সোশ্যাল মিডিয়া ডেস্ক

০১ এপ্রিল, ২০১৬ ১৯:৪৫

সেনাকর্মকর্তা হিসেবেই নয়, নাগরিক হিসেবেও তনু হত্যার বিচার চাই

কুমিল্লা সেনানিবাসের সংরক্ষিত এলাকায় ভিক্টোরিয়া কলেজ ছাত্রী ও নাট্যকর্মী সোহাগী জাহান তনুর মৃতদেহ পাওয়ার পর দেশব্যাপী ব্যাপক প্রতিবাদ, বিক্ষোভের পাশাপাশি সেনাসদস্যদের প্রতি অভিযোগের তীর নিক্ষেপ চলছে।

এমন অবস্থায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সহ রাজপথের আন্দোলনে একইভাবে সেনাসদস্যদের অভিযুক্ত করার প্রেক্ষিতে ফেসবুকে "বাংলাদেশ আর্মি ম্যাগাজিন" নামের এক পেজে তনু হত্যার বিচারের দাবি জানিয়ে দেশের প্রতি সেনাবাহিনীর বিভিন্ন উদ্যোগের কথা উল্লেখ করা হয়।

সংশ্লিষ্ট পেজে পোস্টদাতার নাম উল্লেখ করা না কোনো এক সেনাসদস্যদের পক্ষ লেখা হয়েছে ধারণা করা হয়।  এবং সে লেখাটি এক ব্রিগেডিয়ার জেনারেলের গাড়িতে প্রতিবাদি পোস্টার লাগানোর সূত্র ধরেই।

ফেসবুক পোস্টের বিস্তারিত-

আপনি একজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেলের গাড়ির কাঁচের উপর সেনাবিরোধী পোষ্টার লাগিয়ে দিলেন।খুব সাহস এবং সম্মানের কাজ করলেন। বাহবা না দিয়ে পারছি না। কারণ আপনার গায়েও খাঁটি দেশপ্রেমিকের তকমা লেগে গেল।

এখন যদি প্রশ্ন করি কেন এই কাজটা করলেন?

তনু হত্যার আসামীরা যাতে যথোপযুক্ত শাস্তি পাক এইজন্যই তো??

আরে ভাই, শুধু একজন সেনাকর্মকর্তা হিসেবে নয়, একজন বুদ্ধিমান এবং সচেতন দেশপ্রেমিকের মত আমিও তো তনু হত্যার পিছনে দায়ী সবার যথোপযুক্ত শাস্তি চাই। সেনাবাহিনীর প্রত্যেক সদস্যই চায়, অপরাধী যেই হোক না কেন সে যেন সর্বোচ্চ শাস্তি পায়।

আপনি আজকে সেনাবাহিনীর একজন কর্মকর্তার গাড়িতে পোষ্টার লাগিয়ে তো নিজেকেই অপমান করলেন। আপনি কি একবারের জন্য হলেও চিন্তা করেছেন সেই কর্মকর্তার মনের অবস্হা, যেই কর্মকর্তা গত ২৫-৩০ বছর ধরে দেশের সেবা করে যাচ্ছেন।

আপনি নিজেকে অপরাধী না ভাবলেও তিনি নিশ্চয়ই আজ নিজেকে অপরাধী ভাবছেন, কারণ তিনি তো সারাজীবন দেশের সেবা করার জন্য, দেশের প্রয়োজনে জীবন বিলিয়ে দেবার প্রতিজ্ঞা করেই বন্ডে সাইন করে সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিল। আজ তার মনে হবে আরও অনেক অপরাধের কথা।

পার্বত্য চট্রগ্রামের দুর্গম পাহাড়ে দায়িত্ব পালনের খাতিরে তার প্রথম সন্তান জন্মের সময় উপস্থিত থাকতে পারেন নি বলে পরিবারের কাছে আজও তিনি অপরাধী।

আফ্রিকার গহীন জংগলে শান্তিরক্ষা মিশনে নিয়োজিত থাকার কারণে তার ছেলেমেয়েদের জন্মদিনে উপস্থিত থাকতে পারেন নি বলে আজও তার কষ্ট হয়।

পিলখানার ভিতরে সহকর্মীদের হত্যা করা হচ্ছে জেনেও অস্ত্র হাতে নিয়ে পিলখানার গেইটে দাঁড়িয়ে অসহায়ের মত অস্ত্রু বিসর্জন দিয়েছেন, শুধুমাত্র ভিতরে যাবার পারমিশন হয় নি বলে।

দেশের ডাকে, সরকারের ডাকে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে যোগ দিয়েছেন, সিডরে ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের ত্রানসামগ্রী নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, বন্যাদুর্গত মানুষের সাহায্যের জন্য ছুটে গিয়েছেন দেশের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে, রানা প্লাজায় উদ্ধার অভিযানে গিয়ে ৪০ ফিট গর্তে ঢুকে পড়েছেন ফিরে আসতে পারবেন কিনা না জেনেও, ফ্লাইওভার নির্মাণ করেছেন, কনস্ট্রাকশন কোম্পানী ঢাকা- ময়মনসিংহ মহাসড়কের কাজ শেষ না করেই টাকা নিয়ে ভেগে গেছে বলে অসমাপ্ত রাস্তার কাজ করে যাচ্ছেন, বিদেশী কোম্পানী ন্যাশনাল আইডি কার্ড প্রজেক্টে শত শত কোটি টাকা দাবি করলে দেশের টাকা বাঁচানোর জন্য গ্রামে গ্রামে ঘুরে করে দিয়েছেন ন্যাশনাল আইডি কার্ড।

এত এত কাজের জন্য সে তো আপনাদের কাছে এই ব্যবহার পেতেই পারে, কারণ আপনারা তো দেশপ্রেমিক, আর আমরা জনগণের ট্যাক্সের টাকা মেরে খাই।

জি ভাই, আমরা জনগণের ট্যাক্সের টাকা থেকে বেতন পাই। আরে ভাই, সরকারী চাকরি করে বেতন নেন না, দেখান তো একজনকে। সরকারী চাকরি করে বেতন না নিলে পরিবারকে খাওয়াবেন কি??

আমরা সরকারী বাসা পাই, সরকারী গাড়িতে চড়ি, ক্যান্টনমেন্টে থাকি। আরাম আর আরাম। আপনি কি জানেন, বাংলাদেশের প্রজাতন্ত্রের সকল কর্মকর্তা এবং কর্মচারীকে সরকারের বাসা বরাদ্দ দেয়ার কথা। সরকার যদি বাসা দিতে না পারে, তবে নিয়ম অনুযায়ী এলাকাভেদে ৪৫-৬৫% বাসা ভাড়া দিবে। আমি যদি বাসা ভাড়া না নিয়ে সরকারী বাসায় থাকি আর যোগাযোগ ভাতা না নিয়ে সরকারী গাড়ি ব্যবহার করি সেটা আমার জন্য বাড়তি সুবিধা হলো কিভাবে একটু বুঝিয়ে বলুন তো?

ইউ এন মিশনে কাড়ি কাড়ি টাকা পাই। জি ভাই, আমি গত তের মাস মিশনে থেকে ১৯ লাখের মত টাকা পেয়েছি।আমার জন্য অবশ্যই কাড়ি কাড়ি, কারণ গত ছয় বছর চাকরি করে ৫ লাখ টাকা ধার করেছিলাম, সেগুলো শোধ করতে পেরেছি। আপনিও পরিবার পরিজন ছেড়ে ১৩ মাস আফ্রিকার জঙ্গলে ১০ কেজি ওজনের বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট গায়ে জড়িয়ে ৪৫-৫০ ডিগ্রী তাপমাত্রায় ২৪ ঘন্টা মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে থেকে আসেন এবং তারপর আপনার কত টাকা পাওয়া উচিত বলে একটা ফেইসবুক স্ট্যাটাস দেন। আমি আমার ইউএন মিশনের উপার্জন করা সমস্ত টাকা আপনাকে দিয়ে দিব।

জী ভাই, বাংলাদেশের সেনারা অনেক সস্তা, তাই ইউ এনে এদেরকে নেয়া হয়। ভাইরে, ইউ এন তো খোলাবাজারে নিলাম করে সেনাবাহিনী শান্তিরক্ষা মিশনে পাঠায় না যে কম দামে বাংলাদেশ শান্তিরক্ষী সরবরাহ দিবে। পৃথিবীর সকল শান্তিরক্ষীর বেতন সমান, সে ইউএস এর হোক, ফ্রান্সের হোক কিংবা বাংলাদেশের হোক। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তাদের পেশাদারিত্ব, শৃংখলা, দায়িত্ববোধ আর দেশের সম্মান রক্ষায় বদ্ধপরিকর বলেই জাতিসংঘে সম্মানের সাথে টিকে আছে যারা বাংলাদেশের পতাকা সর্বদা শুধু মনে না, পোষাকেও বড়ে বেড়ায়।

আপনারা তো আমাদেরকে জনগণের টাকায় বানানো ক্যান্টনমেন্টে ঢুকতে দেন না। জী ভাই, আপনি বলেন তো সচিবালয়, সরকারী অফিস কি জনগণের টাকায় বানানো না?? তাহলে সেখানে আপনি অবাধে ঢুকতে না পারলে ক্যান্টনমেন্টের উপর এত বিরক্ত কেন??

সেনানিবাসের মাঝদিয়ে বয়ে যাওয়া মহাসড়কের পাশে কালভার্টের নিচে তনুর লাশ পাওয়া গেল বলে আপনি সেনাবাহিনীকে খুনি আর ধর্ষক বানাই দিলেন, আর আসামী কেন ধরা পরলো না সেই জন্যও সেনাবাহিনীকে দোষারোপ করলেন। বলেন তো, কোন খুনের আসামীর বিচার করা কি সেনাবাহিনীর কাজ? আর সেনাবাহিনী কি কখনো খুনের আসামী ধরতে পারে? আরে ভাই, এটা তো পুলিশের কাজ। যেহেতু ক্যান্টনম্যান্টের পাশে লাশ পাওয়া গেছে, তাই সেনাবাহিনী খুনের তদন্তে পুলিশকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করছে। তদন্ত শেষ হতে দিন, সেনাবাহিনীর কেউ দোষী হলে তার শাস্তি হবে না, তা কি আপনাকে কোন সেনা কর্মকর্তা সংবাদ সম্মেলন বলছে নাকি??

তদন্তে কেন দেরী হচ্ছে তাতেও তো সেনাবাহিনীর দোষ?? ফরেনসিক রিপোর্ট এখনো হাতে আসে নি, ফরেনসিক রিপোর্ট কি সেনাবাহিনী বানায় নাকি??

আমিও আজ নিজেকে অপরাধী ভাবছি, কারণ দেশসেবা করবো বলে আমিও তো শপথ নিয়েছি, আদর্শ সৈনিক হবার জন্য ট্রেনিং এ নিজের হাত ভেঙেছি, মাথা ফাটিয়েছি, প্যারা জাম্পে অংশ নিয়ে নিজের পা মচকে গিয়েছে বলে এখনও সেই ব্যথা নিয়ে চাকরি করে যাচ্ছি।আমি তো আমার দেশের জনগণের কাছে এই ব্যবহার পেতেই পারি!!!!

সেনাবাহিনীর সদস্য দেড় লক্ষাধিক। আমরা তো ভিন দেশী কোন জন্তু না।আমরা তো ফেরেশতা না। আপনার সন্তান, ভাই, বোন, চাচা, মামাই তো আমরা। আমি আপনি মিলেই তো বাংলাদেশ। আমরা সবাই মিলেই তো পুরো বাংলাদেশকে বিশ্বের কাছে রিপ্রেজেন্ট করি। দেশ বিরোধী অপশক্তির রিউমারে আর সস্তা জনপ্রিয়তা লাভের উদ্দেশ্যে দেওয়া ফেসবুক স্ট্যাটাসকে বিশ্বাস করে কোন মন্তব্য করার আগে সত্যকে জানুন এবং নিজের বিবেককে প্রশ্ন করুন। আপনারা আমরা সবাই তনু হত্যার বিচার চাই, কিন্তু সেনাবাহিনীর গোষ্ঠী উদ্ধার করছেন কেন???

আপনার মন্তব্য

আলোচিত