মারূফ অমিত

২১ জানুয়ারি, ২০১৫ ২৩:২৫

ঘুরে এলাম কুমিল্লার ধর্মসাগর

হঠাৎ করেই কুমিল্লা যাবার প্লান হলো। ছোট ভাইরা কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিবে। উত্তমের বায়না তার সাথে আমাকে যেতেই হবে। রাজী হয়ে গেলাম। ১৬ ডিসেম্বর প্রথম প্রহরে শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ অর্পণ করে বন্ধু, সহযোদ্ধাদের সাথে আড্ডা না দিয়েই বাসায় ফিরে এলাম। রাতে খুব নিবিড় ঘুম না হলেও শুয়ে ছিলাম বিছানায়। ভোরের দিকে কয়েক ঘণ্টা ঘুম হলেও সকাল সাত টায় সাকিবের মোবাইল কলে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। উঠি উঠি করেও আধা ঘণ্টা শুয়ে ছিলাম। এর মধ্যে সাকিব এসে হাজির, উত্তম ও রেডি হয়ে গেছে। ন'টার মধ্যেই আমরা বেরিয়ে পড়লাম। 
 
 
পাহাড়িকায় করে কুমিল্লা পৌছাতে প্রায় সাড়ে চারটা বেজে গেলো। কুমিল্লার সিরাজ নানার সাথে আগে থেকেই কথা ছিলো উনার বাসায় উঠবো।  বেশ মিশুক, প্রগতিশীল মানুষ উনি,গান বাজনায় বেশ পারদর্শী। শহরের ও মাথায় উনার বাসা, মূল শহরের একটু বাহিরেই বলা যায়। বাসায় পৌছে ঐ দিন আর বের হই নি। খুব ক্লান্ত ছিলাম। শুয়ে শুয়ে নেট ব্রাউজিং করছিলাম আর বিবির বাজার স্থল বন্দর থেকে বের হয়ে যাওয়া মাল বোঝাই ট্রাকের শাঁ শাঁ শব্দ শুনছিলাম। কখন যে চোখ লেগে গেলো তা টের'ই পাইনি। ভোর বেলা'ই ঘুম ভেঙ্গে গেলো। ঘুম থেকে উঠে উনার বাসার ছাদে বসলাম বেশ কিছুক্ষণ। ভালোই লাগলো তিন তলার উপর কুয়াশা মাখা ভোর দেখতে। বের হতে হতে আমাদের প্রায় সাড়ে বারটার মত বেজে গেলো। কুমিল্লার ঐতিহাসিক ভিক্টোরিয়া কলেজের উত্তমের সিট পড়েছে। উত্তমকে হলের সামনে নামিয়ে দিয়ে আমি আর সাকিব চলে গেলাম ধর্ম সাগর দীঘির পাড়ে। শহরের চক বাজার এলাকা থেকে রিক্সা করে যেতে ৩০ টাকার মত ভাড়া খরচ হয়। 
 
 
বেশ সুন্দর, মুগ্ধকর পরিবেশ। স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের আড্ডায় মুখরিত চারপাশ। কুমিল্লার ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে রয়েছে ধর্ম সাগরের প্রায় পৌনে ছয়শত বছরের ইতিহাস। কুমিল্লা মহানগরীতেই রাজা মাণিক্য বাহাদুরের অপূর্ব কীর্তি গাঁথা এই ধর্ম সাগর। ভ্রমণ বিলাসী আর প্রকৃতি পিপাসুদের নজর কেড়ে নেয়া এক অপূর্ব নিদর্শন। তিনদিকে সবুজ প্রান্তর ঘেরা মাঝখানে ধূসর বর্ণের অন্যদিকে কুমিল্লা ষ্টেডিয়াম। উত্তরদিকে রাণীর কুঠির, মেহগনি, দেবদারু, শাল আর নানা রঙ্গের পাতা বাহারের গাছের ফাঁকে ফাঁকে বর্ণালী পাখির কুঞ্জন ধর্মসাগরের সৌন্দর্যকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। জানলাম, ত্রিপুরা রাজ্যের অধিপতি মহারাজা ধর্মমাণিক্য ১৪৫৮সালে এই দীঘিটি খনন করেন। “রাজমালা” গ্রন্থ অনুযায়ি ধর্মমাণিক্য সুদীর্ঘ ৩২বৎসর রাজত্ব করেন (১৪৩১-৬২ খ্রি:) কুমিল্লা শহর তাঁর আশে-পাশের অঞ্চল তাঁর রাজত্বের অধীন ছিলো। জনগনের পানীয় জলের সুবিধার জন্য খননকৃত এই দীঘিটি উৎসর্গ করেন রাজা মাণিক্য বাহাদুর। মহারাজা ধর্মমাণিক্য বাহাদুরের নামানুসারে দীঘিটির নাম রাখা হয় ধর্মসাগর। তৎকালীন সময়ে ধর্মসাগর নিয়ে ছড়িয়ে রয়েছে বহু উপাখ্যান ও উপকথা। এই দীঘিটি উৎসর্গের সময় যে তাম্রলিপি প্রদত্ত হয় তা নিন্মরূপ:-“ চন্দ্র বংশেতে মহামাণিক্য নৃপবর, তানপুত্র শ্রী ধর্মমাণিক্য শশধর।তেরশ আশিশতকে সোমবার দিনে, শুক্লপক্ষ এয়োদশী মেষ সংক্রমনে।। তাম্রপত্রে লিখি দিলাম এসব বচন, আমা বংশ মারি যে বা হয় রাজন।তাহার দাসের দাস হইবেক আমি, আমা কীর্তি ব্রক্ষাবৃত্তি না লঙ্ঘিত তুমি।।” 
 
 
তাম্রলিপির মর্ম: “চন্দ্র বংশোদ্ভব মহা মাণিক্যের সুধীপুত্র শশধর সদৃশ শ্রী শ্রী ধর্ম মাণিক্য ১৩৮০ মেষ সংক্রমনে (চৈত্র মাসের শেষ তারিখে) সোমবার শুক্ল এয়োদশী তিথিতে কৌতুকাদি তাষ্ট বিপ্রকে শষ্য-সমন্বিত ফল ও বৃক্ষাদি পূর্ণ উনত্রিশ দ্রোণ ভূমি দান করিলেন। আমার বংশ বিলুপ্ত হইলে যদি এই রাজ্য অন্যকোন ভূপতির হস্তগত হয়। তিনি এই বৃহ্মবৃত্তি লোপ না করিলে আমি তাহার দাসানুদাস হইব।"  ধর্মসাগর দীঘির আয়তন ২৩:১৮ একর। ১৯৬৪সালে দীঘিটির পশ্চিম ও উত্তর পাড়টি তদানিন্তন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সৈয়দ হাসান আহমেদ এর উদ্যোগে পাঁকা করা হয়। দীঘিটি বর্তমানে মৎস বিভাগের অধীনে। তবে দীঘির পশ্চিম উত্তর পাড় সংলগ্ন ৫একরের উদ্যানটি কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের। শুধু কুমিল্লা নয় বাংলাদেশের মধ্যে বিদ্যমান প্রাচীন কয়েকটি দীঘির মধ্যে কুমিল্লা ধর্মসাগর ঐতিহাসিক দীঘি। স্ফটিকতুল্য স্বচ্ছ ও নির্মল পানির জন্যে দীঘিটি অতুলনীয়। 
 
 
 
ধর্ম সাগরের এপাশ ওপাশে ঘুরাঘুরি করেই বিকেল কেটে গেল। নগর উদ্যানে সেদিন কোমল পানীয় 7up কোম্পানির বিজয় কনসার্ট থাকায় সন্ধ্যার পর থেকে উৎসুক জনতার ভিড় ছিল খুব।সাড়ে আটটার দিকে ফিরে এলাম আমরা। তখন কুমিল্লা শহরের রাস্তার দু পাশ নিয়ন আলোতে জ্বলজ্বল করছিল।
 


আপনার মন্তব্য

আলোচিত