নিজস্ব প্রতিবেদক

২৯ আগস্ট, ২০১৬ ০০:১২

অনিয়ম-অব্যবস্থাপনায় সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

সিলেট অঞ্চলে প্রথম নিজস্ব স্থায়ী ক্যাম্পাসে ২০০১ সালে যাত্রা করে বেসরকারি সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি। শুরুর দিকে দক্ষ ব্যবস্থাপনা ও উন্নত অবকাঠামোর কারণে সিলেট অঞ্চলের উচ্চশিক্ষায় ভালো অবস্থান তৈরি করে নেয় বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠা বিশ্ববিদ্যালয়টি। তবে এ অবস্থান বেশিদিন ধরে রাখতে পারেনি। প্রতিষ্ঠার কয়েক বছরের মধ্যেই মালিকানার দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি। পরবর্তীতে এ দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা তৈরি হয় বিশ্ববিদ্যালয়টিতে। গেল কয়েক বছরে তা চরম আকার ধারণ করেছে।

মালিকানার দ্বন্দ্বে প্রতিষ্ঠার ১৫ বছরেও গঠন করা হয়নি সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বোর্ড অব ট্রাস্টি। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে স্থায়ী উপাচার্য নেই। খালি আছে কোষাধ্যক্ষ ও রেজিস্ট্রারের পদও। ভারপ্রাপ্ত দিয়ে চলছে এসব গুরুত্বপূর্ণ পদের কাজ। আর এ পর্যন্ত কাউকে নিয়োগ দেয়া হয়নি উপ-উপাচার্য পদে। এসবের প্রভাব পড়ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমে। থমকে আছে অবকাঠামো উন্নয়নও।

এসব অনিয়ম-অব্যবস্থাপনার কারণে সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির ক্ষেত্রে সতর্কতা জানিয়ে ২১ আগস্ট গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি)। সতর্কতার তালিকায় রয়েছে আরো ১১টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামও।

জানতে চাইলে ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক আব্দুল মান্নান বলেন, সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্ব রয়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়টির বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ জমা পড়েছে ইউজিসিতে। সরেজমিন তদন্তে শিগগিরই আমরা সেখানে যাব। তদন্তের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

সতর্কতা বিজ্ঞপ্তি বিষয়ে ইউজিসি চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমরা এ-সংক্রান্ত একটি গণবিজ্ঞপ্তি দিয়েছি। এ ধরনের বিশ্ববিদ্যালয় বা ক্যাম্পাসে কোনো ছাত্রছাত্রী ভর্তি হয়ে যাতে প্রতারিত না হয়, সেজন্য এ পদক্ষেপ। এর পরও কেউ যদি চিহ্নিত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়, তাহলে তার দায়দায়িত্ব একান্তই তাদের। তাই শিক্ষার্থীরা যেন এ ধরনের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি না হয়, সে পরামর্শ আমাদের থাকবে।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিনির্ধারণ পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ পদ খালি থাকায় শিক্ষা কার্যক্রমের পাশাপাশি প্রশাসনিক নানা অনিয়মও ঘটছে। পাশাপাশি অব্যবস্থাপনার ফলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের চেইন অব কমান্ড পূর্ণাঙ্গভাবে ভেঙে পড়েছে।

জানা যায়, গুলশান ফাউন্ডেশন ফর এডুকেশন ডেভেলপমেন্টের অধীনে যাত্রা করে বিশ্ববিদ্যালয়টি। তখন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ছিলেন কুতুবউদ্দিন আহমদ। ২০১০ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী ইউজিসি থেকে বোর্ড অব ট্রাস্টি গঠনের নির্দেশ দেয়া হয়। এ সময় ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যানকে সরিয়ে দিয়ে ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে প্রস্তাব করা হয় শামীম আহমেদের নাম। এর পরই শুরু হয় মালিকানার দ্বন্দ্ব। শামীম আহমেদ নিজের অবস্থান দৃঢ় করতে তত্কালীন জেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মো. তারেক উদ্দিন তাজকে জনসংযোগ কর্মকর্তা নিয়োগ দেন।

অভিযোগ আছে, তারেক উদ্দিন তাজ তার রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে কুতুবউদ্দিনের অনুসারী উপাচার্য ও শিক্ষকদের সরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে শামীম আহমেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন। শামীম আহমেদ দেশের বাইরে অবস্থান করায় তার অবর্তমানে শিক্ষক-কর্মকর্তা নিয়োগ থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক কর্মকাণ্ডে নীতিনির্ধারক হয়ে ওঠেন তাজ।

সরেজমিন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন শিক্ষক-কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কাজ থেকে শুরু করে শিক্ষা কার্যক্রম সর্বক্ষেত্রেই চলে তারেক উদ্দিন তাজের খবরদারি। শিক্ষক-কর্মকর্তারা তাদের চাকরি বাঁচাতে তার আনুগত্য মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। নিজ কক্ষে বসেই ৩২টি সিসিটিভির মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করেন তিনি।

জানতে চাইলে তারেক উদ্দিন তাজ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ারম্যান তার নির্বাহী ক্ষমতায় আমাকে নিয়োগ দিয়েছেন। মালিকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন কুচক্রী মহল ষড়যন্ত্র করছে। আমার কারণে তারা তাদের অসত্ উদ্দেশ্য হাসিল করতে পারছে না। তাই তারা এসব কথা বলছে।

প্রশাসনিক কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ বিষয়ে তিনি বলেন, চেয়ারম্যান দেশের বাইরে অবস্থান করায় তিনি আমাকে প্রশাসন দেখতে বলেছেন। চেয়ারম্যান ইচ্ছা করলে তার প্রতিনিধিত্ব করার জন্য যে কাউকে দায়িত্ব দিতে পারেন।

একচ্ছত্র ক্ষমতার বিষয়ে তিনি বলেন, এ ধরনের অভিযোগ সত্য নয়। বোর্ড অব ট্রাস্টির চেয়ারম্যান দেশের বাইরে থাকলেও সব বিষয়ে তার তদারকি রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন প্রস্তাবনা ই-মেইলের মাধ্যমে তাকে পাঠানো হয়। এর পর তিনি অনুমোদন দিলে তা কার্যকর করা হয়।

প্রশাসনিক এসব অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার প্রভাব পড়ছে বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষা কার্যক্রমেও। নতুন বিভাগ খুলতে ইউজিসির অনুমোদন পাচ্ছে না বিশ্ববিদ্যালয়টি। ইউজিসির অনুমোদন না পাওয়ায় ছয় বছর ধরে বন্ধ রয়েছে সমাবর্তন অনুষ্ঠান। সমাবর্তন না হওয়ায় পাস করা শিক্ষার্থীরা তাদের মূল সনদ নিতে পারছেন না।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রাক্তন এক শিক্ষার্থী বলেন, পাস করে বের হয়েছি তিন বছর হলো। এখনো সমাবর্তন পায়নি। বিভিন্ন অনিয়ম বা দ্বন্দ্বে অনেক সময় বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেয়া হয়। এতে প্রশ্নবিদ্ধ হয় আমাদের সনদ। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনিয়ম আর ইউজিসির গণবিজ্ঞপ্তি সব মিলিয়ে আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাতে হচ্ছে।

অনৈতিক দ্বন্দ্ব ও অনিয়মে জড়িয়ে পড়ায় ভাবমূর্তি সংকটে পড়েছে সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি। ফলে প্রত্যাশা অনুযায়ী শিক্ষার্থী পাচ্ছে না তারা। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসপেক্টাস ও ভর্তি নির্দেশিকায় শিক্ষার্থী সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে প্রায় ছয় হাজার। অথচ প্রকৃত শিক্ষার্থী আড়াই হাজারের কম বলে নিশ্চিত করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক সূত্র।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান শিক্ষার্থী সংখ্যা জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তাবিত কোষাধ্যক্ষ ও ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য অধ্যাপক মো. মনির উদ্দিন বলেন, বর্তমানে ২ হাজার ২০০ শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত। আগে কিছু শিক্ষার্থী অনিয়মিত ছিল। পরবর্তীতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থকে অনিয়মিত শিক্ষার্থীদের তথ্য চাওয়া হলে অভিভাবকদের বিষয়টি জানানো হয়। ফলে অধিকাংশ শিক্ষার্থীই বর্তমানে নিয়মিত।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, ফল সেমিস্টারের ভর্তি পরীক্ষা আগামী ২ সেপ্টেম্বর হওয়ার কথা। তবে এ সেমিস্টারের ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য আবেদন জমা পড়েছে মাত্র সাত-আটটি।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তাবিত কোষাধ্যক্ষ ও ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য বলেন, এইচএসসি পরীক্ষার ফল দেরিতে দেয়ায় আবেদন কিছুটা কম পড়েছে। তাই ভর্তি পরীক্ষার তারিখ পেছানো হতে পারে।

এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমের সার্বিক মানোন্নয়নে উচ্চশিক্ষা মানোন্নয়ন প্রকল্প হেকেপের ১ কোটি টাকার একটি গবেষণা প্রকল্প চালু হওয়ার কথা ছিল গত জানুয়ারিতে। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা দুর্বলতায় তা এখনো চালু করা সম্ভব হয়নি। চলমান সংকট সমাধান না হলে প্রকল্পটি ফিরিয়ে নেয়ার কথা জানিয়েছে ইউজিসি।

বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীর প্রায় অর্ধেকই ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের। বিবিএ শিক্ষার্থীদের শেষ বর্ষের প্রথম সেমিস্টারে ‘স্মল বিজনেস’ শীর্ষক ১০০ নম্বরের একটি কোর্স রয়েছে। দুই বছর ধরে এ কোর্সটির কার্যক্রম বন্ধ।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত