০৩ নভেম্বর, ২০২৩ ০০:০১
সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (সিকৃবির) কর্মকর্তা এবং কর্মচারী নিয়োগ পরীক্ষায় ব্যাপক অনিয়ম, দুর্নীতির অভিযোগ ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ উঠেছে। খোদ সিকৃবির উপাচার্য অধ্যাপক ডা. জামাল উদ্দিন ভুঞার বিরুদ্ধেই ওঠেছে এ অভিযোগ।
সিকৃবিতে গত ২৫, ২৬ ও ২৭ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হয়েছে কর্মচারী পদের নিয়োগ পরীক্ষা। সেই পরীক্ষায় বিভিন্ন পদে আবেদনকারীদের লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হয়ে মৌখিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ, পরিচ্ছন্নতা কর্মী ও নিরাপত্তা প্রহরী পদে আবেদনকারীদের পরীক্ষা না নেওয়া, পরীক্ষার খাতা দেখায় স্বেচ্ছাচারিতাসহ বেশ কয়েকটি অভিযোগ উঠেছে। পাশাপাশি ‘তুচ্ছ কারণ দেখিয়ে’ শেষ মুহূর্তে স্থগিত করা হয় অফিসার পদের নিয়োগ পরীক্ষা।
অভিযোগ রয়েছে, উপাচার্য অধ্যাপক ডা. জামাল উদ্দিন ভুঞা তার কুমিল্লা-বলয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের আত্মীয় স্বজন ও পরিচিতজনদের আবেদন করার সুযোগ প্রদান করতেই ২০১৯ সালের কর্মকর্তা কর্মচারী নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির পুনঃনিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছেন। তার স্বেচ্ছাচারিতায় যেন কেউ বাধ সাধতে না পারে সেজন্য এই পুনঃনিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার আগে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সকল প্রশাসনিক পদে নিজের বলয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়েছেন ও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন।
নিয়োগ পরীক্ষা চলাকালীন বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সূত্রে জানা যায়, কর্মচারী নিয়োগে লিখিত পরীক্ষায় কৃতকার্য না হয়েও মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নিতে দাবি জানান উপাচার্য-বলয়ের তিনজন কর্মচারীর আত্মীয়। পরবর্তীতে পরিস্থিতি সামাল দিতে দ্রুত তাদের মৌখিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেন উপাচার্য। এছাড়া নিরাপত্তা প্রহরী ও পরিচ্ছন্নতা কর্মী নিয়োগ প্রদানের লক্ষে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ ও পুনঃনিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা সত্ত্বেও উক্ত দুই পদে আবেদনকারী প্রার্থীদের এডমিট কার্ড প্রদান করা হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে ২০০৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয় আইনানুযায়ী নিরাপত্তা প্রহরী ও পরিচ্ছন্নতা কর্মী আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিতে বলা হয়েছে। তাই ওই দুই পদে পরীক্ষা নেওয়া হয়নি। তবে এই পদে আবেদনকারীদের প্রশ্ন, আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে এই পদে লোক নেওয়ার আইন থাকলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি কেন প্রকাশ করল?
এদিকে, গত ২৭ অক্টোবর চারটি কর্মকর্তা পদে নিয়োগ পরীক্ষা হওয়ার কথা থাকলেও অনিবার্য কারণ দেখিয়ে নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিত করে সিকৃবি প্রশাসন। তবে এই পদে আবেদনকারীদের অভিযোগ, এই পদগুলোতে নিয়োগ দিতে কয়েকজনকে কথা দিয়ে রেখেছেন সিকৃবি উপাচার্য। তাই পরীক্ষা স্থগিত করেছেন। পরবর্তীতে নামেমাত্র পরীক্ষা নিয়ে তার পছন্দের প্রার্থীদের নিয়োগ দেবেন।
আবেদনকারী সুনামগঞ্জের শাল্লার একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমার চাকরির বয়স শেষ হওয়ার আগে এই একটি পরীক্ষাই ছিল। কেন পরীক্ষা স্থগিত করা হলো-এ বিষয়ে সরাসরি উপাচার্যের দপ্তরে যোগাযোগ করেও কোনো কারণ জানা যায়নি।‘
বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট সূত্রে জানা যায়, ২০১৯ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি, ১২ ফেব্রুয়ারি, ১৮ জুন তারিখে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পদে দরখাস্ত আহবান করে। ওই বছরের জুলাই মাসে প্রকাশিত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি বাতিল করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তারপর আবার ২০২০-২১ সালেও বেশ কয়েকটি পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। তবে ২০১৯ সালের ১৮ জুন ৯৩টি কর্মচারী পদের নিয়োগ পরীক্ষা ২০২০ সালের ১০ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু ওই সময় কর্মচারী পরিষদ ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের আন্দোলনের মুখে পরীক্ষার আগের দিন নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিত করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। বিগত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির পরীক্ষা নিয়েই চলতি বছর ১১ এপ্রিল, ১৩ এপ্রিল ও ১৮ এপ্রিল সেকশন অফিসার, স্টোর অফিসার/প্রশাসনিক কর্মকর্তা, কেয়ারটেকার, বাবুর্চি, পরিচ্ছন্নতা কর্মী, নিরাপত্তা প্রহরীসহ বিভিন্ন পদে আবারও দরখাস্ত আহবান করা হয়। এবং ২০১৯ ও ২০২৩ এর আবেদনকারীদের পরীক্ষা নেওয়া হয় গত ২৫, ২৬ ও ২৭ অক্টোবর।
তবে এবার আর বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী পরিষদ ও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কেউ আন্দোলনে নামেননি। অভিযোগ রয়েছে, নানা সুযোগসুবিধা দিয়ে কর্মচারী পরিষদ ও ছাত্রলীগের নেতাদের নিজের বলয়ে এনেছেন উপাচার্য।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক সূত্রে জানা যায়, উপাচার্য অধ্যাপক ডা. জামাল উদ্দিন ভুঞার নিয়োগ বাণিজ্য নতুন নয়। এর আগে ২০১০ সালে তিনি যখন সিকৃবিতে চাকুরিরত ছিলেন তখনও তার বিরুদ্ধে নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ উঠে। এসব অভিযোগের কারণে ২০১০ সালে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন তৎকালীন উপাচার্য ড. আওয়াল। সেবছরই নতুন উপাচার্য হিসাবে যোগ দেন অধ্যাপক ড. শহিদুল্লাহ তালুকদার। সেসময় উপাচার্যেরও প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেছিলেন জামাল উদ্দিন ভূঁইয়া। সিকৃবির সেই সাবেক উপাচার্য ড মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ তালুকদারের জামাতা ড. মোহাম্মদ আতিকুজ্জামানকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র পরামর্শ দপ্তরের পরিচালক হিসেবে নিয়োগ প্রদান করেন উপাচার্য। নিজেদের পছন্দের প্রার্থীদের চাকরি প্রদান করতে উপাচার্যের নির্দেশে ড. মোহাম্মদ আতিকুজ্জামানসহ কাজ করছেন প্রক্টর মনিরুল ইসলাম সোহাগ, একান্ত সচিব ড. সালাউদ্দিন আহমেদ। এছাড়া অর্থের বিনিময়ে কর্মচারী পদে নিয়োগ দিতে মাঠ পর্যায়ে কাজ করছেন নিজেকে উপাচার্যের লোক বলে দাবি করা নিরাপত্তা প্রহরী খুরশেদ আলম।
খুরশেদ আলমের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বদলীসংক্রান্ত ভয়ভীতি প্রদর্শন ও উপাচার্যের ঘনিষ্ঠজন পরিচয়ে সিকৃবি সংলগ্ন বালুচর এলাকায় স্থানীয়দের সাথে সংঘর্ষ এ জড়ানোর অভিযোগ রয়েছে। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক কর্মচারী জানান, খুরশিদ আলম উপাচার্যের প্রভাব খাটিয়ে তাদের এক দপ্তর থেকে অন্য দপ্তরে বদলী করিয়েছেন। পাশাপাশি তাদের থেকে চাঁদাও দাবি করেছেন। এবং চলমান কর্মচারী নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অর্থের বিনিময়ে চাকরি প্রদানের চুক্তি করছেন। এছাড়াও খুরশেদ আলম সাবেক উপাচার্য মহিয়ার রহমান হাওলাদার থাকাকালীন দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে শাস্তিও পেয়েছেন।
সিকৃবির উপাচার্য অধ্যাপক ডা. জামাল উদ্দিন ভুঞা বলেন, এই নিয়োগের জন্য তিন চার বছর আগে থেকে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু নিয়োগ দেওয়া হয়নি। এটার পুনঃবিজ্ঞপ্তি মাঝখানে আরার দেওয়া হয়েছিল। পুনঃবিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছিল সরকারি নিয়মে। তখন একটি বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। এরপর ছয়মাসের মধ্যে যদি নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ না হয় তখন চাকুরির জন্য নতুন আরও অনেকে উপযুক্ত হয়। নতুনদের জন্য একটা সুযোগ করে দিতে হয় যাতে আবেদন করতে পারে। একটি সরকারি নিয়োগ এখন দুই বা আড়াই বছর আগে বিজ্ঞাপন হয়ে রয়েছে, এখন ইন্টারভিউ করলে নতুন যারা উপযুক্ত হয়েছে তারা তো দরখাস্ত করার সুযোগ পেত না। যা বিজ্ঞপ্তি আগে ছিল আমি সেভাবেই পুনঃবিজ্ঞপ্তি দিয়েছিলাম। কিন্তু পরে ইউজিসির হিসাবে দেখা গেল যে সবগুলো পদের অনুমোদন নেই। এজন্য উনারা আবার সবগুলো পদ অনুমোদন না দিয়ে অনেকগুলো কেটে দিয়েছে। নিরাপত্তা প্রহরী ও পরিচ্ছন্নতা কর্মী পদে আউটসোর্সিংয়ের নেওয়ার সরকারি নিয়ম হয়েছে। তাই ওই পদগুলোতে সরাসরি নিয়োগ নেওয়ার সুযোগ নেই।
নিরাপত্তা প্রহরী ও পরিচ্ছন্নতা কর্মী নিয়োগ পরীক্ষার আবেদনের জন্য যে টাকা জমা দিয়েছিলেন সেটার কী হবে এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা আমরা সিন্ডিকেটে উপস্থাপন করব। আমাদের ফাইন্যান্স কমিটিতে থাকে। এগুলোর পদ্ধতি আছে। সিন্ডিকেটে যে সিদ্ধান্ত হয় সে অনুযায়ী আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
নিজের পছন্দের প্রার্থীদের নিয়োগ দিতেই পুনঃনিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছেন এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা দুই বছর আগের নিয়োগ। এরকম পুনঃনিয়োগ সব প্রতিষ্ঠানেই হয়। বরং পুনঃবিজ্ঞপ্তি না দিলেই প্রশ্ন উঠতো নতুন প্রার্থীরা আবেদনের জন্য সুযোগ পেল না। তাছাড়া সরকারি বিধি আছে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির ছয়মাস পার হলে পুনঃবিজ্ঞপ্তি দিতে হয়। ইউজিসিও অনুমোদন দিয়েছে এই পুনঃবিজ্ঞপ্তির।
আপনার একান্ত সচিব ড. সালাউদ্দিন আহমেদ প্রক্টর মনিরুল ইসলাম সোহাগ মিলে পুরো নিয়োগ ব্যবস্থা পরিচালনা করছেন? আপনার বাসায় বসে খাতা দেখে রেজাল্টশিট তৈরি করে নিজেদের পছন্দমত প্রার্থীদের পাশ করিয়েছেন। এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আপনার জানেন যে সব নিয়োগেই এমন হয়। এটা নির্বাচনের মত যার হয়ে যায় সে বলে নির্বাচন ফেয়ার হয়েছে । আর যারা পাশ করে না তারা বলে আনফেয়ার হয়েছে। এখানে যে প্রার্থীরা পাশ করেনি তারা হয়তো এই অভিযোগ করেছে। আমরা অনেকজন শিক্ষক সকল ডিনদের মিলে শিক্ষক সমিতিসহ আমাদের সিনিয়র শিক্ষকদের নিয়ে টেবিলে বসে খাতা দেখা হয়েছে। এবং আমরা খাতা কোডিং করে দিয়েছি। কেউ জানতে পারেনি কার খাতা কোনটা। এর থেকে ফেয়ার পরীক্ষা বাংলাদেশে অনেকেই করে না। এখন কেউ সুযোগ না পেয়ে যদি অভিযোগ করলে করতে পারে। কিন্তু আমাদের পরীক্ষা পদ্ধতি, ডকুমেন্ট সঠিক ছিল।
তিনি বলেন, তিন হাজারের বেশি আবেদনকারী ছিল। অনেকে একাধিক পদে আবেদন করেছে। সব মিলিয়ে হাজারখানেক পরীক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে।
কর্মকর্তা পদে নিয়োগ স্থগিতের ব্যাপারে উপাচার্য বলেন, এটা আমার অধীনে প্রথম নিয়োগ পরীক্ষা। কর্মচারী নিয়োগ পরীক্ষাটাই শেষ করতে পারছিলাম না। কর্মচারী নিয়োগ পরীক্ষা গতকাল শেষ হয়েছে। পাশাপাশি পরীক্ষার তারিখ হওয়ার কারণে মনে হলো কুলিয়ে উঠতে পারবো না। তাই কর্মকর্তা পদে নিয়োগ স্থগিত করা হয়েছে। আমার ধারণা ছিল না এত পরীক্ষার্থী হলে কীভাবে সামাল দেবো। অচিরেই এই কর্মকর্তা পদে নিয়োগ পরীক্ষা নেওয়া হবে।
নিজস্ব বলয়ে প্রশাসন সাজানো প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ম্যানেজমেন্টে তো লোক থাকতে হয়। একসাথে তো আর সবাইকে ম্যানেজমেন্ট দেওয়া যায় না। যারা এই দায়িত্বে নেই তারাই হয়তো হিংসার বশীভূত হয়ে এসব কথা বলে। তবে আমি অনেক স্বচ্ছভাবে এই নিয়োগ পরীক্ষা নিয়েছি।
আপনার মন্তব্য