শাকিলা ববি

২৭ ফেব্রুয়ারি , ২০২০ ০০:৪৮

নগরীর ছড়া-খাল যেন ময়লার ভাগাড়

সিলেটের নগরীতে ছড়া ও খাল প্রবহমান ছড়া ও খালগুলো এখন ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। প্লাস্টিকের বোতল ও ব্যাগসহ বিভিন্ন ধরনের আবর্জনায় ছেয়ে গেছে নগরীর প্রায় সবকটি ছড়া ও খাল।

এই ময়লা ফেলা অব্যাহত থাকলে আসছে বর্ষায় সিলেট নগরের জলাবদ্ধতা প্রকট আকার ধারণ করবে বলে মনে করছেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা।

এদিকে ছড়া ও খালকে ময়লার ভাগাড় বানানোর জন্য নগরবাসীকেই দায়ী করছেন সিসিকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা।

সিলেট নগরীতে প্রতিদিন প্রায় ৩০০ টন বর্জ্য উৎপাদন হয়। এসব বর্জ্য নিয়ে ফেলা হয় প্রায় ১৫ একর আয়তনের দক্ষিণ সুরমার লালমাটিয়ায় ডাম্পিং গ্রাউন্ডে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় রীতিমত হিমসিম খেতে হয় সিলেট সিটি করপোরেশনের (সিসিক) পরিচ্ছন্নতা শাখার। তার উপর নগরবাসীর অসেচতনতার কারণে ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে নগরীর ছড়া ও খালগুলো। বাড়ি বাড়ি গিয়ে ময়লা সংগ্রহসহ বিভিন্ন সচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ নগরবাসীকে যত্রতত্র ময়লা ফেলতে রুখতে না পেরে হতাশ সিসিকের পরিচ্ছন্নতা শাখার কর্মকর্তারা।

সরজমিনে দেখা যায়, প্লাস্টিকের বোতল ও ব্যাগে নগরীর সাগরদিঘি এলাকা দিয়ে প্রবহমান গোয়ালিছড়ায় পানি চলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। কাজিরবাজারের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত বৈঠা খালটিও ময়লা ফেলে প্রায় ভরাট করা হয়ে গেছে। এমন চিত্র নগরীর প্রায় সবকটি ছড়া ও খালের।

সিসিকের পরিচ্ছন্ন শাখা সূত্রে জানা যায়, সিলেট নগরী পরিচ্ছন্নতার জন্য বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ৫৪৩ জন শ্রমিক নিয়োজিত আছেন পরিচ্ছন্নতার কাজে। নগরীকে পরিচ্ছন্ন ও দূষণমুক্ত রাখার জন্য সিসিকের এই পরিচ্ছন্নকর্মীরা কাজ করছেন। প্রতিদিন প্রায় ৩০০ টন বর্জ্য উৎপাদন হয় সিলেট নগরীতে। নগরীর ওয়ার্ডগুলোতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ময়লা সংগ্রহ করেন পরিচ্ছন্নকর্মীরা। এছাড়াও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ক্লিনিক্যাল বর্জ্যও সংগ্রহ করা হয় সিসিকের পক্ষ থেকে। উৎপাদন হওয়া এসব বর্জ্যের জন্য পর্যাপ্ত নয় লালমাটিয়ায় ডাম্পিং গ্রাউন্ড। তাই আরেকটি ডাম্পিং গ্রাউন্ডের জন্য জায়গা খুঁজছে সিলেট সিটি করপোরেশন। এছাড়া ডাম্পিং গ্রাউন্ডে অত্যাধুনিক উপায়ে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য নির্মিত ‘স্যানেটারি ল্যান্ডফিল’ এর কাজও চলমান আছে।

সিলেট সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কর্মকর্তা মো. হানিফুর রহমান সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, নগরীকে পরিচ্ছন্ন রাখতে সিসিকের পরিচ্ছন্নতা শাখার সবাই দিনরাত পরিশ্রম করেন। কিন্তু আমাদের এই পরিশ্রম কাজে আসছে না নগরবাসীর অসচেতনতার জন্য। ময়লায় গাড়ি বাড়ি বাড়ি পাঠানো হয় তারপরও মানুষজন ছড়া ও খালে ময়লা ফেলেন। নগরবাসীর এই আচরণে আমরা হতাশ হয়ে গেছি। কি করার আছে আমাদের! এত জনসংখ্যার এই নগরীতে আমরাতো প্রত্যেককে গিয়ে বলতে পারবো না। নগরবাসী যদি নিজের ঘর পরিষ্কার করতে গিয়ে নগরীকে অপরিচ্ছন্ন করেন তাহলে একা সিসিক কি করবে?

হানিফুর রহমান আরও বলেন, আমাদের মেয়র পরিচ্ছন্নতা বিষয়ে খুব কঠোর। জনগণের সচেতনতা বাড়াতে ও দ্রুততম সময়ে বর্জ্য সংগ্রহ ও অপসারণের লক্ষ্যে সম্প্রতি নগরীর একটি ওয়ার্ডের বাসাবাড়িতে দু’টি বালতি ও একটি করে ব্যাগ বিতরণ করেছেন। এই কার্যক্রমের আওতায় পর্যায়ক্রমে নগরীর প্রতিটি ওয়ার্ডকে আনা হবে। বছরে ২ বার নগরীর ছড়া ও খালগুলো পরিষ্কার করানো হয় সিসিকের পক্ষ থেকে। সর্বোপরি জনসচেতনতা না বাড়লে এই সমস্যার কোনো সমাধান আসবে না।

এ ব্যাপারে সিলেট সিটি করপোরেশনের ১৩নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শান্তনু দত্ত (সনতু) বলেন, ময়লা সংগ্রহ করার জন্য আমাদের কর্মীরা বাড়ি বাড়ি যান। তারপরও মানুষজন ছড়া-খালে ময়লা ফেলেন। আমাদের আশপাশের অনেক শিক্ষিত মানুষজনও এই কাজ করছেন। অনেকে মাস শেষে মাত্র ষাট টাকা দিবেন বলে ছড়া-খালে ময়লা ফেলেন। অথচ এই মানুষজনই হাজার টাকা খরচ করেন নিজের ঘর সাজানোর জন্য।

তিনি বলেন, ছড়া, খাল ও ড্রেনগুলো পানি প্রবাহিত হওয়ার কথা। কিন্তু সিলেটের ছড়া-খালে থাকে প্লাস্টিকের বোতল ও ব্যাগ। ওয়ার্ডগুলোর ড্রেন ও সড়ক পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য ৪জন পরিচ্ছন্ন কর্মী নিয়োজিত আছেন প্রতিটি ওয়ার্ডে। ড্রেনগুলো পরিষ্কারের সময়ও দেখা যায় প্লাস্টিকের বোতল ও ব্যাগে ভরপুর। নগরবাসী ধরেই নিয়েছেন যে তারা যত্রতত্র ময়লা ফেলবেন আর সিসিক সেটা পরিষ্কার করবে। এ ব্যাপারে জনগণ যদি সচেতন না হন সিসিক একা কিছু করতে পারবে না।

বাংলাদেশ পরিবহন আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম কিম বলেন, সিলেটের নদী, ছড়া, খালগুলো দেখলে চরমভাবে হতাশা বোধ করি। যেখানে পানির অবাধ বিচরণ থাকার কথা সেখানে প্লাস্টিকের বোতলের ছড়াছড়ি। ছড়া, খালের এসব আবর্জনার কারণে আসছে বর্ষায় সিলেট নগরীতে জলাবদ্ধতা প্রকট আকার ধারণ করতে পারে।

তিনি বলেন, একদিকে লক্ষ টাকা ব্যয় করে সিটি করপোরেশন সিলেট নগরীর ছড়া-খাল পরিষ্কার করবে, অন্যদিকে সিলেট নগরীর অসচেতন মানুষ ছড়া, খাল, নদীতে আবর্জনা ফেলবে, এটা হতে পারে না। যারা ছড়া, খাল, নদীতে ময়লা ফেলেন তারা সভ্য সমাজের অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন না। তাদেরকে চিহ্নিত করতে হবে। তাদেরকে রুখতে সামাজিক ভাবে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।

এ ব্যাপারে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেট শাখার সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ছড়া, খালে ময়লা কারা ফেলছেন? অবশ্যই এই নগরীর বাসিন্দারাই ফেলছেন। নগরবাসী যদি মনে করেন তারা শহর নোংরা করবেন, ছড়া, খালে ময়লা ফেলবেন আর সিটি করপোরেশন সেটা পরিষ্কার করবে তাহলে এটা তাদের ভুল ধারণা। কারণ শহর পরিষ্কার রাখা শুধু সিসিকের দায়িত্ব না। এই দায়িত্ব এই নগরীর প্রতিটি নাগরিকের।

সিসিকের চলমান পরিচ্ছন্নতা কাজের অগ্রগতিকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, মেয়র বাড়ি বাড়ি গিয়ে ময়লা ফেলার বালতি দিচ্ছেন। পরিচ্ছন্নতা কর্মী দিয়ে বাড়ি থেকে ময়লা সংগ্রহ করাচ্ছেন। তিনি তার কয়েকশ কর্মী নিয়ে আর কীইবা করতে পারেন। এই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য নাগরিক সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। এখন কেউ যদি নিজ থেকে সচেতন হতে না চান তাকে সচেতন হতে বাধ্য করতে হবে। আমি মনে করি এ ব্যাপারে স্কুল কলেজগুলোতে ক্যাম্পেইন করতে হবে। যখন একটি শিশু তার মা বাবাকে ছড়া, খালে ময়লা ফেলতে দেখবে তখন সে অবশ্যই তার মাম বাবাকে বলবে। তখন সন্তানের কাছে লজ্জা থেকে বাঁচতে হলেও ছড়া, খালে ময়লা ফেলতে বাধ্য হবেন মানুষজন।

এছাড়া ধর্মীয় উপাসনালয়গুলোতে এ ব্যাপারে বলতে হবে। কারণ প্রত্যেক ধর্মতেই পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কথা বলা আছে। একজন মসজিদের মাওলানা, মন্দিরের পুরোহিত, গির্জার ফাদার যদি ছাড়া, খালে ময়লা ফেলতে বারণ করেন তাহলে অবশ্যই মানুষজন এ ব্যাপারে গুরুত্ব দিবেন। সবাই যদি যার যার জায়গা থেকে নগরীকে পরিচ্ছন্ন রাখার ব্যাপারে উদ্যোগী হন তাহলে এই সমস্যা সমাধান করতে একা সিসিককে লড়তে হবে না।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত