অপূর্ব শর্মা

০৯ এপ্রিল, ২০২৩ ০৩:১২

মানবতার জন্য শহিদ হন ডা. শামসুদ্দিন ও তাঁর সঙ্গীরা

মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর অসীম সাহসিকতায় এক দুঃসাহসী যুদ্ধ চালিয়ে স্বাধীনতার বেদিমূলে প্রাণ উৎসর্গ করে মানবতার সেবায় অনন্য এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন ডা. শামসুদ্দিন আহমদ ও তার সঙ্গীরা। একাত্তরের ৯ এপ্রিল সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাকিদের নৃশংসতায় শুধু ডাক্তাররাই প্রাণ হারাননি, প্রাণ হারিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা, হাসপাতালের রোগী এবং তাদের স্বজনরা। হাসপাতাল যুদ্ধের আওতামুক্ত এলাকা হলেও হায়েনাদের বর্বরতার কাছে সেদিন হার মানে মানবতা। এপ্রোনের গায়ে লাগে রক্ত। সেই রক্তাক্ত ইতিহাস আজ ভুলতে বসেছি আমরা!

নগরীর প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত হওয়ার কারণে ১৯৭১ সালে সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালই ছিলো রোগীদের ভরসাস্থল। কলেজের সার্জারি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. শামসুদ্দিন আহমেদ শুধু সাধারণ রোগীদেরই নয় পাকিস্তানিদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা প্রদান অব্যাহত রাখেন। মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী মানুষের কাছে তিনি হয়ে ওঠেন সাক্ষাৎ দেবদূত। মুক্তিকামীদের হাসপাতালে পরিণত হয় হাসপাতালটি। প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নেওয়া মানুষের জীবন বাঁচাতে হাসপাতালটি রাখে মুখ্য ভূমিকা। পাকিস্তানিদের ক্ষমতা হস্তান্তরের টালবাহানা, মুক্তিকামী বাঙালিদের ওপর ভয়াবহ নিপীড়ন, নির্যাতন এবং পঁচিশে মার্চের পর নির্বিচারে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ভয়াবহ বিপদ যে আসন্ন তা বুঝতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয়নি ডা. শামসুদ্দীনের। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি নিকটজনদের বলেছিলেন, ‘স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, অনেক রক্তের প্রয়োজন।’ সেই প্রয়োজনীয়তা থেকেই সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একটি ব্লাড ব্যাংক গড়ে তোলেন তিনি। অন্যদিকে, আহত মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী মানুষের চিকিৎসায় তিনি গঠন করেন একটি বিশেষ মেডিকেল টিম। এই টিমেরও প্রধান ছিলেন তিনি। এই টিমে অন্য যারা ছিলেন তারা হলেন ডা. শ্যামল কান্তি লালা, সিস্টার সংগীতা সরকার, গীতা বিশ্বাস, বীথি, মেইল নার্স মাহমুদুর রহমান, ওয়ার্ড বয় সৈয়দ মুখলিছুর রহমান, অ্যাম্বুলেন্স চালক কুরবান আলী প্রমুখ। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সেবায় নিবেদিত ছিলেন তারা প্রত্যেকেই।

বাংলাদেশে গণহত্যা চালাচ্ছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এ খবর ছড়িয়ে পড়লে সত্যতা যাচাইয়ের চেষ্টা করে বিভিন্ন দেশ। মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহ পর্যবেক্ষণ করে তারা। সারাদেশের মতো সিলেটেও পঁচিশে মার্চের পর থেকে অব্যাহতভাবে গণহত্যা চালাতে থাকে হানাদার বাহিনীর সদস্যরা। আহতদের বাঁচাতে প্রাণান্তকর চেষ্টা চালাতে থাকেন ডা. শামসুদ্দিন আহমদ ও তার সঙ্গীরা। সেই সময়ের ওয়ার্ড বয় মুখলিছুর রহমানের ভাষ্যমতে, পাকিদের গুলিতে এবং নির্যাতনে আহত দুই শতাধিক মানুষ চিকিৎসা দেওয়া হয় হাসপাতালে। অনেকে চিকিৎসা নিয়ে চলে গেলেও পরিস্থিতির কারণে গুরুতর আহতরা যেতে পারেননি। তাদের দেখতে হাসপাতালে একটি বিদেশি টিম আসে। তারা পাকিদের নির্যাতনের চিত্র দেখে শিউরে উঠে। এ খবর সোর্স মারফৎ অবগত হয়ে শামসুদ্দিনের উপর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে সেনা সদস্যরা।

