মোস্তাফিজুর রহমান, বেনাপোল প্রতিনিধি

২১ ফেব্রুয়ারি , ২০১৮ ২০:৪৯

একুশ উপলক্ষে দুই বাংলার মিলন মেলা

ভৌগলিক সীমারেখা ভুলে কেবলমাত্র ভাষার টানে দুই বাংলার মানুষ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপন উপলক্ষে  বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব একুশে একই  মঞ্চে গাইলেন বাংলার জয়গান। নেতারা হাতে হাত রেখে ঊর্ধ্বে তুলে ধরলেন বাংলাকে। মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপন উপলক্ষে বেনাপোল চেকপোস্ট নোম্যান্সল্যান্ডে বুধবার (২১ ফেব্রুয়ারি) এভাবেই কাটালেন দুই বাংলার ‘বাংলা ভাষাভাষী’ মানুষ।

একই আকাশ একই বাতাস, দু‘বাংলার মানুষের ভাষা এক। আমরা বাংলা ভাষায় কথা বলি বলে বাংলাদেশের মানুষের জন্য আমাদের প্রাণ কাঁদে। তাই তো বারবার ছুটে আসি দুই দেশের বাঙালী বাংলাভাষী মানুষের পাশে।

বেনাপোল চেকপোস্ট নোম্যান্সল্যান্ডে স্থাপিত অস্থায়ী শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের মধ্য দিয়ে প্রতি বছরের মতো এবারো ভাষা শহীদদের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানানো হলো। মিষ্টি বিতরণ, আলোচনা আর গানে গানে মাতোয়ারা হলো দুই বাংলার একই আকাশ একই বাতাস।

এসময় উভয় দেশের জনপ্রতিনিধিরা বলেন, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির কথা। এ অনুষ্ঠানকে ঘিরে জড়ো হয়েছিল হাজার হাজার ভাষাপ্রেমী মানুষ। নেতাদের কণ্ঠে ছিল ভবিষ্যতে আরো বড় করে এক মঞ্চে একুশ উদযাপনের প্রত্যাশা।  উভয় দেশের বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক সংগঠনগুলো স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেয় এ অনুষ্ঠানে।

নানা রং এর ফেস্টুন, ব্যানার, প্লে কার্ড, আর ফুল দিয়ে বর্ণিল সাজে সাজানো হয় নোম্যান্সল্যান্ড এলাকা। দু‘বাংলার মানুষের এ মিলন মেলায় উভয় দেশের সীমান্তবর্তী বাসিন্দাদের মধ্যে উৎসাহের সৃষ্টি হয়।

প্রতি বছরই দুই বাংলার সীমান্তবর্তী এ অংশের বাসিন্দারা এক সাথে মিলিত হয়ে দিবসটি পালন করেন। তখন দুই দেশের সীমান্তের মধ্যবর্তী ওই স্থানে আবেআল্পুত পরিবেশের সৃষ্টি হয়। একে অপরকে আলিঙ্গন করে সকল ভেদাভেদ যেন ভুলে যায় কিছু সময়ের জন্য। ফুলের মালা ও জাতীয় পতাকা বিনিময় করে উভয় দেশের আবেগপ্রবণ অনেক মানুষ বাঙালীর নাড়ির টানে একজন অপরজনকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেন। দুই বাংলার মানুষের মাঝে বসে এক মিলন মেলা। এ সময় পেট্রাপোল ও বেনাপোল চেকপোস্টে ঢল নামে হাজার হাজার মানুষের। ক্ষণিকের জন্য হলেও স্তব্ধ হয়ে যায় আন্তর্জাতিক সীমারেখা।

এপার বাংলায় উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য পীযুষ কান্তি ভট্টাচার্য যশোর জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক শাহিন চাকলাদার, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. আবদুল মুজিদ ৪৯ বিজিবি কোম্পানি কমান্ডার লে: কর্নেল মোহাম্মাদ আরিফুল হক, শার্শা উপজেলা নির্বাহী অফিসার পুলক কুমার মণ্ডল।

ওপার বাংলার উপস্থিত ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের খাদ্যও সরবরাহ মন্ত্রী জোতিপ্রিয় মল্লিক,সংসদ বনগাঁও লোকসভা মমতা ঠাকুর,উত্তর ২৪ পরগনা জেলার সভাধিপতি রেহেনা খাতুন, পুলিশের আইপিএস অফিসার  বিশ্বজিৎ, বঁনগা বিধায়ক বিশ্বজিৎ দাস, বিধায়ক সুরজিৎ বিশ্বাস প্রাক্তন বিধায়ক ও জেলা আঞ্চলিক পরিবহন দপ্তরের সদস্য শ্রী গোপাল শেঠ উত্তর ২৪ পরগনা জেলা পরিষদ সভাপতি শ্রী কৃষ্ণ গোপাল ব্যানর্জী প্রমুখ।

পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের খাদ্য ও সরবরাহ মন্ত্রী শ্রী জ্যোতি প্রিয় মল্লিক ও বাংলাদেশের আওয়ামীলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য পীযুষ কান্তি ভট্টাচার্য এর নেতৃত্বে  যশোর জেলা আওয়ামীলীগের সাধরন সম্পাদক শাহিন চাকলাদার, বেনাপোল পৌর মেয়র আশরাফুল আলম লিটনকে নিয়ে বেনাপোল নোম্যান্সল্যান্ডে নির্মিত অস্থায়ী শহীদ বেদীতে পুষ্প স্তবক করে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
 
এ সময় উভয় দেশের বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক সংগঠনগুলো স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেয় এ অনুষ্ঠানে। ভাষা দিবসের মিলন মেলায় বিজিবি বিএসএফকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানায়।

এর পর দু’দেশের জাতীয় পতাকা উড়িয়ে হাজার হাজার ভাষাপ্রেমী মানুষ দিবসটি উদযাপন করে যৌথভাবে। এ সময় ভাষার টানে বাঙালির বাঁধন হারা আবেগের কাছে মিলে মিশে একাকার হয়ে যায় দু‘বাংলার মানুষ। এর মধ্য দিয়ে বোঝা গেল রফিক, শফিক, বরকত ও সালামের তরতাজা রক্ত বৃথা যায়নি। ভাষার আকর্ষণ ও বাঙালির নাড়ির টান যে কতটা আত্মিক ও প্রীতময় হতে পারে তাও বুঝিয়ে দিল মহান একুশে ফেব্রুয়ারি।

সেই সঙ্গে এপার-ওপার দুই বাংলার গণমানুষের ঢল ফের প্রমাণ করে দিলো দেশ ভাগ হলেও ভাগ হয়নি ভাষার। উভয় দেশের মধ্যকার সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের ভিত্তি এখনো যে অটুট রয়েছে তাও বোঝা গেল অনুষ্ঠানে উপস্থিত দুই বাংলার অতিথিদের বক্তৃতায়। এই মঞ্চে শহীদদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করে শুরু করা হয় আলোচনা সভা।
 
আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি কোলকাতার পশ্চিম বাংলার খাদ্য সরবরাহ মন্ত্রী শ্রী জ্যোতি প্রিয় মল্লিক বলেন, ৫২ এর ভাষা সংগ্রামের পথ ধরেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা এসেছে। তিনি বলেন ভাষার জন্য তারকাটা বেড়া এক সময় উঠে যাবে। আমরা প্রতিবছর ১০ হাত করে জায়গা বৃদ্ধি করে ভাষা উদযাপন করব। পাখি যেমন উড়ে যেতে তারকাটা বেড়া দেখে না, তেমনি আমরা মানুষ হয়ে কেন এ বেড়া দেখব । এক সময় আমরা এক হয়ে যাব কোন বেড়া থাকবে না। ভবিষ্যতে দু‘বাংলার ভাষা প্রেমীদের সাথে নিয়ে আরো বড় করে একুশ উদযাপন করবো এটাই আমার প্রত্যাশা। আমরা ওপারে থাকলেও শহীদ সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ সকল ভাষা সৈনিকের প্রতি আমরা শ্রদ্ধাশীল।
 
বেনাপোল পৌর মেয়র আশরাফুল আলম লিটন বলেন, এই ভাষার পথ ধরে আমদের স্বাধীনতা এসেছে।আর এই স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের জনগণ ও সরকার আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল।সে জন্য আমরা তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। ভাষা ও ভাষা শহীদদের আত্মত্যাগ আমাদের দুই দেশের মধ্যে উপস্থিত সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের ভিতকে আরো শক্ত করবে। দু’বাংলার মানুষের জন্য অবিলম্বে ভিসা প্রথা তুলে দিয়ে পাসপোর্টের মাধ্যমে আসা যাওয়ার পদ্ধতি চালুর জোর দাবি জানান দু’দেশের সরকারের কাছে। তিনি পশ্চিম বঙ্গ সরকারের কাছে দাবি করে বলেন আমরা ভাষা উদযাপন করতে দুই দেশ মিলে একটা জায়গা নিতে হবে। কারণ এ স্বল্প জায়গায় আমাদের দুই দেশের মানুষ ভাষা উদযাপন করতে পারে না।
 
আলোচনা সভায় দু‘দেশের মাতৃভাষা উদযাপন কমিটির নেতৃবৃন্দসহ অতিথিরা উপস্থিত ছিলেন। উভয় মঞ্চে একুশের কবিতা আবৃতি, ছড়া, গীতিনাট্য, আলোচনা আর সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রখ্যাত  আবৃত্তি কারক ও অভিনেতা জাতিয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রাপ্ত শিল্পী কিরণ চন্দ্র রায় নজরুল সংগীত  শিল্পী ফাতেমাতুজ জোহরা, ভারতের পশ্চিম বাংলার  বিশিষ্ট কবি ও লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় প্রখ্যাত সংগীত শিল্পী জয়ন্ত চট্টপধ্যায়, অনুপম রায়, কবি ও লেখক পশ্চিম বাংলার সঞ্জীব চট্রপধ্যায় উপস্থিত ছিলেন।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত