।

ব্রিজের নিচে অথবা দুর্গম এলাকায় তার কেটে মহিষ, গরু আনা হয়। মোটর সাইকেলের যন্ত্রাংশগুলো আলাদা আলাদা করে প্যাকেট করে আনা হয়। কোথাও ব্রিজের নিচ দিয়ে আবার, কোথাও পাইপ দিয়ে বের করে আনা হয়। ইয়াবা ও মদ আসে সোনাই নদী এলাকা দিয়ে নৌকা করে। দুই দেশের সীমান্তের মধ্যে নদীটি পড়েছে। হরলিক্স, ক্লাসিক সিগারেটসহ অন্যান্য পণ্যগুলোও এভাবে আসে।

এসব পণ্য আনা নেওয়াকে কেন্দ্র করে আবার দৌঁড়াল বা সোর্সদের মাঝে প্রায়ই মারামারি ঘটনা ঘটে। এরকম একটি ঘটনায় ২০১৮ সালে রাতে খুন হন বোবারথল (পেকুছড়া) এলাকার আব্দুল মালিক বটল। চলতি বছরের ২৩ জুন এদেশের সোর্সরা  কুপিয়ে জখম করে ওপারের আব্দুল হাদী নামের আরেক সোর্সকে। এতে আতঙ্কের মধ্যে বসবাস করেন সীমান্ত এলাকার সাধারণ মানুষ।

মালামাল আনতে গিয়ে বিএসএফর গুলিতে আহতরা প্রকাশ্যে চিকিৎসা নেন না। যার কারণে তাদের নাম পাওয়া যায় না। এবার ২, ২১ ও ২৩ আগস্ট রাতে বিএসএফ সীমান্তে চোরাকারবারিদের উপর গুলি ছোঁড়ে। এতে ২০ জনের মত আহত হন। নিহত হন আব্দুর রূপ নামে একজন। নিহত ব্যক্তি শরফ উদ্দিন নামের একজনের মহিষ আনতে গিয়ে মারা যান। ২ আগস্টের গুলির ঘটনায় বিজিবি একজনকে আটক করে ১১ জনের নামে মামলা দিয়েছে।

এ ব্যাপারে বিয়ানীবাজার বিজিবি ৫২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল ফয়জুর রহমান বলেন, ‘বড়লেখা সীমান্ত এলাকাটি খুব দুর্গম। চোরাচালান রোধে বিজিবি সদস্যরা সার্বক্ষণিক তৎপর রয়েছে। পাহাড় ও অরণ্য বেষ্টিত এলাকা হওয়ায় অধিনায়ক, ঊর্ধ্বতন দপ্তর ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারি ও জবাবদিহিতা রয়েছে বিধায় দায়িত্ব পালনে বিজিবি সদস্যদের কোনো অবহেলা করার সুযোগ নেই।’

তিনি বলেন, ‘নিয়মিত পতাকা বৈঠক হচ্ছে বিএসএফের সাথে। দুর্ভাগ্যবশত বিএসএফের গুলিতে একজন মারা গেছে। আমরা দিনরাত টহল দিয়ে সবাইকে এরকম কাজ থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করছি। এলাকাগুলোতে জনসচেতনতামূলক বৈঠক করছি নিয়মিত। মেডিকেল ক্যাম্প করেছি। গবাদিপশু বিতরণ করা হয়েছে দরিদ্র নারীদের মাঝে। নানাভাবে তাদের বোঝানো হচ্ছে ঝুঁকি না নেওয়ার জন্য।’

আপনার মন্তব্য

আলোচিত