রুহেল বিন সাইদ ও ফাল্গুনী দেব

০২ মে, ২০১৭ ২২:৩৯

গান গেয়ে পাওয়া টাকা নিয়ে শাল্লার হাওরে ‘কাকতাড়ুয়া’

ঘরে এক ছটাক চাল নেই। যার ঘরে খাচ্ছেন, সে ঘরেও মানুষ এক বেলা খাচ্ছে। একটা পরিবারের মানুষ হৃদরোগী। ভাতই জোটে না, আবার চিকিৎসা! এক সনাতন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি ক'দিন আগে হুট করে মরে গেছেন। শ্রাদ্ধ করাবে, সেই টাকাও নেই। আরেক পরিবারে দেখা গেলো, রোববার রাতের ঝড়ে তার ভিটেটা উড়ে গেছে। হাওরে নেই ধান, গ্রামে নেই একটু বসার স্থান।

হাওর পাড়ের সেইসব পরিবারের কাছে যখন যাওয়া হলো, রোববার মধ্যরাতের ঝড়ে সিলেটে সবার বাসার বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন। তখনো গান গেয়ে সংগৃহীত অর্থগুলো প্যাকেটবন্দী হয়নি। একজন আরেকজনের সাথে যোগাযোগ করবে, কিন্তু কারো মোবাইলে চার্জ নেই। ভোর হয়েছে, কিন্তু এলার্ম দিয়ে রাখা মোবাইলটাও বাজেনি। তবুও জেগেছে একদল 'কাকতাড়ুয়া'! যেতে হবে সুনামগঞ্জের দূর্গম হাওর এলাকা শাল্লায়।

এর আগে একদল স্বপ্নচারী তরুণপ্রাণ সিলেট শহরের অলি থেকে গলিতে ঘুরেছে, গেয়েছে গান। মানুষের কাছে হাত পেতে বলেছে 'হাওরের কান্না শুনতে কি পাও?' উদ্দেশ্য ছিলো একটাই- বৃহত্তম সুনামগঞ্জ জেলার বন্যা দূর্গতদের সাহায্য করা।

সোমবার (১ মে) মধ্যরাতের প্রতিকূল আবহাওয়া পেরিয়ে খুব সকালে ১০ জন 'কাকতাড়ুয়া' যাত্রা শুরু করে সুনামগঞ্জ জেলার শাল্লার উদ্দেশে। দীর্ঘ পথ, অথচ কারো মুখে জুটেনি সকালের নাস্তাটুকু। গাড়ি চলে শালার পথে, কন্ঠে চলে মাটির গান-হাওরের গান।

সুনামগঞ্জ জেলায় ঢুকতেই চোখে পড়ে একের পর এক প্লাবিত জমি। একটার পর একটা হাওর পেরিয়ে গাড়ি পৌঁছে দিরাই বাজারে। সেখানে যোগ দেন বাউল ও গীতিকার নজরুল ইসলাম। তিনি কাকতাড়ুয়াদের পথ প্রদর্শক। অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের প্রথম ধাক্কাতেই দিরাই-শাল্লার সব হাওরে পানি ঢুকে পড়ে। সম্ভবত এই এলাকার মানুষ সবচেয়ে বেশি দূর্গত। খবরে বা পত্র-পত্রিকায় যা পড়েছেন, অবস্থা তার চেয়েও ভয়ংকর। হাওরে চলছে 'হিডেন হাঙ্গার'। প্রান্তিক কৃষকদের পাশাপাশি বড় কৃষকদেরও সব ফসল ডুবে গেছে। মধ্যবিত্তদের ঝামেলা আরো বড়। তারা শার্ট দিয়ে মুখ ঢেকে রিলিফ আনতে লাইনে দাঁড়াতে পারছেন না, আবার কারো কাছে লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে হাতও পাততে পারছেন না।

হাওরের এ দুর্দিনে গত কয়েকদিন বিভিন্ন শিল্পীদের নিয়ে মাঠে নেমেছিলো সিলেটের স্থিরচিত্র ও চলচ্চিত্র বিষয়ক সংগঠন কাকতাড়ুয়া। গান শুধুমাত্র নির্মল বিনোদনের উৎস নয়। গানের কথা ও সুর মানুষকে বিবেককে জাগায়। 'কাকতাড়–য়া' ডাক দেয়ার পর সিলেটের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিল্পীরা রাস্তায় নেমে আসেন। হেঁটে হেঁটে গান গেয়ে মানুষের কাছ থেকে তারা টাকা তোলেন।

এক রিকশাওয়ালা তাদের সাথে সাথে গান গেয়ে ছুটলেন 'আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম'। রাস্তার এক পথচারী গান ধরলেন, 'ধরো বন্ধু আমার কেহ নাই', 'বন্ধু বিনে প্রাণ বাঁচেনা'। শুনে কলেজ ফেরত ছাত্রীটি তার পার্স খুলে রিকশা ভাড়ার সব টাকা কাকতাড়–য়াকে দিয়ে দিলেন। সেদিন তিনি হেঁটে বাড়ি ফিরেছিলেন। শুধু সিলেটে নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে হাওরের জন্য গান গেয়েছেন সংগীত বিভাগের কয়েকজন শিক্ষার্থী। টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ফিল্ম সোসাইটিও গিটার হাতে রাস্তায় বসে গেছে। সংগীত শিল্পী পিন্টু ঘোষ, নির্মাতা শাকুর মাজিদ তাঁদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেছেন। যে করেই হোক, হাওরের মানুষদের বাঁচাতে হবে।

গত ২৬ এপ্রিল থেকে থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত অমানুষিক পরিশ্রম করেছে 'কাকতাড়ুয়া' সংগঠনের সদস্যরা। ক্লাসের স্যারদের ম্যানেজ করে, নিজেদের টিউশনি বন্ধ রেখে, পরিবারে অসুস্থ সদস্যদের অন্যের কাছে সমর্পণ করে, সমাজের মানুষদের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে, সকাল-দুপুর না খেয়ে, রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে রাস্তায় নেমে আসে। একই কন্ঠে গেয়ে ওঠে, 'একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না?'

সিলেট শহর থেকে সংগৃহীত সাহায্য নিয়ে ১ মে তারা চলে যান শাল্লার সুখলাইন গ্রামে। কিছু পরিবারের অবস্থা একেবারে খারাপ। তাঁদের কান্না দেখে কাকতাড়ুয়া সদস্যদের চোখেও পানি এসে যায়।

গ্রামের নাম সুখলাইন হলেও কোন সুখে নেই সেখানে। ধান গেছে, আবাদি জমি গেছে, সাথে গেছে সুখলাইন গ্রামের সুখ। কাকতাড়ুয়ার সদস্যদের পেয়ে পুরো গ্রামটি যেনো হিজলতলায় হাজির হয়। সদ্য হাঁটতে শেখা অর্ধনগ্ন শিশু থেকে লাঠি হাতে বয়োবৃদ্ধ সকলেই তাদের দুঃখগুলো বলার মানুষ পেলেন যেনো। এই দূর্যোগেও আতিথেয়তার একটু কমতি রাখেনি সুখলাইনের সুখহীন মানুষগুলো। কড়া লিকাড়ের চা থেকে ডাবের পানি, সবকিছুতে ছাপ ছিলো একদল স্বপ্নহারা মানুষের নিষ্পাপ আতিথেয়তা।

সেখানে দুর্গতদের অনুদানের টাকা প্রদান করেন কাকতাড়ুয়ার সদস্যরা। টাকাগুলো একটি কাগজের ব্যাগে বন্দি করে দশটি পরিবারকে পুরো মাস চলার হিসেবে সাহায্য করেন তারা। ব্যাগটির উপরে লিখা ছিলো- 'তোমার জন্য ভালোবাসা'। বিদায় বেলায় দুই খুদে শিশুর গানে মুগ্ধ হয় কাকতাড়ুয়ারা। ভাটির মানুষ রাধারমণ বা বাউল শাহ আবদুল করিমের আত্মা থেকে গাওয়া গান যেন।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত