রিপন দে, মৌলভীবাজার

১০ জানুয়ারি, ২০২০ ২১:১০

হামহামে পর্যটকদের বন্ধু ‘হামি’ নামের এই কুকুর

মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার রাজকান্দি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের কুরমা বনবিট এলাকায় নৈসর্গিক সৌন্দর্যের হামহাম জলপ্রপাতের অবস্থান। দুর্গম জঙ্গলঘেরা এই জলপ্রপাতটির উচ্চতার নির্ভরযোগ্য সঠিক পরিমাপ এখনো জানা যায়নি। তবে ধারণা করা হয় যে, এর উচ্চতা ১৩৫-১৬০ ফুটের মধ্যে।

গহীন পাহাড়ি ও ঝিরি পথের কারণে অ্যাডভেঞ্চার প্রিয়দের কাছে হামহাম ঝর্ণার যাওয়া আসার রাস্তা ট্রেকিং ঝর্ণার রুপের সাথে অতিরিক্ত পাওনা। উপজেলার কলাবাগান থেকে শুরু হয় মূল অ্যাডভেঞ্চার। পাশেই ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত। পায়ে হাঁটা রাস্তায় জঙ্গলের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। ভুল করে অন্য পথে গেলে পথ হারানোর সম্ভাবনা থাকে এবং যেহেতু সাথেই ভারতের সীমান্ত তাই প্রাণহানীর ঝুঁকিও থাকে। অনেক প্রস্তুতি নিয়ে গাইড নিয়ে যেতে হয় সেই সাথে গহীন পাহাড়ি এবং ঝিরি পথের পিচ্ছিল পথে, একটু বেখেয়াল হলেই ঘটতে পারে দুর্ঘটনা।
 
এতোটা পথ পাড়ি দিয়ে হামহাম ঝর্ণার পাশে যেতেই সব ক্লান্তি নিমিষেই কেড়ে নেয় হামহামের নৈসর্গিক সৌন্দর্য্য। ফেরার মত অনেকটা নিজের আবেগের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেই ফিরতে হয়। মন বলে আরো কিছুটা সময় থাকা যায় না?
 
তবে অনেকেই এই সুন্দরের কাছে হার মেনে ফেরার সময় ভুলে যান। অনেক সময় সন্ধ্যা চলে আসে। যখন সন্ধ্যা হয় তখন পাহাড়ি বিভিন্ন পশুপাখির আওয়াজ আর হামহামের উপর থেকে নিছে গড়িয়ে পরা পানির শব্দ ছাড়া অন্য কোনকিছু শব্দও মিলে না। সব মিলিয়ে যখন ভীতিকর অবস্থা তখনই পর্যটককে ভরসা হয়ে আসে “হামি”।। বন থেকে বের হয়ে লোকালয় পর্যন্ত আশা পর্যন্ত হামি পথ দেখায় পর্যটককে। কখনো সামনে থেকে কখনো পেছনে থেকে আগলে নিয়ে আসে পর্যটকদের। পাহাড়ি পথ বা ঝিরি দুটিতেই সে সমান তালে পর্যটকের পাশে গায়ে গায়ে মিশে হাটে। ঝুকিপূর্ণ রাস্তায় সে বিকল্প পথে দেখাবে। বিকল্প পথে যেতে চিৎকার করে ডাকবে।

“হামি” একটু কুকুরের নাম। কুকুরের সাথে মানুষের সম্পর্ক অনেক সময় আলোচনায় আসলেও এমন নিরাপত্তা দিয়ে পর্যটককে গন্তব্যস্থলে ফিরিয়ে দেওয়ার ঘটনা বিরল। যা প্রতিনিয়তই করে চলছে এই কুকুর। তাই হামহামে আসা পর্যটকদের প্রিয় বন্ধু “হামি”।

হামহামে গিয়ে একজন পর্যটক তখনই এই কুকুরের দেখা পাবেন, যখন বেলা গিয়ে সন্ধ্যা হয়ে যাবে বা  তিনি পথ হারাবেন। আর যদি পর্যটকের গাইড না থাকে তাহলে এই কুকুরটিই হয়ে উঠবে গাইড। হামহাম ঝর্ণায় সর্বশেষ একজন পর্যটক থাকলেও “হামি” সেখান থেকে ফিরে আসে না। যখন শেষ পর্যটক হামহাম থেকে চলে আসবেন তখন হামিও লোকালয়ের পথে হাটবে।

স্থানীয় গাইড ও এলাকাবাসীর সাথে আলাপ করে জানা যায়, হামি নামের এই কুকুরটি প্রায় ২ বছর থেকে পর্যটকদের সাথে প্রতিদিন সকালে হামহাম জলপ্রপাতে যায়। সেখানে সারাদিন সে থাকে। পর্যটকদের দেয়া বিভিন্ন খাবার খায়। তার সাথে আরেকটি কুকুর আছে ‘মামি’ নামের। তবে হামিই দুরন্ত ও দায়িত্বশীল। যতক্ষণ সেখানে পর্যটক থাকবেন ততক্ষণ হামি সেখানে থাকবে।

মহামের নিকটবর্তী গ্রামের বাসিন্দা ও পর্যটক গাইড নারায়ণ নুনিয়া জানায়, এই কুকুর তাদেরই গ্রামে বেড়ে উঠেছে। সে প্রতিদিন সকালে যে প্রথম হামহামের রাস্তায় পা ফেলে তার সাথে চলে যায় জলপ্রপাতে। আর দিন শেষে সব শেষে যারা হামহাম থেকে ফিরে আসেন তাদের সাথে আসে। এই কুকুর কারো সাথে থাকলে এই বনে চলতে গেলে তাদের আর গাইড লাগে না।

সম্প্রতি মৌলভীবাজারের স্থানীয় সংবাদকর্মি মাহমুদ এইচ খান ঢাকা থেকে আগত একটি পর্যটক দলের সাথে হামহাম গিয়ে ফিরতি পথে দেরী করে ফেরার পথে তাদের সঙ্গী ছিল 'হামি'।

হামি সম্পর্কে বলতে গিয়ে মাহমুদ এইচ খান জানান, আমাদের ফিরতে অন্ধকার হয়ে যায়। হামি রাতের আধারে এতোই সূক্ষ্মভাবে আমাদের গাইড করেছিল যা অবাক করার মতো।

মাহমুদ বলেন, সেদিন আমরা একটু দেরী করে সেখানে গিয়েছিলাম। আমাদের ছাড়া সেখানে আর কোনো পর্যটকই ছিল না। আমরা যখন ফিরব তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। আমরা ৩ জন অন্ধকারে বনে অনেকটা ভয়ে ছিলাম। কিন্তু দেখলাম আমাদের সাথে একটা কুকুর আছে। অনেকটা অভয় পেয়েছি অচেনা এই জায়গায় তাকে সঙ্গী পেয়ে। তারপর পুরোটা রাস্তা সে আমাদের সাথে ছিল। আমরা রাতের আধারে রাস্তায় আধাঘণ্টার বিরতি দিয়েছি আমাদের সাথে সে বিশ্রাম করেছে। কিন্তু আমাদের ছেড়ে যায়নি। তারপর আমাদের সাথে সে লোকালয়ে আসে। সেদিন আমরা এই কুকুরটির একটি নাম দেই হামহামের সাথে মিলিয়ে “হামি”।
 
সম্প্রতি হামহাম ঘুরে এসেছেন ডেনমার্কের নাগরিক টিকলু ও বিমান ধর তারা জানান, রাস্তায় সে আমাদের সাথে শুধুই ছিল এমনটা বললে ভুল হবে। সে আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। ঝুঁকিপূর্ণ রাস্তায় সে আমাদের বিকল্প রাস্তায় চলতে দেখিয়েছে। বন্যপ্রাণীদের নড়াচড়া পেলে সে পেছনে চলে গেছে যাতে আমাদের উপর কোনো প্রাণী আক্রমন করলে সে ঠেকাতে পারে।’

আপনার মন্তব্য

আলোচিত