শাকিলা ববি

০৪ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:১৫

সিলেটে খেজুরের রস খেতে উপচে পড়া ভিড়

ফজরের আজানের আগেই প্রাইভেটকার, মোটরবাইক, সিএনজি অটোরিকশা করে শতাধিক মানুষ এসে হাজির একটি এতিমখানার পাশে। সাধারণত এই এতিমখানার শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা ছাড়া এখানে কোনো মানুষের আনাগোনা থাকে না। কিন্তু গত চার দিন ধরে কাকডাকা ভোর থেকে এই এতিমখানার আশপাশে ভিড় করছেন মানুষজন। সবাই আসছেন খেজুরের রস খেতে।

সিলেট নগরী থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে সিলেট সুনামগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশে কান্দিগাও ইউনিয়ন। চারিদিকে খেজুর ও নারিকেল গাছে ঘেরা একটি এতিমখানা আছে এই ইউনিয়নের জাঙ্গাইল টুকের বাজার গ্রামে। গত চার দিন ধরে ভোর ৫টা থেকে সিলেট নগরীর বিভিন্ন এলাকা থেকে খেজুরের রস খাওয়ার জন্য মানুষজন এখানে ভিড় করছেন।

গাছি মো. ইমান আলী গাছ থেকে রসের হাঁড়ি নামাতে দেরি হয় কিন্তু হাঁড়ি শেষ হতে দেরি হয় না। সকাল ৭টার ভিতরে শেষ হয়ে যায় রসের হাড়ি।   

এতিমখানার দায়িত্বরতদের সাথে কথা বলে জানা যায়, সদর উপজেলার জাঙ্গাইল টুকেরবাজার এলাকায় গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে দারুল আয়তাম হালিমাতুস সাদিয়া (রা.) এতিমখানার কার্যক্রম শুরু হয়। এরপরই এতিমখানার দায়িত্বরতরা খেজুর গাছসহ অন্যান্য গাছগুলোর পরিচর্যা শুরু করেন। এতিমখানার কাজে লাগানোর জন্য গাছগুলো থেকে রস নিয়ে গুড় বানানোর চিন্তা করেন তারা। সেজন্য সুনামগঞ্জের নারায়নতলা এলাকার ইমান আলী নামের একজন গাছিকে মৌখিক চুক্তিতে আনেন এতিমখানার কর্তৃপক্ষ।

গাছি ঈমান আলী জানান, এখানে ৬৩টি খেজুরগাছ আছে। এরমধ্যে ৫৫টি গাছ থেকে রস সংগ্রহ করেন। বাকি গাছগুলো থেকে রস আসে না। গত একমাস যাবত খেজুর গাছের রস সংগ্রহ করছেন তিনি। এতিমখানার শিক্ষার্থীদের রস খাইয়ে বাকি রস দিয়ে গুড় তৈরি শুরু করেন। তবে কয়েকদিন আগে স্থানীয় এক যুবক এসে এখানে রস খেয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছবি শেয়ার করেন। এর পর থেকেই মানুষজন এসে ভিড় করছেন রস খাওয়ার জন্য।

ভোর ৫টার সময় বটেশ্বর থেকে বেশ কয়েকজন বন্ধু নিয়ে রস খেতে আসেন সৈয়দ সাইফুর রহমান। তিনি বলেন, খেজুরের রসের কথা অনেক শুনেছি। কিন্তু কোনো দিন খাইনি। ফেসবুকে দেখলাম এখানে খেজুরের রস পাওয়া যায়। তাই আজ খেতে আসলাম। জীবনে প্রথম খেজুরের রস খেলাম। অনেক মজাদার। এত দূর থেকে আসা সার্থক হলো।

সাইফুরের মত এখানে আসা বেশিরভাগ মানুষই প্রথমবারের মত খেজুরের রসের স্বাদ গ্রহণ করেন। লিডিং ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী আম্বরখানা এলাকার ফাহিম বলেন, যখন ফজরের আজান পড়ে আমি তখন এসেছি। এসে দেখি অনেক মানুষ। এতিমখানা কর্তৃপক্ষ প্রথম বলেন, ফজরের নামাজের পর রস নামাবেন। কিন্তু মানুষজনজন বেশি হওয়ায় আজানের আগেই রস নামানো শুরু করেন।

তিনি বলেন, খেজুরের রস সম্পর্কে বইয়ে পড়েছি। আম্মাও গল্প করেছেনে খেজুরের রস খাওয়ার কিন্তু আমি কখনো খাইনি। ফেসবুকের মাধ্যমে জানতে পাড়ি এই জায়গার কথা তাই দেড়ি না করে চলে আসলাম খাওয়ার জন্য। সত্যিই অনেক মজাদার এই খেজুরের রস।

নগরীর শাহী ঈদগাহ এলাকা থেকে এসেছেন মাহবুব খান। তিনি বলেন, ফেসবুকের মাধ্যমে খবর পেয়েছি খেজুরের রসের। খেয়ে প্রাণটা ভরে গেছে। এখন কিছু রস বাসায় নিয়ে যাব পরিবারের সদস্যদের জন্য।

জানা যায়, প্রতিদিন ২০ থেকে ১০০ লিটার রস পাওয়া যায় এই গাছগুলো থেকে। সব গাছ থেকে প্রতিদিন রস সংগ্রহ করা হয় না। একটি গাছ থেকে দুই দিন বিরতি দিয়ে রস সংগ্রহ করা হয়। যে গাছ দুর্বল হয়ে যায় সে গাছ থেকে রস সংগ্রহ করা বন্ধ করে দেন গাছি। মাটির হাঁড়ি ও প্লাস্টিকের বোতল দিয়ে গাছ থেকে রস সংগ্রহ করা হয়।  প্রতি গ্লাস খেজুরের রস ১০ টাকা ও প্রতি লিটার খেজুরের রস ৫০ টাকায় বিক্রি করা হয়।

দারুল আয়তাম হালিমাতুস সাদিয়া (রা.) এতিমখানার হিফস বিভাগের প্রধান হাফিজ জাকারিয়া সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এই এতিমখানা কার্যক্রম শুরু করার পরই আমরা খেজুর গাছগুলো দেখতে পাই। তাই এতিমখানার বাচ্চাদের জন্য গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে গুড় বানিয়ে বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নেই। তাই এই রস সংগ্রহের জন্য আমরা ইমান আলীর সাথে মৌখিক চুক্তি করে তাকে এখনে আনি। এই রস বিক্রির টাকা এক ভাগ এতিমখানায় ও দুই ভাগ গাছি ইমান আলী নেন। এক মাস যাবত রস সংগ্রহ শুরু হলেও গত চার দিন যাবত মানুষজন বেশি আসছেন।

এই এতিমখানার আরেকজন শিক্ষক আব্দুল জলিল বলেন, আমার নিপা ভাইরাস সম্পর্কেও অবগত আছি। তাই রস সংগ্রহের পাত্র যত সম্ভব নেট দিয়ে ঢেকে রাখি। এবং রাতে পাহারার ব্যবস্থা রাখি। তবে স্থানীয় যুবকরা কয়েকদিন যাবত বেশ উৎপাত করছেন। জোর করে হাঁড়ি নামিয়ে রস খেয়ে যান। কিছু বললে হাঁড়ি ভেঙে দেওয়ার হুমকিও দেন।   

এ ব্যাপারে সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রাকিবুল হাসান বলেন, রাস্তা, বাঁধ, পুকুর পাড়, ক্ষেতের আইল এবং আবাদি জমিতে খেজুর গাছ বেশ ভালো জন্মে। এই অঞ্চলে কৃষকদের খেজুর গাছ চাষের প্রবণতা কম। সাধারণত উত্তরাঞ্চলের কৃষকরা বেশি খেজুরের গাছে চাষ করেন। পর্যাপ্ত রোদ, কম আর্দ্রতা, শুকনা ও কম বৃষ্টিপাত, উষ্ণ আবহাওয়া এ ফল চাষের জন্য উপযোগী।

তিনি বলেন, বেলে-দোআঁশ মাটি দেশীয় জাতের খেজুর গাছ চাষের জন্য বেশি উপযোগী। সিলেট অঞ্চলের মাটিও খেজুর গাছের জন্য উপযোগী। কিন্তু এই অঞ্চলের মাটি এসিডিক তাই গাছে রস হলেও হলেও ফল হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কম। খেজুর গাছের পুরুষ ও স্ত্রী গাছ আলাদাভাবে জন্মে। স্ত্রী গাছ থেকে ফল ও রস দুটিই পাওয়া যায়। পুরুষ গাছ থেকে শুধু রস পাওয়া যায়। তবে স্ত্রী গাছ থেকে রস সংগ্রহ না করাই ভালো।  

কৃষি কর্মকর্তা রাকিবুল হাসান আরও বলেন, সিলেটে সরকারিভাবে খেজুর ও তাল গাছ লাগানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। রস ও ফল ছাড়াও খেজুর গাছের আরও অনেক উপকারিতা রয়েছে। এই গাছ জমির ক্ষতি করে না। গাছের গোড়াতে জৈব সার বেশি দিলে রস ও ফলের পরিমাণ বাড়বে। এবং যত ঠাণ্ডা স্থানে গাছ থাকবে রস ও ফল তত বাড়বে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত