সোশ্যাল মিডিয়া ডেস্ক

১৩ জুন, ২০১৬ ১৬:৪৮

‘স্নেহার স্কুল ব্যাগে পথচারীরা ঢুকিয়ে দেন বাবার ক্ষত-বিক্ষত মগজ’

গত ৭ জুন নগরীতে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন স্কলার্সহোম স্কুল এন্ড কলেজের প্রাসশনিক কর্মকর্তা অরিজিৎ রায় ও তাঁর স্ত্রী শিক্ষিকা সুনিতা দাস। গুরুতর আহত হলেও প্রাণে বেঁচে যায় তাদের একমাত্র কন্যা অরুনিমা রায় স্নেহা। দুর্ঘটনাটি এতটাই মর্মান্তিক ছিল যে, ঘটনাস্থলে নিহত হওয়া অরিজিৎ রায়ের মগজ বেরিয়ে যায়। পথচারিরা সেটা তোলে মেয়ে স্নেহার স্কুল ব্যাগে ঢুকিয়ে দেন।

নিহত সুনিতার ভাই সংস্কৃতিকর্মী ধ্রুব গৌতম আকস্মিক দুর্ঘটনার এক সপ্তাহ পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বোনের স্মৃতি, এক সপ্তাহে তাঁর পরিবারের উপর দিয়ে যাওয়া দুর্বিপাকের কথা বর্ণনা করেছেন।  

ধ্রুব এই ঘটনার জন্য আবারও প্রাইভেটকারের মালিক মোহাম্মদ মিনুর শাস্তি দাবি করেছেন। মিনুই বেপোরয়া গাড়ি চালিয়ে এই হতাহতের ঘটনা ঘটান কিন্তু পুলিশ তাকে ধরেও ছেড়ে বলে অভিযোগ করেন ধ্রুব।

ধ্রুব লিখেছেন:

বাবা-মায়ের প্রথম সন্তান শম্পা। পম্পার জন্ম পরে। শারীরিক অসুস্থতায় পম্পার স্থায়িত্ব দীর্ঘ হলো না ধরণীতে। পরে যখন ঝম্পা আসল তখনতো মামাবাড়ির দুশ্চিন্তা বেড়ে গেলো। একটাতো গেছে এখন যদি এটাও......। এ কারণে দাদু বেয়াইর কাছ থেকে মা-মেয়েকে নিয়ে গেলেন তাঁর গ্রামের বাড়ি মুন্সি বাজারের মুন্সিবাড়িতে। শুরু হয় ঝম্পা’র সেবা-যত্ন আদর-সোহাগ। মামার বাড়ির দেয়া “ঝম্পা“ নামটা সবাই ভুলে গেলেও ওর সেজমামা সাংবাদিক মৃণাল চৌধুরী আজও তাকে এ নামেই ডাকেন। সেই আদরের ঝম্পা আজকের সুমি...........সুধিজনের সুমিতা দাস।

সব সন্তানের মত সুমিরও পড়ালেখা গান বাজনার হাতেখড়ি মায়ের হাতে। লেখাপড়ার পাশাপাশি হারমনিয়মের রীডে স্বরলিপি চেনা, স্বরের মাঝে সুরের মিষ্টতা দেয়া, স্কেলের সাথে কণ্ঠের যোগাযোগ সে মায়ের কাছেই শিখেছে। প্রতিটি সন্ধ্যায় মা তার সন্তানদের নিয়ে গাইতেন “ভব সাগর তারন কারণ হে.......... প্রভু দেব দয়া কর দীনজনে, আবার বাজাও তোমার পাঞ্চজন্য, অন্তর মম বিকশিত কর অন্তর তর হে ইত্যাদি। মামা-মাসীর কুমার পাড়া বাসায় গেলে নিগমানন্দের প্রার্থনা হত “আমার আমিত্বটুকু যতদিন আছে, শুধু দিতে চায় প্রাণ নিতে নাহি যাচে, প্রভু দিতে দিতে সব যেন ফুরাইয়া যায়...”।

তারপর নূপুর সঙ্গীতালয়ে ওস্তাদ হোসেইন আলীর কাছে তালিম নেয়া। খোকন সোনা রাগ করেছি...মামণি তাই খেতে দিলেন সরভাজা আর দই, কোকিল কোকিল কালো কোকিল গান শোনাবে কি ? খোকন সোনা মান করেছে মান ভাঙ্গাবে কি ?, কে বিদেশী মন উদাসী বাঁশের বাঁশি বাজাও বনে ইত্যাদি গান হারমনিয়ম বাজিয়ে গাইত অবলীলায়। শিশু একাডেমী, শিল্পকলা একাডেমী, আনন্দলোক ছিলো তার সঙ্গীত শিক্ষার আশ্রম।

লেখাপড়ার প্রতি পরিবারের অন্যদের থেকে সুমির আগ্রহ আনুপাতিক বেশী থাকায় বাবা-মাও যথাসাধ্য সহযোগিতা করেছেন তাকে যোগান দিয়ে। অষ্টম শ্রেণীতে বৃত্তি ও এসএসসিতে মানবিক থেকে ক’টা বিষয়ে লেটার মার্কসসহ মানবিক বিভাগে ফাস্ট ডিভিশনে পাশ করেছিলো অগ্রগামী থেকে। জিতেন স্যারের ইংরেজি শিক্ষা তাকে এ সাফল্যের পাথেয়। মহিলা কলেজে ইন্টার, এমসিতে রাষ্ট্রবিঞ্জান বিষয়ে সম্মান ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একই বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করে।

প্রাইভেট টিউশনি করে ও নিজের লেখাপড়া ও সঙ্গীতশিক্ষার খরচ চালিয়েছে সে। পিতৃপুরুষের দান করা বিদ্যাপীঠ মদন মোহন কলেজে শিক্ষকতার সুযোগ না পেয়ে ওসমানী মেডিকেল কলোনি আদর্শ স্কুল, সুনামপুর সপ্রাবি ও মহালক্ষী সপ্রাবিতে শিক্ষকতা করে।

দাম্পত্য জীবনে এক সন্তানের জননী ছিলো সুমিতা। সন্তানটিই ছিলো তাদের ধ্যান-জ্ঞান। বাঘের বাচ্চা একটাই যথেষ্ট বলে এই এক সন্তানকে মানুষ করতে নানা কর্মপ্রচেষ্টা।

রমজানের ছুটি শুরু সেদিন থেকে। তবুও উপ-বৃত্তির কাজে স্কুলে যাবার জন্য তৈরি হয়। মেয়ের ক্লাস সিফটিং এর জন্য বাবা-মেয়েও তৈরি হয়ে একত্রে রওয়ানা দেন গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। বিধি বাম। বিপরীত থেকে মেয়ের সহপাঠীর বাবা সৌখিনতাবশত: নতুন গাড়ী চালিয়ে রং সাইডে এসে আঘাত করেন সুমিদের ফোরস্ট্রোকে। সাথে সাথেই প্রাণ হারান স্বামী অরিজিৎ রায়। সুমি হাসপাতালে যাবার পথে, মেয়ে বেঁচে থাকলেও মারাত্মক আহত হয়।

দুমড়ে মুচড়ে গেছে সিএনজি, অলৌকিকভাবে বেঁচে গেলো যক্ষের ধন মেয়েটি। ওর সারা শরীরে মৃত বাবা আর অর্ধমৃত মায়ের শরীরের রক্ত আর বাবার মাথার খুলি থেকে বেরিয়ে আসা বিক্ষিপ্ত মগজের অংশ বিশেষ। স্কুলের বইয়ের ব্যাগের ভিতর পথচারীরা ঢুকিয়ে দেন বাবার গলিত ক্ষত-বিক্ষত মগজ। অর্ধমৃত সুমিতা কার থেকে বেরিয়ে আসা হত্যাকারী ড্রাইভারকে দেখেই চিনে ফেলে, বলে “আপনিতো ঈশার বাবা”। শুনে ফেলে আশপাশের লোকজন। নেহাত ভদ্রলোক দেখে জনগণ উত্তম-মধ্যম না দিয়ে হত্যাকারীকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। পুলিশও আসামীকে ভ্যানে করে হাসপাতাল ঘুরে থানায় নিয়ে আসে।বিকালেই পট পরিবর্তন ঘটে। পুলিশ ছেড়ে দেয় সুমি-অরিজিৎ হন্তারক মোহাম্মদ মিনুকে।

হাসপাতালের বেডে শুয়ে কাটে স্নেহার দিন-রাত। বাবা-মাকে খুঁজতো এতোদিন। মোবাইল চাইত বাবা-মাকে কল করার জন্য, মাসীমণি সান্ত্বনা দিত তার বাবা-মা তার চেয়েও বেশী অসুস্থ, চিকিৎসা চলছে বলে। দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনলেই ঘাড় বাকিয়ে দেখতো কে এসেছে, না তার বাবা-মা আসেনি। যে চোখ দিয়ে পৃথিবী দেখেছে সে চোখ আজ রক্তাক্ত, যে হাত দিয়ে বা-মাকে জড়িয়ে ধরেছে সে হাতের হাড় ক্ষত। যে গালে বাবা-মার আদর মাখা সে গালের ক্ষত স্থান সেলাই করা, শারীরিক অবস্থার অবনতি না হলেও উন্নতি হচ্ছে ধীরে ধীরে। বন্ধুরা যখন ওদের বাবা মায়ের সাথে ওকে দেখতে আসে, তখন তাঁর চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয় তারই চোখের জলে, কারণ তার যে বাবা মা জীবিত নেই সেটা সে জেনে গেছে। তার বাবা-মা আর তাকে এমন করে নিয়ে বেরুবে না, কোলে করে ঘুরবে না। স্কুলে কার সাথে যাবে, কার কাছে থাকবে, এমন প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করছে আমাদের। আগামী অনিশ্চিত ভেবে একা একা ডুকরে ডুকরে উঠে। “বাবা” বলে যখন সুতীব্র চিৎকারে কেঁদে উঠে তখন বিওগলের  ঘণ্টা যেনো বেজে উঠে অসহ্য যন্ত্রণায়।

ওর মাসীমণি আজ ওর প্রাণ, ওর বেঁচে থাকার অবলম্বন। কথায় কথায় মাসীমণি.....মাসীমণি। দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাচ্ছে এ দুর্ভাগা আদরিনি।চুলে ঝুটি বেঁধে দেয়া, ওষুধ খাওয়ানো, গল্প করা সব কাজে মাসীমণি।

বিচ্ছিন্ন কটা প্রাণকে একসুঁতোয় বেঁধে দিয়েছে মেয়েটি। ওর পলকহীন নিটল চোখ হাজার প্রশ্ন ছুড়ে দেয় সবার মাঝে। যখন জেনেছে তখনই বলেছে “ঈশার বাবা আমার বাবা-মাকে মেরেছে”। মেয়েটির চাক্ষুষ এ ঘটনা কখনো মন থেকে মুছার নয়।

স্নেহা আজ ওর বাবা-মা’র হন্তারকের দৃষ্টান্তমূলক কঠিন বিচার চায়। ওর বাবা-মা ফিরে না আসলেও আর কোন স্নেহা যেন এভাবে বাবা-মাকে না হারায়, এ তার প্রথম আর শেষ চাওয়া।



 

 

আপনার মন্তব্য

আলোচিত