সোশ্যাল মিডিয়া ডেস্ক

০৮ মে, ২০১৬ ০২:০৫

‘কোনো শাস্ত্র সংবেদনশীলতা উৎপাদন করবে না’

টুকে রাখা কথামালা শিরোনামের ধারাবাহিক সংক্ষিপ্ত বয়ানের আড়ালে বিস্তৃত চিন্তার খণ্ড ভাবনার এ পর্যায়ে কথাসাহিত্যিক স্বকৃত নোমান সংবেদনশীলতা বিষয়ে কিছু অন্তর্ভেদী চিন্তাপ্রকাশে প্রশ্ন রেখে কিছু উত্তর খোঁজার পর্যায়ে লিখেছেন,  তোমার কিন্তু একটা সংবেদনশীল মন থাকা চাই, যদি তুমি লিখতে চাও।

রোববার (৮ মে) ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে স্বকৃত নোমান লিখেছেন, তুমি কি ভাবছ বই পড়ে সংবেদনশীল হতে পারবে? এটা তোমার ভুল ভাবনা। সংবেদনশীলতা কিন্তু প্রকৃতিপ্রদত্ত। কোনো শাস্ত্র এই সংবেদনশীলতা তোমার মধ্যে উৎপাদন করবে না। তোমার মধ্যে এর বীজটা থাকা চাই। বই আর বিশ্বপ্রকৃতির গভীর পাঠ ঐ বীজকে বৃক্ষে রূপান্তরিত করে।

স্বকৃত নোমানের লেখার বিস্তারিত-

তোমার কিন্তু একটা সংবেদনশীল মন থাকা চাই, যদি তুমি লিখতে চাও। তুমি মান্নান শেখের কথা শুনেছ নিশ্চয়ই? সেই যে গাওদিয়ার মান্নান শেখ, উপনিষদীয় জন্মান্তরবাদের কথা বলতে গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে যার শীর্ণ বুকটা চোখের জলে ভাসিয়ে দেয়। মান্নান শেখ হয়ত উপনিষদে বিশ্বাস করে না, জন্মান্তরবাদের কথা যে উপনিষদে আছে, হয়ত তা জানেও না। কিন্তু বিষয়টা তাকে ভাবায়। তাকে স্পর্শ করে। তাই সে চুরাশি লক্ষ যোনী ভেদ করে মানুষ হয়ে ওঠার সেই অলীক কাহিনি বলতে গিয়ে কাঁদে। মনে রেখো, জন্মান্তরবাদ হয়ত মিথ্যা, কিন্তু তার কান্না সত্য। সে-ই কিন্তু প্রকৃত সংবেদনশীল।

তুমি বরং তার কাছে যাও। হাঁটুগেড়ে বসে থাক তার পায়ের কাছে। তার মৃত্তিকালগ্ন দার্শনিকতাকে উপলব্ধি করো। দেখবে, তোমার সামনে খুলে যাবে এমন এক জানালা, যে জানালা দিয়ে তুমি দেখতে পাচ্ছ জীবনের সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম বহু বিষয়কে। ভারতবর্ষীয় সুফিগণ এই জানালাকেই বলতেন ‘কাশফ্’। কাশফ খুলে যাওয়া। অর্থাৎ সিনা খুলে যাওয়া। সিনা খুলে যাওয়া মানে বুক খুলে যাওয়া। বুক মানে কিন্তু চোখ। অর্থাৎ তোমার তৃতীয় চোখের উন্মীলন ঘটবে। ঐ চোখ দিয়ে তুমি এমন দেখা দেখবে, যা চরম দেখা। সাধারণগণ কিন্তু পৃথিবীকে দেখে নিচ থেকে। তোমার ঐ তৃতীয় চক্ষু দিয়ে তুমি পৃথিবীকে দেখবে উপর থেকে। এই চোখের এমনই কারিশমা!

তুমি কি ভাবছ বই পড়ে সংবেদনশীল হতে পারবে? এটা তোমার ভুল ভাবনা। সংবেদনশীলতা কিন্তু প্রকৃতিপ্রদত্ত। কোনো শাস্ত্র এই সংবেদনশীলতা তোমার মধ্যে উৎপাদন করবে না। তোমার মধ্যে এর বীজটা থাকা চাই। বই আর বিশ্বপ্রকৃতির গভীর পাঠ ঐ বীজকে বৃক্ষে রূপান্তরিত করে। তুমি কিভাবে বুঝবে বীজটা বৃক্ষে রূপান্তরিত হয়েছে? ফুলের কাছে যাও; তার গন্ধ কি তোমাকে মাতোয়ারা করে? প্রেমিকার খোঁপায় নাক গুঁজে দাও; তোমার মধ্যে কি বেঁচে থাকার স্বাধ জাগে? রবীন্দ্রনাথের গান শোনো; বুকের মধ্যে কি কোনো এক হাহাকার জেগে ওঠে?

সমুদ্রের কাছে যাও; তার বিশালত্বের সামনে দাঁড়িয়ে কি তুমি অস্তিত্বের শূন্যতা অনুভব করো? ভরা পূর্ণিমায় ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হও; জোছনার মাধুরী কি তোমাকে উন্মাতাল করে দেয়? নদীর সামনে গিয়ে দাঁড়াও; তুমি কি বিশ্বপ্রকৃতির গোপন ডাক শুনতে পাও? মধ্যরাতে বংশীয়ালের সুর শোনো; তোমার ভেতরে অন্য একটা মানুষ কি বিলাপ করে কাঁদে? মানুষের চোখের দিকে তাকাও; চোখ দেখে কি তার অন্তর্জগতকে পাঠ করতে পারছ?

উত্তর কি হ্যাঁ? অভিনন্দন তোমাকে। তোমার ভেতরের ঐ বীজটা বৃক্ষে রূপান্তরিত হয়েছে। তাকে মহীরূহ হতে দাও। তার যত্ন করো। এই কথা মনে রেখো, অযত্ন-অবহেলায় বৃক্ষটা কিন্তু মরেও যেতে পারে। তার মৃত্যুর বহু কারণের মধ্যে অতিরিক্ত বৈষয়িক আকাঙ্ক্ষা কিন্তু প্রধান। তুমি তো বৈরাগী, তোমার আবার বৈষয়িক প্রাপ্তি কী? যদি প্রাপ্তি ঘটে যায় সেটাকে তুমি স্রেফ দুর্ঘটনাই মনে করবে। তুমি কি সেই বাণী শোননি : তুমি অর্থের পেছনে ছুটবে না, অর্থই তোমার পেছনে ছুটবে। কে বলেছিল কথাটা জানো? একজন আধা-বৈরাগী, যে তোমারই জন্মদাতা।

আর তুমি তো পূর্ণ বৈরাগী। নইলে পৃথিবীর সব মানুষ যার পেছনে ছুটে, অর্থ, তুমি তার পেছনে ছুটো না কেন? এই জন্য যে, তুমি একজন ধ্যানী ঋষি। পৃথিবীর সব কিছুর মধ্যে থেকেও কিন্তু তুমি নেই। তুমি ধ্যানস্ত হয়ে আছ সেই পরম প্রাপ্তির জন্য, যা পেয়েছে তোমার পূর্বজ ঋষিগণ। তুমি তো তাদেরই পদাঙ্ক অনুসারী। এও জেনে রেখো, তোমার ধ্যান ভাঙানোর জন্য এই প্রাচীন পৃথিবী রঙিন পোশাকে সেজে ঠোঁট রাঙিয়ে বারবার তোমার সামনে হাজির হবে। তোমাকে প্রলোভনের জালে আটকাতে চাইবে।

তুমি তার প্রলোভনে পা দিয়েছ তো তোমার পতন অনিবার্য। অর্থাৎ তোমার ভেতর থেকে লেখকসত্তাটা হারিয়ে যাবে। তুমি আর কখনোই তাকে খুঁজে পাবে না। তাই তাকে প্রত্যাখ্যান করো। প্রত্যাখ্যান করতে করতে তাকে তুমি হতাশার সমুদ্রে নিক্ষেপ করো। সে হাবুডুব খাক, তুমি এগিয়ে যাও তোমার লক্ষ্যের দিকে। তোমার জয় সুনিশ্চিত। সামনে তাকিয়ে দেখো, তোমাকে অভিনন্দন জানানোর জন্য লক্ষ-কোটি হাত উর্ধ্বে উঠে আছে।
টুকে রাখা কথামালা। ৭.৫.২০১৬

আপনার মন্তব্য

আলোচিত