আন্তর্জাতিক ডেস্ক

১৮ মে, ২০২০ ০২:৪৭

করোনায় শিশু ও বয়স্করা ভিন্নভাবে আক্রান্ত হচ্ছেন

নিউইয়র্কে নভেল করোনাভাইরাস শিখর স্পর্শের পরই এ ভাইরাস নিয়ে নতুন একটি দিক খুঁজে পেয়েছেন শিশু বিশেষজ্ঞরা। যেখানে দেখা গেছে, অনেক শিশু কোভিড-১৯ দ্বারা আক্রান্ত হলেও তাদের কারও কাশির সমস্যা ছিল না। এমনকি তাদের গুরুতর শ্বাসকষ্টও ছিল না। তাদের মাঝে যেসব লক্ষণ দেখা যায় তা হলো উচ্চমাত্রার প্রদাহ, জ্বরের কিছু সংমিশ্রণ, হাতে-পায়ে র‍্যাশ, ডায়রিয়া, বমি ও নিম্ন রক্তচাপ। ২ মে বিশ্বব্যাপী আইসিও ডাক্তাররা যখন সাপ্তাহিক অনলাইন মিটিংয়ে একত্র হয়েছিলেন, তারা তখন অনেকেই একই ধরনের অভিজ্ঞতার কথা জানান।

এই মিটিং নিয়ে স্টিভেন কারেনেই নামে এক ডাক্তার বলেন, মিটিংয়ের সুর পুরোপুরি বদলে গেল। কারণ এর আগ পর্যন্ত কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত শিশুদের নিয়ে ইতিবাচক খবরই আসছিল। শিশুরা গুরুতর অসুস্থ হতে পারে, তবে তারা তা কমই হয়। তারা রোগ ছড়াতে পারে। অবশ্য তা বয়স্কদের চেয়ে কমই। চীন, আইসল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ইতালি ও নেদারল্যান্ডসে একের পর এক গবেষণা বলছিল শিশুরা খুব কমই আক্রান্ত হয়। হলেও পরিস্থিতি অতটা জটিল হয় না।

কিন্তু অল্প কিছুসংখ্যক বাচ্চার মাঝে নভেল করোনাভাইরাসের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ পেতে বেশ সময় লাগে, যা কিনা মূলত ইউরোপ ও নিউইয়র্কের ডাক্তাররা প্রথমে দেখতে পান। এর নাম দেয়া হয় পেডিয়াট্রিক মাল্টিসিস্টেম ইনফ্লামেটরি সিনড্রোম (পিএমআইএস)।

বিজ্ঞাপন

এর মাঝে ৪ মে নিউইয়র্ক সিটি হেলথ ডিপার্টমেন্ট শহরে ৮২ হাজার নিশ্চিত কেসের কথা জানায়। যেখানে বেশির ভাগ আক্রান্তই সেরে উঠেছে অথবা সেরে ওঠার পথে আছে বলে জানানো হয়। কিন্তু একজন শিশু মারা গিয়েছিল বলে জানা যায়। এদিকে দেশজুড়ে ডাক্তাররা একই রকম কেস খুঁজে পাচ্ছেন। পিএমআইএস বাচ্চাদের মাঝে অভূতপূর্ব এক ঘটনা হিসেবে দেখা দিয়েছে।

যদিও শিশু হোক কিংবা বয়স্ক ভাইরাস কিন্তু একই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কেন কোভিড-১৯ এই দুই পক্ষকে ভিন্নভাবে আক্রান্ত করছে? শিশুদের বেশির ভাগই গুরুতর অসুস্থ হয় না। কিন্তু অল্পসংখ্যক বাচ্চার মাঝে এটি শেষ হয় বিলম্বিত ইনফ্লামেশন সিনড্রোমে গিয়ে, যা কিনা সম্ভবত বাচ্চাদের বিকাশমান ইমিউন সিস্টেমের সঙ্গে জড়িত। যদিও কোভিড-১৯ নতুন রোগ, এই প্যাটার্ন অবশ্য অন্যান্য ভাইরাসের ক্ষেত্রেও দেখা যায়।

ইমিউন সিস্টেম বা প্রতিরোধক্ষমতা বয়সের সঙ্গে বদলে যায়। বিভিন্ন উপায়ে এটি দুর্বল কিংবা শক্তিশালী হতে পারে। পরিচিত হুমকিগুলোর জন্য বয়স্কদের শরীর হয়তো ভালোভাবে কাজ করে। এছাড়া নভেল করোনাভাইরাসের অন্য দুটি রোগ সার্স ও মার্স, যা কিনা প্রাণীদেহ থেকে মানুষের মাঝে এসেছে। দুটিরই মৃত্যুহার কোভিড-১৯-এর চেয়ে বেশি। কিন্তু এদের একটিও বর্তমান সময়ের মতো মহামারী রূপ নেয়নি। এগুলোও বাচ্চাদের মাঝে অনেক বেশি ছড়িয়েছিল।

কোভিড-১৯, সার্স ও মার্স মানুষের কাছে একেবারেই নতুন। পরিণত বা প্রাপ্তবয়স্কদের ইমিউন সিস্টেম নতুন ধরনের ভাইরাসের মোকাবেলায় একেবারেই অব্যবহৃত। সাধারণত বড় আকারে বছরের পর বছর যে ভাইরাসগুলো বয়স্কদের অসুস্থ করে, তা হচ্ছে পূর্ববর্তী ভাইরাসগুলোর পরিবর্তিত সংস্করণ। যা কিনা মৌসুমি ফ্লু হিসেবে টিকে থাকে। অন্যদিকে শিশুদের এমন ভাইরাসের মোকাবেলা করতে হয়, যা হয়তো নতুন না। কিন্তু তাদের কাছে নতুন।

শিশুরা জন্মগ্রহণ করে ইমিউন সেলের পরিপূর্ণ ভাণ্ডারসহ, যাদের বলা হয় টি সেল। প্রত্যেক টি সেলের স্বতন্ত্র রেসিপ্টর থাকে। এ রকম অসংখ্য টি সেল সমন্বিতভাবে টি সেলের পুল গঠন করে, যা অনুমানমূলক রোগটি শনাক্ত করতে পারে। শিশুরা যখন নতুন কোনো ভাইরাসের মুখোমুখি হয়, তখন তাদের ইমিউন সিস্টেম টি সেলের বিরুদ্ধে লড়াই করে।

এ কারণে প্রাপ্তবয়স্কদের ইমিউন সিস্টেম আগে মোকাবেলা করা ভাইরাসের বিরুদ্ধে আরও ভালোভাবে লড়াই করতে পারে। কিন্তু তারা নতুন ভাইরাস মোকাবেলায় সমস্যায় পড়তে পারে। এ কারণে রুবেলা ও চিকেন পক্সের মতো রোগ শিশুদের চেয়ে বয়স্কদের ওপর বেশি মারাত্মক হতে পারে।

বিজ্ঞাপন

কেন শিশুরা অতিমাত্রায় নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয় না, তার আরেকটি হাইপোথিসিস হচ্ছে, তারা চার ধরনের করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়, যার কারণ হচ্ছে সাধারণ সর্দি জর। এই সাধারণ সর্দি জর কোভিড-১৯, সার্স অথবা মার্সের মতো না। কিন্তু তাদের মাঝে কিছু মিল রয়েছে। ফলে এর বিরুদ্ধে ইমিউনিটি অর্জন নভেল করোনাভাইরাসের ক্ষমতাকেও কমিয়ে দিয়েছে। তাই শিশুরা এমন কিছু প্রতিরক্ষা অর্জন করেছে, যা প্রাপ্তবয়স্কদের মাঝে নেই।

যখন পিএমআইএস প্রথম ইউরোপ ও নিউইয়র্কে দেখা যায়, কোভিড-১৯-এর সঙ্গে এর যোগাযোগ একেবারেই পরিষ্কার ছিল না। আবার অনেক শিশু যাদের পিএমআইএসের লক্ষণ আছে, তাদের মাঝে করোনা পরীক্ষায় পজিটিভ আসেনি। কিন্তু অনেকের শরীরে করোনাভাইরাসের অ্যান্টিবডি দেখা যায়। যার অর্থ হচ্ছে সম্ভবত কোনো একটি পর্যায়ে নভেল করোনাভাইরাস মৃদু লক্ষণ অথবা লক্ষণহীন অবস্থায় ছিল। তবে তাদের ইমিউন সিস্টেম দুর্বল হওয়ার পরিবর্তে শক্তিশালী হয়েছে। এটি সম্ভবত প্রদাহের কারণ ছিল। শরীরের ইমিউন সিস্টেম সাধারণ প্রতিক্রিয়া দেখাতে আক্রান্ত হওয়ার পর চার-পাঁচ সপ্তাহ সময় নেয়। তাই এটা সম্ভব, কোভিড-১৯ শীর্ষে ওঠার পর নিউইয়র্কে এখন পিএমআইএসের কেস সামনে আসছে।

প্রদাহের এ ঘটনা মূলত ভাইরাসের দীর্ঘায়ত না হওয়াকে ইঙ্গিত দিচ্ছে। অথবা এটি হতে পারে ইমিউন সিস্টেমের ফলাফল, যা কিনা ভুলে নিজের শরীরের বিরুদ্ধে চালিত হয়েছে। যখন ভাইরাস আপনার শরীরে প্রতিক্রিয়া দেখায়, তখন আপনার ইমিউন সিস্টেম এর বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে। এক্ষেত্রে অনেক সময় ইমিউন সিস্টেম সুস্থ টিস্যুকেও আক্রান্ত করতে শুরু করে।

শিশুদের মাঝে একটি অংশ, যাদের স্বাস্থ্য অবস্থা ভালো না, তারা কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে দ্রুত অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে। আবার ক্ষুদ্র একটি অংশের মাঝে কয়েক সপ্তাহ পর পিএমআইএস দেখা যেতে পারে, শুরুতে মৃদু কিংবা কোনো উপসর্গ ছাড়াই।

তবে পিএমআইএস একটি শিশুকে হাসপাতালে ভর্তি করানোর জন্য যথেষ্ট। যদিও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তা জীবনকে হুমকিতে ফেলে না। এর মাঝে অনেকেই সুস্থ হয়ে উঠেছে।

দি আটলান্টিক

আপনার মন্তব্য

আলোচিত