হাসপাতালের সংকটাপন্ন রোগীদেরকে রেখে অন্যরা চলে গেলেও দায়িত্ব পালনে অবিচল ছিলেন ডা. শামসুদ্দিন। সহ-চিকিৎসকদের উদ্দেশ্যে তার বক্তব্য ছিলো- হাসপাতালে যতক্ষণ পর্যন্ত রোগী থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করে যাবেন তিনি। মানবতার কল্যাণে তিনি ছিলেন দৃঢ় প্রত্যয়ী। আর স্বাধীনতার প্রশ্নে ছিলেন আপসহীন। একদিকে কারফিউ অন্যদিকে হাসপাতালে আহত রোগীদের ভিড়- এই পরিস্থিতিতে নাওয়া খাওয়া ভুলে আহতদের চিকিৎসায় আত্মনিয়োগ করেন ডা. শামসুদ্দিন আহমদ। প্রায় ডাক্তারশূন্য হাসপাতালে দিনরাত্রির অধিকাংশ সময় কাটাতে থাকেন তিনিসহ বিশেষ টিমের সদস্যরা।

৮ এপ্রিল রাতে কয়েকজন গুলিবিদ্ধ মুক্তিযোদ্ধা এসে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ায় তাদের জীবনকে সঙ্কটমুক্ত করতে বিনিদ্র রাত কাটান শামসুদ্দিন আহমদ। যার ফলে, দেড় কিলোমিটার দূরত্বের হাউজিং এস্টেট এলাকায় নিজের বাসায় যাওয়া হয়নি তার। নার্স দিলারা বেগমের ভাষ্য অনুযায়ী, ‘হাসপাতালে গুলিবিদ্ধ রোগীসহ বেশ কয়েকজন আশঙ্কাজনক রোগী থাকায়, স্যারের আর ফেরা হয়নি। আট তারিখ হাসপাতালেই রাত্রিযাপন করেন তিনি। আমি সকাল ৭টায় কোয়ার্টার থেকে হাসপাতালে এসে পৌছাই। গিয়ে দেখি স্যার হাসপাতালের বারান্দায় পায়চারি করছেন। চা খেয়েছেন কি-না জিজ্ঞেস করি। তিনি, না সূচক উত্তর দেন। আমি তাৎক্ষণিক স্যারের জন্য চায়ের ব্যবস্থা করি। স্যার সলটেস বিস্কুট দিয়ে চা খেতে পছন্দ করতেন। তাকে, সলটেস বিস্কুট দিয়ে চা দিই। এটিই ছিলো তাঁর শেষ চা খাওয়া।’

ডা. শামসুদ্দিন ও তাঁর সহযোদ্ধারা মৃত্যু ভয়ে মোটেই ভীত ছিলেন না। জীবন সঙ্কটে পড়তে পারে, এমনকি যে কোনো সময় প্রাণও চলে যেতে পারে, জেনেও তাদের মধ্যে বিন্দুমাত্র ভীতি কাজ করেনি। তাদের মনে শক্তি ও সাহস যুগিয়েছিলেন শামসুদ্দিন। হায়েনাদের হাতে এক বাঙালি ডাক্তারের মৃত্যুও তাঁকে দায়িত্বপালন থেকে দূরে রাখতে পারেনি। সিলেটের পাঞ্জাব রেজিমেন্টের দুই বাঙালি কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন মাহবুব ও লেফটেন্যান্ট ডা. মঈনকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সদস্যরা গুলি করে, এতে গুরুতর আহত তারা। পাকিরা আহত দুই বাঙালি সেনা সদস্যকে সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বারান্দায় ফেলে চলে যায়। ডা. শামসুদ্দিন আহমদ প্রাণান্ত চেষ্টা করেও ক্যাপ্টেন মাহবুবকে বাঁচাতে পারেননি। তবে, লেফটেন্যান্ট ডা. মঈন তাঁর সফল অপারেশনে প্রাণ ফিরে পান। এর পর নিজ তত্ত্বাবধানে একজন কর্মচারী দিয়ে তাঁকে সিলেটের বাইরে পাঠিয়ে দেন। তাঁর কাছ থেকে বিদায়ের প্রাক্কালে ডা. মঈন তাকেও সিলেট ছাড়ার অনুরোধ করে বলেছিলেন, ‘মিলিটারি ডাক্তার হওয়ার পরও তারা আমাকে গুলি করেছে। তারা আপনাকে ছাড়বে না।’ কিন্তু তাতে সম্মত হননি তিনি।

একাত্তরের ৯ এপ্রিল। কারফিউ চলছে। সাধারণ মানুষ প্রায় গৃহবন্দি। তবে, সিলেট শহরসহ জেলার অধিকাংশ এলাকা তখন মুক্তিবাহিনীর দখলে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বিমানবন্দর ও লাক্কাতুরা চা-বাগানের মধ্যে কার্যত অবরুদ্ধ। এই পরিস্থিতিতে তারা শক্তি বৃদ্ধির প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে লড়াইয়ের প্রস্তুতি নেয়। অন্যদিকে, তাদেরকে হটিয়ে পুরো জেলাকে মুক্তাঞ্চল হিসেবে প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করেন মুক্তিযোদ্ধারা। ৯ এপ্রিল সিভিল সার্জনের বাঙলোর সামনে রাস্তায় পাকিদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের সংঘর্ষ হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে তিনজন পাকসেনা নিহত হয়। অন্যদিকে হায়েনাদের গুলিতে আহত হন ২ জন মুক্তিযোদ্ধা। পাকিরা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে পিছু হটতে বাধ্য হয়। আহত দুই মুক্তিযোদ্ধাকে সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসেন সহযোদ্ধারা। তাদের অপারেশনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ডা. শামসুদ্দিন সহকর্মীদের ওটি প্রস্তুত করতে বলেন। সম্পন্ন করা হয় সকল প্রস্তুতি। অন্যদিকে পিছু হটে লাক্কাতুরা এলাকায় চলে যায় পাকিরা। প্রতিশোধ নিতে পাগল হয়ে ওঠে তারা। ঘটনার প্রায় এক ঘণ্টা পর লাক্কাতুরা এলাকা থেকে মেজর রিয়াজের নেতৃত্বে নেতৃত্বে এক প্লাটুন পাকসেনা চৌহাট্টার দিকে অগ্রসর হয়। সোর্স মারফত পাকিরা পাকিরা সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান নিশ্চিত হয়ে যায়। পাকিস্তানি সেনারা তাৎক্ষণিক হাসপাতালে অভিযান চালায়। তাদের উপস্থিতি টের পেয়ে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে আসা মুক্তিযোদ্ধারা হাসপাতালের পেছন দিকের দেয়াল টপকে নিরাপদে চলে যান। আহত মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন ওটিতে। তাদের খোঁজে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে চালায় তল্লাশি। অবশেষে অপারেশন থিয়েটারে পেয়ে যায় তাদের। ডাক্তার শামসুদ্দিন টিম সদস্যদের নিয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন অপারেশনের। কিন্তু না, মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রোপচার করার পূর্বেই হাসপাতালে ‘অপারেশন’ শুরু করে মানবতার শত্রুরা। ওটির পাশে থাকা ডা. শামসুদ্দিন আহমদকে দেখেই ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে মেজর রিয়াজ। হুংকার দেয় ‘শালা মাদারচুৎ বলে’, সঙ্গে সঙ্গে দুই আর্মির সদস্য তাঁকে ঝাপটে ধরে। মুক্তি তেরা বাপ হায় বলে, টেনেহেচড়ে বাইরে নিয়ে আসে তাঁকে। বাকিদের ধরে আনে অন্যরা। দাঁড় করানো হয় লাইনে। মেজর রিয়াজ অর্ডার দেয়, ‘খতম করদো সবকো।’ শুরু হয় হত্যাযজ্ঞ।

ডাক্তার শামসুদ্দিনকে হত্যার দৃশ্যটি আজও ওয়ার্ড বয় মুখলিছুর রহমানের চোখে বর্তমান। তিনি জানান, ‘৯ এপ্রিল সকাল ১১টার দিকে অপারেশন থিয়েটার থেকে আমাদেরকে টেনেহেচড়ে বাইরে বের করা হয়। এরপর সবাইকে দাঁড় করানো হয় এক কাতারে। প্রথমে দাঁড় করানো হয় ডা. শামসুদ্দিন আহমদকে। এরপর ডা. শ্যামল কান্তি লালা, নার্স মাহমুদুর রহমান, অ্যাম্বুলেন্স চালক কুরবান আলী, পিয়ন মো. মহিবুর রহমান এবং আমাকে এক লাইনে দাঁড় করায়। এই লাইনে আরও কয়েকজন ছিলেন। তাদেরকে আমি চিনি না। ডা. শ্যামল কান্তি লালা এ সময় চিৎকার করে ইংরেজিতে পাকিস্তানি সেনাদের উদ্দেশ করে বলেছিলেন, ‘প্লিজ ডোন্ট হার্ট হিম, হি ইজ মাই প্রফেসর, শুট মি ফার্স্ট, বাট লেট হিম গো।’ তার কথায় কর্ণপাত করেনি পাকিরা। উল্টো তাঁকে করে রক্তাক্ত বুটের আঘাতে।

মুখলিছুর রহমানের ভাষ্য মতে, সকাল সোয়া ১১ টার দিকে প্রথমে গুলি করা হয় শামসুদ্দিনের পেটে। দ্বিতীয় গুলিটি তার বুকের ডান দিকে। তৃতীয় গুলিটি বুকের বামে। শেষ গুলিটিও পাকস্থলিতে করা হয়। গুলিতে নাড়ি ভুঁড়ি বের হয়ে যায় স্যারের। ফিনকি দিয়ে পড়তে থাকে রক্ত। চিৎকার দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। আমি তাঁর সামনে থাকায়, আমার দিকেই তাকিয়ে ছিলেন তিনি। এপ্রোন পরা ছিলো তাঁর গায়ে। এরপর ডা. শ্যামল কান্তি লালাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তিনি আমার পেছনে ছিলেন। আমি দক্ষিণ দিকে চেয়েছিলাম। তাকে হত্যায় মাত্র একটি গুলি ব্যবহার করে পশুরা। তার বুকের বাম পাশে গুলি করা হয়। মাগো বলে সজোরে চিৎকার করেন তিনি। এক গুলিতেই সব শেষ হয়ে যায়। এরপর আমাকে গুলি করা হয়। আমি দক্ষিণ দিকে তাকিয়ে কলমা পড়তে থাকি। উত্তর শিয়ানে মরার সিদ্ধান্ত নিই। তাৎক্ষণিক মনে আসে এটি। আমার বুকে গুলি করে। গুলির সময় ডান হাত একটি উপরে তুলি। গুলিটি ডান হাতের কনুইয়ে বিদ্ধ হয়ে বেরিয়ে যায়। আমি আল্লাগো বলে মাটিতে পড়ে যাই। গুলিতে ছটফট করতে থাকি। আমি উপুড় হয়ে মাটিতে মরার মতো ভান করে পড়ে থাকি। এ সময় আরও কয়েকটি গুলির শব্দ শুনতে পাই। গুলির সাথে সাথে ধপাস ধপাস করে একেকজন মাটিতে পড়ছেন আর অট্টহাসিতে মেতে উঠছে পাকিরা। পাকিরা চলে যাওয়ার পর আমার জ্ঞান ফিরে আসে।

‘চতুর্থ জেনেভা কনভেনশনের আর্টিকেল চার অনুযায়ী, চিকিৎসক, নার্স, অ্যাম্বুলেন্স চালকসহ হাসপাতালের কাজে ভূমিকা রাখা স্বাস্থ্যকর্মীরা নিরপেক্ষ হিসেবে বিবেচিত হবেন। তারা কখনোই আক্রমণের শিকার হবেন না। হাসপাতাল নিরপেক্ষ স্থান হিসেবে বিবেচিত হবে।’ কিন্তু পাকিস্তান সেনাবাহিনী জেনেভা কনভেনশন লঙ্ঘন করে সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যে হত্যাকাণ্ড চালায় তা হার মানিয়েছে সকল বর্বরতাকে। নার্স দিলারা বেগম জানান, সেদিন শহিদ হওয়া প্রত্যেকের গায়ে এপ্রোন ছিলো। কাপড়ে লাগানো ছিলো রেডক্রসের ব্যাজ। হত্যার পূর্বে শ্যামলকান্তি লালা বিষয়টি তুলে ধরেন তাদের সামনে। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি। তাঁর কোনো কথা না শুনে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল দিয়ে অপারেশন চালায় তারা। ডাক্তার, নার্স, ওয়ার্ড বয়, অ্যাম্বুলেন্স চালক, আহত যোদ্ধা, অসুস্থ রোগী এবং তাদের স্বজন কাউকেই ছাড় দেয়নি তারা।

শহিদদের প্রাণহীন দেহগুলো পড়ে থাকে খোলা আকাশের নিচে। এক নয়, দুই নয়, তিন দিন পড়ে ছিলো মৃতদেহগুলো। শহরে কারফিউ থাকায় ভয়ে আতংকে কেউ-ই আসেনি মৃতদেহগুলো সৎকার করতে। ১৩ এপ্রিল কিছুক্ষণের জন্য কারফিউ শিথিল হলে তাঁদের ক্ষতবিক্ষত মরদেহ হাসপাতাল প্রাঙ্গণে ছোটো গর্ত করে দ্রুততার সঙ্গে সমাহিত করা হয়। নির্মম হত্যাকাণ্ডে রক্তাক্ত মরদেহগুলো শিয়াল, কুকুর ও শকুনের খাদ্যে পরিণত হয়। ক্ষতবিক্ষত দেহগুলোই সমাহিত করা হয় চৌহাট্টায় হাসপাতাল প্রাঙ্গণে।

যে স্থানে ডা. শামসুদ্দিন আহমদসহ অন্যান্যদের হত্যা করা হয়েছিলো, সেই স্থানে একটি স্মৃতি সৌধ গড়ে তোলা হয়েছে। সেই স্মৃতিসৌধে দেওয়া আছে শহিদর পরিচিতি। মার্বেল পাথরে লেখা রয়েছে ‘১৯৭১ সালের ৯ এপ্রিল সিলেট মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে শহিদ হন ১১ জন।’ তবে, পরিচয় দেওয়া আছে মাত্র ৫ জনের। বাকিদের নাম জানা যায়নি আজও। ঐদিন প্রাণে বেঁচে যাওয়া মুখলিছুর রহমান দাবি করেন, ১১ জন নয়, ১৭ থেকে ১৯ জন মানুষ সেদিন প্রাণ হারিয়েছিলেন হাসপাতালে।

সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে হত্যাকাণ্ড নিয়ে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই এক ধরনের উদাসীনতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আজো স্বীকৃতি পাননি অকুতোভয় মানবতার যোদ্ধারা। একাত্তরের ৯ এপ্রিল হত্যাকাণ্ড যারা শহিদ হারিয়েছিলেন তাদের স্বজনদের দাবি একটাই, সবাইকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান করা হউক। ডা. শামসুদ্দিন আহমদ ও শ্যামলকান্তি লালার পরিবারের সদস্যরা চান, তাদের আত্মদানের কথা জানুক বর্তমান ও আগামী প্রজন্ম।

  • অপূর্ব শর্মা: মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক দৈনিক যুগভেরী

আপনার মন্তব্য

আলোচিত