অপূর্ব শর্মা

০৪ এপ্রিল, ২০২০ ০১:০১

নাট্যকর্মীদের জন্য ভালোবাসা

মানুষের বড় দুঃসময় আজ। অদৃশ্য করোনা ভাইরাসের কাছে মানুষ আজ অসহায়। মানুষের কান্নায়, আর্তনাদে ভারী হয়ে উঠেছে পৃথিবীর বাতাস। থামছে না মৃত্যুর মিছিল। কবে থামবে, না-কি আদৌ থামবে না জানে না কেউ। মৃত্যুর এই মিছিল থামাতে হলে বজায় রাখতে হবে সামাজিক দূরত্ব। এড়িয়ে চলতে হবে ভিড়। গৃহবন্দি হয়ে থাকতে হবে মানুষকে। সংক্রমণ ঠেকিয়ে শূন্যের কোটায় নিয়ে আসতে হবে এই মরণব্যাধিকে। এই সূত্র ধরে আমরাও শুরু করেছি বেঁচে থাকার লড়াই।
করোনা ভাইরাসের কাছ থেকে বাঁচার জন্য শুরু হয় আমাদের গৃহবন্দি দিনের সূচনা! এতে করে সর্বক্ষেত্রে নেমে এসেছে স্থবিরতা। কর্মহীন হয়ে পড়েছে হকার, ফুটপাত ব্যবসায়ী, দিনমজুর, রিকশা চালক, গৃহশ্রমিক, ফেরিওয়ালাসহ দিন এনে দিন খাওয়া মানুষেরা। রোজগার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এইসব মানুষের কি হবে-এনিয়ে যখন সবাই দুশ্চিন্তায়, তখন সরকার পক্ষ থেকে ঘোষণা এলো-‘ঘরে ঘরে পৌঁছে যাবে খাবার।’ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আহ্বান জানালেন যার যার অবস্থান থেকে অসহায়, দরিদ্র, গরীব, দিন এনে দিন খাওয়া মানুষের পাশে দাঁড়ানোর। দাঁড়ালো মানুষ। কেউ দাঁড়ালো একাকি, আবার কেউ কেউ দাঁড়ালো সংঘবদ্ধভাবে। সিলেটের সম্মিলিত নাট্য পরিষদ এগিয়ে এলো দলবদ্ধভাবে। সংগঠনটি প্রথমে সাধারণ মানুষকে সচেতন করার প্রচেষ্টা চালালো। বিলি করলো, মাস্ক ও জীবাণুনাশক সাবান। তুলনামূলক অসচেতন মানুষকে বার্তা দিলো ঘরে থাকার। ঘর থেকে বের না হওয়ার নির্দেশনা আসার পর শুরু করলো, মানবিকতার অনন্য প্রয়াস। ঘরে ঘরে খাবার পৌঁছে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো তারা।

এইযে, প্রয়াস-প্রচেষ্টা, এটা কিন্তু নতুন কিছু নয়। অতীতের প্রতিটি দুর্যোগ-দুর্বিপাকে ঠিক এমনিভাবেই মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন সিলেটের নাট্যকর্মীরা। সেই সাক্ষ্যই দেয় ইতিহাস। এ কথা বললে মোটেই অত্যুক্তি হবেনা, সিলেটের নাট্যকর্মীরা বরাবরই অগ্রসর। একাত্তরেও এখানকার নাট্যকর্মীরা, ঘরে বসে ছিলেন না। নব্বইয়ের গণআন্দোলনেও তারা ছিলেন সামনের কাতারে। গণজাগরণ মঞ্চের দিনগুলোতে ছিলেন দৃঢ় প্রত্যয়ী। এই সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য একাত্তরে যেভাবে জাগরিত করেছিলেন মানুষকে, সংস্কৃতকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন মুক্তিকামীদের; আজ তাঁর হাতে গড়া সংগঠনের বর্তমান নেতৃত্বও একইভাবে প্রাণের মায়া তুচ্ছ করে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। নিরন্নের মুখে অন্ন তুলে দিতে একঝাঁক নাট্যকর্মীকে নিয়ে তারা চালিয়ে যাচ্ছেন প্রাণান্তকর চেষ্টা। পূর্বসূরিদের নির্মিত পথে, তাদের পথচলা আশার আলো দেখাচ্ছে অনেককে। তাদের দেখে মানুষের পাশে দাঁড়াতে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে মানুষ।

এ কথা কোনওভাবেই অস্বীকার করা যাবেনা যে, এটা সম্ভব হয়েছে দক্ষ নেতৃত্বেও কারণে। এই সংগঠনটি নেতা নির্বাচনে কখনো ভুল করেনি। ভুল করেনি বলেই, নাটক কিংবা সংস্কৃতি বিকাশেই শুধু ভূমিকা রাখছে না সংগঠনটি-মানবতার কল্যাণেও বদ্ধ পরিকর রয়েছে তারা। আজ মিশফাক আহমদ মিশু এবং রজতকান্তি গুপ্তের নেতৃত্বে যে যুদ্ধটি শুরু করেছেন সিলেটের নাট্যকর্মীরা, তা এক কথায় অতুলনীয়। সংকটের এই সময়ে ঘরে বসে না থেকে, নিজেকে সুরক্ষিত রেখে, জীবনকে মুক্তির প্রয়াসে নিবেদিত রাখা শুধু চ্যালেঞ্জই নয়, দুঃসাহসিকও বটে। কঠিন এই অভিযাত্রাটি সংবেদনশীলভাবেই চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। ঘরে ঘরে পৌঁছে দিচ্ছেন খাবার।

নাটককে সমাজ বদলের হাতিয়ার বলা হয়ে থাকে। সমাজ সংস্কারে নাট্যকর্মীদের ভূমিকা সর্বজন স্বীকৃত। শুধু কি সমাজ বদলের ক্ষেত্রেই নাটক হাতিয়ার? অবশ্যই না; দেশ গড়ার ক্ষেত্রেও নাট্যকর্মীদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। নাটক ঠিক যেভাবে মানুষের জীবনযাত্রায় প্রভাব ফেলে সংস্কৃতির অন্যান্য ক্ষেত্রে সেটা প্রায় অসম্ভব। অন্যায়, অবিচার, অসংগতি আর বিভেদের বৃত্ত থেকে নাটক যেভাবে আমাদের কল্যাণকামী করে, সম্প্রীতি আর সাম্যের দীক্ষা দেয় সেটা সংস্কৃতির অন্যান্য ক্ষেত্রে ঠিক সেভাবে সম্ভব নয়। তাই যুগে যুগে কালে কালে অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়কে আলোর পথে প্রবহমান করতে ভূমিকা রেখেছেন নাট্যকর্মীরাই। অসীম সাহসিকতায় তারা পথ দেখিয়েছেন দিকভ্রান্তদের। আলোকবর্তিকা জ্বেলে তারা দিয়েছেন সঠিক পথের দিশা। আঁধার বিনাশে মানুষকে করেছেন উদ্বুদ্ধ। এবারও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। গভীর এই সংকটে আলোর মশাল জ্বেলেছেন তারা। এবারের কর্মপ্রবাহের দিকে দৃষ্টি দিলে সহজেই অনুমিত হবে, তারা কতোটা কঠোর পরিশ্রম করে, দিনরাতকে এক করে হাসি ফোটাচ্ছেন দুঃখী মানুষের মুখে। অনুমিত হবে, কতোটা দায়িত্ববোধ থেকে, কতোটা ভালোবাসা নিয়ে নাট্যকর্মীরা সৃজনযাত্রা থামিয়ে জীবনের জয়গান গাইছেন, মানবতার কল্যাণে। যে মঞ্চে অভিনয়শৈলীতে মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন তারা, সেই মঞ্চে বসেই হাজার হাজার মানুষের জন্য খাবার প্যাকেট তৈরি করছেন, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে তাদের সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য এবং ভালোবাসার এই হাতগুলোর ছবি দেখে শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার অশ্রুতে হয়েছি সিক্ত। মানুষের প্রতি ভালোবাসা এবং মমত্ববোধের এমন প্রকাশ সংকট মোকাবেলায় সাহস যোগাচ্ছে আমাদেরকে।

সংস্কৃতিকর্মীদের নিয়ে নাট্যকর্মীদের এই প্রয়াসটি বাস্তবায়িত হচ্ছে পরিকল্পিতভাবে। লক্ষ্য স্থির করেই তা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে নির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যে। প্রথমে ১হাজার পরিবারে ভালোবাসার সহায়তা পৌঁছে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও, নাট্য পরিষদের আহ্বানে সমাজের বিত্তবানরা সাড়া দেওয়ায় আগামী ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত ৫হাজার পরিবারের কাছে পর্যায়ক্রমে খাদ্য সহযোগিতা পৌঁছে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা। প্রকৃত অর্থে যাদের প্রয়োজন তাদের ঘরেই পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে খাবার। ইতোমধ্যে বেদে ও ওজা, ঋষি, শব্দকর, ধোপা, পাত্র, ওরাং, হিজরা সম্প্রদায়ের মাঝে খাদ্যদ্রব্য বিতরণ করা হয়েছে। একটা বিষয়, এই প্রয়াস প্রচেষ্টায় শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করে চলেছেন নাট্যকর্মীরা। সরকারের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত নির্দেশনা মেনেই বিতরণ কার্যক্রম পরিচালনা করছেন তারা। সেইসাথে গ্রহীতার সামাজিক মর্যাদা যেনও কোনওভাবেই বিনষ্ট না হয়, সে বিষয়েও রয়েছেন সচেষ্ট। খাদ্য সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রেও তারা শুরু করেছেন ব্যতিক্রমী প্রয়াস। তাদের ঘোষণা থেকেই অনুমান করা যায় তা। সম্মিলিত নাট্য পরিষদের নেতৃবৃন্দ তাদের ফেসবুক একাউন্টে খাদ্য গ্রহীতাদের উদ্দেশ্যে যে আহ্বানটি জানিয়েছেন এখানে হুবহু তুলে ধরা হলো তা- ‘সংকটে আপনার ফোনকলে আমরা হাজির। করোনা ভাইরাস পরিস্থিতিতে আপনি নিজেকে অসহায় ভাববেন না। সম্মিলিত নাট্য পরিষদ এহেন দুর্যোগ মোকাবেলায় বর্তমান পরিস্থিতিতে দুর্ভোগ লাগবে পাশে আছে সংস্কৃতির চিরায়ত দায়বদ্ধতা থেকে। নিম্নলিখিত যে কোন মোবাইল নম্বরে ফোন করে আপনি চেয়ে নেবেন নিঃসংকোচ চিত্তে। আমরা সাধ্যমত সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত। মোবাইল নম্বর- ০১৭ ১৭১৯ ১৫৬৩; ০১৭ ১১৪৬ ৯৭১৫; ০১৬ ২২৪১ ১০৯১; ০১৭ ১১৮১ ৩৯০৫।

এই মুহূর্তে আপনার প্রয়োজনটুকু অবশ্যই গোপনীয়তার সাথে বিবেচিত হবে, সময়ের প্রেক্ষাপটে এটিই আমাদের অঙ্গীকার। আপনার একটি ফোন পেলেই, আমাদের সহযোদ্ধারা পৌঁছে যাবে আপনার দোরগোড়ায়। সুস্থ থাকবেন, সতর্ক থাকবেন।’

এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে যে শ্রেণীটি মুখ ফুটে কাউকে কিছু বলতে পারছেনা, তাদের পাশে দাঁড়িয়ে যে সামাজিক দায়িত্ব পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা, তা সত্যি সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। বিশেষ কোনও শ্রেণীর জন্য যে তাদের এই খাদ্য সহায়তা কর্মসূচি নয়, সেই বিষয়টিই পরিস্কার হয়েছে এখানে। প্রকৃত অর্থেই যাদের প্রয়োজন, তাদের পাশে দাঁড়াতেই নাট্যকর্মীরা বদ্ধ পরিকর। তাদের এই মানবিক তৎপরতা নিয়ে নান্দিক নাট্যদলের অন্যতম কর্ণধার, মদনমোহন কলেজের শিক্ষক উজ্জ্বল দাসের ফেসবুক স্ট্যাটাস আমাদেরকে যেমন আবেগি করে তুলে, তেমনই উদ্বুদ্ধ করে দায়িত্ব সচেতন হতে। তিনি লিখেছেন-

যে মঞ্চ একদিন সেজে উঠতো নাটক আর গানের বর্ণাঢ্য সব সাজে, সেই মঞ্চ আজ সুশোভিত চাল ডাল আর আলুর ব্যাগে। যে মঞ্চে হেসে গেয়ে উঠতো মানবিকতার মন্ত্র, আপনারা বিনোদন নিতেন হাততালি দিয়ে, সেই মঞ্চটাতেই আজ আপনাদের আসন শূন্য। ঘা ঢাকা দিয়েছেন জীবন বাঁচানোর জন্য। কিন্তু সেই মঞ্চের কলাকুশলীরা আজো নাটক করেই যাচ্ছে, দখলে রেখেছে সেই মানবতার অগ্নিমন্ত্র। শূন্য আসনে গেয়ে যাচ্ছে বিজয়ের জয়গাঁথা।

বলি, কেমন করে পারেন ভাই, এই মঞ্চের মানুষদের নিয়ে তির্যক মন্তব্য ছুঁড়ে দিতে? দামী গাড়ি চড়তে পারেন একই সাথে পারেন দামী পোশাক আশাকে বাবুগিরি করতে। মনটাকে একবার দামী করে দেখুন না! একবার না একবার আনন্দ অবশ্যই পাবেন।

কবি নজরুল অডিটোরিয়ামের বিশাল মিলনায়তন দর্শক শূন্য আজ। মঞ্চ দখলে নিয়েছে শত শত খাদ্যের থলে। আজো দর্শকরা নাটকই দেখছে। জীবনঘনিষ্ঠ এ নাটকে খলনায়ক চরিত্র রূপায়নে আছে করোনা নামক ক্ষুদ্র অণুজীব, আর কলা কুশলী সোনার বাংলার সতেরো কোটি জনগণ। চিন্তা করেন তো বেশির ভাগ মানুষ যখন ঘরে বসে নাটকটির মঞ্চায়ন দেখছে, তখন গুটিকয় ছেলেমেয়ে তাদের সত্ত্বার কত গভীরে প্রবেশ করিয়েছে দেশসেবা।

হুম, বলতে আপত্তি নেই, এদের মধ্যে এমনও কেউ আছে যে বাড়ি থেকে আসার সময় তার গর্ভধারিণী মাকেও একটিবার বলে আসেনি। হাসছেন! না হাসবেন না! জানেন কেন বলে আসেনি? সে ভেবেছে, এই দুর্যোগের ঘনঘটায় মা হয়তো তাকে বাইরে বের হবার অনুমতি দেবে না। তাই সে মাকে উপেক্ষা করেই চলে এসেছে। এছাড়া তার কাছে দেশসেবার আর কোন সুযোগ নাও আসতে পারে এই ভেবে সে জীবনের ঝুