কমলগঞ্জ প্রতিনিধি

০৭ নভেম্বর, ২০১৯ ১৩:১৩

ধলাই নদীতে ঐতিহ্যবাহী ‘পলো বাওয়া’ উৎসব

কালের বিবর্তনে পাল্টে গেছে সবকিছু। কমে আসছে এক সময়কার চিরচেনা নদ-নদী, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড়ও। হারিয়ে যাচ্ছে একের পর এক বাঙালীর গ্রামীণ উৎসব-ঐতিহ্য। এরপরও একটি প্রবাদ আছে 'নদী, হাওর আর ধান এই তিনে মৌলভীবাজারের প্রাণ'। আর সেই মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার একটি নদীকে কেন্দ্র করে শত বছরেরও বেশি সময় ধরে পালিত হয়ে আসছে গ্রাম বাংলায় প্রায় হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যবাহী মাছ ধরা উৎসব।

এই মাছ ধরা উৎসব জানিয়ে দিচ্ছে মাছে-ভাতে বাঙালির দেশে মাছেরা হারিয়ে যায়নি। হারায়নি এক সময়ের বহুল প্রচলিত মাছ ধরার উৎসবও। পুরোদমে শুষ্ক মৌসুম শুরু না হলেও কমলগঞ্জ উপজেলার বুক দিয়ে প্রবাহিত ধলাই নদীসহ বিভিন্ন এলাকার প্রবাহমান ছোট ছোট ছড়া, বিলসহ বিভিন্ন জলাশয়ে শুরু হয়েছে পলো বাওয়া উৎসব।

প্রতিবছর এই সময়ে উপজেলার বিভিন্ন এলাকার সৌখিন মৎস্য শিকারিরা দল বেঁধে উৎসবমুখর পরিবেশে পলো বাওয়ায় অংশগ্রহণ করেন। পলো বাওয়া উৎসব হলো দল বেঁধে (বাঁশ দিয়ে বিশেষ ভাবে তৈরি ঝাঁপি) মাছ ধরা।

বৃহস্পতিবার (৭ নভেম্বর) সকাল সাড়ে ১০টায় ধলাই নদীতে এই মৎস্য আহরণ শুরু হয়। এতে প্রায় ৩ শতাধিক মানুষ অংশগ্রহণ করেন।

কমলগঞ্জ পৌর এলাকার দক্ষিণ কুমড়াকাপন, আলেপুর, চন্ডিপুর, কুমড়াকাপনসহ বিভিন্ন গ্রামের মানুষজন এতে অংশগ্রহণ করেন। কমলগঞ্জের খাল-বিল ও নদী নালার পানি কমতে শুরু করেছে। কমলগঞ্জের ফসলি মাঠগুলো এখনো হয়ে উঠেনি আবাদের উপযোগী। ফলে এ অঞ্চলের কৃষকের হাতে নেই তেমন কোন কাজ। এ অবসরে অল্প পানিতে মাছ শিকারের উৎসবে মেতে উঠেছে সবাই।

ধলাই নদীর স্বল্প পানিতে এখন বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে দল বেঁধে মাছ ধরার দৃশ্য চোখে পড়ার মতো। বিশেষ করে পলো, উড়াল জাল, পেলেন জাল এসব দিয়েই মাছ শিকার করছেন মানুষরা। দলবদ্ধভাবে মাছ শিকারের এ দৃশ্য দেখতে ভিড় জমাচ্ছেন উৎসুক জনতারা। উৎসবে অংশ নেয়া মানুষদের উৎসাহ দিতে হাতে তালি কিংবা জোড়ে জোড়ে চিৎকার করে উৎসাহ প্রদান করছেন দর্শনার্থীরা।

বড়দের পাশাপাশি ছোট ছোট ছেলে মেয়েরাও যে যার মতো করে মাছ ধরতে সহযোগিতা করছে। মাথা ও কোমরে আঁটসাঁট করে গামছা বেঁধে অনেকটা আনন্দ নিয়েই মাছ ধরছেন সবাই। শখের বসে মাছ ধরার উপকরণ নিয়ে নেমেছেন মাছ ধরতে। সকাল থেকে শুরু হয়েছে তাদের এই মাছ ধরা। দল বেঁধে সারিবদ্ধ হয়ে পলো দিয়ে পুটি, টেংরা, শৈল, রিটা ও বোয়াল মাছ ধরছেন।

পলো দিয়ে মাছ ধরার দৃশ্য সবারই মন কাড়ে। নদীর স্বল্প পানিতে ৩০-৪০জনের একটি দল একদিকে জাল নিয়ে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। আর অপরপ্রান্ত থেকে ৪০-৫০জনের সারিবদ্ধ দল পলো চাপিয়ে মাছ ধরতে সামনের দিকে এগিয়ে আসেন।

পলো বাওয়া উৎসবে আলেপুর গ্রাম থেকে আসা নূর মিয়া বলেন, বছরের এই দিনটার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করি। সবাই মিলে একসাথে মাছ ধরার আনন্দটাই আলাদা। এক কেজি ওজনের একটি ঘাগট (রিটা) মাছ পেয়ে আরো বেশি আনন্দ লাগছে।

এ ব্যাপারে আলাপকালে কমলগঞ্জের প্রবীণ মাছ শিকারি মো. ইসমাইল মিয়া জানান, পরিবেশ ও আবহাওয়ার প্রতিকূলতার কারণে নদী-নালা, খাল-বিল, হাওরের তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে পানি হ্রাস এবং অধিকাংশ জলাশয় ইজারা দেওয়ায় পলো বাওয়া উৎসব এখন অনেকটাই ভাটা পড়েছে। অভাব-অনটন ক্রমশ গ্রাস করে ফেলছে চিরাচরিত এই গ্রামীণ উৎসবের অতীত ঐতিহ্যকে।

তার মতে প্রাচীন এই উৎসবকে টিকিয়ে রাখতে সর্বমহলের উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত