সোশ্যাল মিডিয়া ডেস্ক

১১ জুন, ২০১৬ ১৩:৫৫

‘প্রাণ বাঁচানোর সুযোগ থাকলে কোন মানুষই শেকড়চ্যুত হয় না’

সাম্প্রদায়িক সহিংসতার কারণে উপমহাদেশের মানুষদের স্বদেশ ত্যাগের পেছনের কারণ নিয়ে বাম তাত্ত্বিক বদরুদ্দিন উমরের কলাম ও সাংবাদিক ফারুক ওয়াসিফের ফেসবুক স্ট্যাটাসে দেয়া ব্যাখ্যার সমালোচনা করে ব্লগার হাসান মোরশেদ তাঁর ফেসবুকে লিখেছেন, "বাংলাদেশের নির্যাতিত হিন্দু কেনো ভারতে যায়? ভারতের নির্যাতিত মুসলমানের পাকিস্তান বা বাংলাদেশে এসে পরিত্রাণের সুযোগ নেই, বাংলাদেশের নির্যাতিত হিন্দুর ভারতে গিয়ে অন্তত: জান বাঁচানোর সুযোগ আছে। হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান-নিধার্মিক কোন মানুষই তার শেকড়চ্যুত হয়না যতক্ষণ তার প্রাণ আর সম্মান বাঁচানোর ন্যুনতম কোন সুযোগ থাকে।"

হাসান মোরশেদের ফেসবুক স্ট্যাটাসের বিস্তারিত:

বদরুদ্দিন উমরের কলাম এবং ফারুক ওয়াসিফের ফেসবুক স্ট্যাটাস পড়ে যা বুঝলাম- বাংলাদেশের হিন্দুরা আসলে বাংলাদেশের প্রতি বিশ্বস্ত না, যেমন ভারতের মুসলমানরা ভারতের প্রতি বিশ্বস্ত। হিন্দুদের হাতে মাইর খেয়ে ভারতের মুসলমানরা তো পাকিস্তানে যায়না, বাংলাদেশে আসেনা- তাহলে বাংলাদেশের হিন্দুরা কেনো ভারতে যায়, আসলে ওরা ভারতকেই নিজের দেশ মনে করে। ঊমর বা ওয়াসিফ শুধু না, প্রগতিশীল বলে কথিত এদেশের বহু মানুষের চিন্তার ধারা এটিই, সাম্প্রদায়িক হিসেবে চিহ্নিতদের কথা বলাবাহুল্য।

তো, ভারতের মুসলমানরা ও মাইর খায়- ভালোই মাইর খায়, গুজরাটে ম্যাসাকার হয়, সামাজিকভাবে প্রায় অস্পৃশ্যই থাকে অনেক জায়গায়। বই পড়ে, প্রোপাগান্ডা শুনে না- নিজের চোখে দেখা, ভারতে থেকে উপলব্ধি করা। তাহলে ভারতীয় মুসলমানরা ভারত ছাড়ে না কেনো? বিরাট দেশ প্রেমিক, বিশাল সব ফাইটার বলে?


জ্বিনা- ঘটনা অতো সরল না। সে যাবে কোথায়? ভারতের মুসলমানদের ভাষা ও সাংস্কৃতিকভাবে ঘনিষ্ঠতা পাকিস্তানের সাথে, বাংলাদেশের সাথে না। ইনফ্যাক্ট বাংলাদেশের মুসলমানদের বড় অংশকে তারা 'গাদ্দার' বলেই ভাবে- পেয়ারা পাকিস্তান ভাঙ্গার অপরাধে। পাকিস্তানে কেনো যায়না ভারতীয় নির্যাতিত মুসলমানরা? যায়না- কারণ মুসলমানিত্বের ধোঁয়া তুলে বানানো পাকিস্তান রাষ্ট্র গত ৭০ বছরে ও ভারত থেকে যাওয়া মুসলমানদের আপন করে নেয়নি। করাচী শহরে এখনো বিহারীরা- বহিরাগত, বোমা গুলী আর সন্ত্রাসের শিকার প্রতিদিন। তাদেরই আরেক অংশ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যার শরীক হয়ে ও ধোঁকা খেয়েছে- আটকে পড়া পাকিস্তানী হিসেবে অপাংক্তেয় হয়ে আছে বাংলাদেশে। ভারতীয় মুসলমানরা জানে, পাকিস্তানে তাদের জন্য ভালো কিছু অপেক্ষায় নেই।

বাংলাদেশে ও তারা আসবেনা কারণ এখানে ভাষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি- সবই তার জন্য বিরূপ।

'৪৭ এ যখন দেশভাগ হয় ধর্মের ভিত্তিতে পূর্ববাংলা/ পূর্ব পাকিস্তান থেকে উচ্চ বর্ণের হিন্দুরা দেশ ত্যাগ করেছিলো- নিম্ন বর্ণের হিন্দুরা করে নাই। কারণ নিম্ন বর্ণের হিন্দুর কাছে উচ্চ বর্ণের হিন্দুর তুলনায় মুসলমানরা স্বজন ছিলো। মুসলমানদের মতো তারা ও নির্যাতিত ছিলো উচ্চবর্ণের হিন্দুদের দ্বারা। এক সময়ের নির্যাতিত মুসলমানরা যখন আরামসে উচ্চবর্ণের হিন্দুদের পিটিয়ে দেশ ছাড়া করলো এবং দেখলো নতুন রাষ্ট্র ও এতে আগ্রহী তখন অত্যাচারের কাটা এবার ঘুরতে শুরু করলো একই অর্থনৈতিক শ্রেণীর নিম্নবর্ণের হিন্দুদের দিকে। এদিক দিকে মুলতঃ ব্যাপক হারে দেশ ত্যাগ শুরু হয় ১৯৫০ এর দিকে। তারপর ১৯৬৫। তারপর ১৯৭১।

মুক্তিযুদ্ধের কোন পরিসংখ্যানেই আলাদাভাবে হিন্দু-মুসলমান চিহ্নিত করা শোভন নয়, তবু যদি এটা আলাদা ভাবে হিসাব করা হয় তাহলে দেখা যেতে পারে- পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে নিহত বাঙ্গালীর কতো অংশ ছিলো হিন্দু জনগোষ্ঠীর? হিন্দু এবং মুসলমানরা মিলেই এদেশের জন্য যুদ্ধ করেছে, প্রাণ দিয়েছে কিন্তু ঐতিহাসিক সত্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রাথমিক টার্গেট ছিলো আওয়ামী লীগের কর্মী ও হিন্দু। হিন্দুদের প্রতি সহানুভূতি সম্পন্ন মুসলমানদের ও হত্যা করেছে, তারপর যখন অলআউট যুদ্ধ শুরু হয়েছে তখন আর হিন্দু মুসলমান আলাদা বাছ বিচার করেনি। হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামগুলো ধর্মীয় পরিচয়ের কারণেই গণহত্যার শিকার হয়েছে, গোটা গ্রাম লুট হয়ে গেছে।

ফিরে আসি মুল প্রসঙ্গে, বাংলাদেশের নির্যাতিত হিন্দু কেনো ভারতে যায়? ভারতের নির্যাতিত মুসলমানের পাকিস্তান বা বাংলাদেশে এসে পরিত্রাণের সুযোগ নেই, বাংলাদেশের নির্যাতিত হিন্দুর ভারতে গিয়ে অন্তত: জান বাঁচানোর সুযোগ আছে। হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান-নিধার্মিক কোন মানুষই তার শেকড়চ্যুত হয়না যতক্ষণ তার প্রাণ আর সম্মান বাঁচানোর ন্যুনতম কোন সুযোগ থাকে।

কেউ কি এই প্রশ্নটা উত্থাপন করেন- মুক্তিযুদ্ধকালে যুদ্ধের শিকার বাঙ্গালী মুসলমান কেনো নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলো?

আপনার মন্তব্য

আলোচিত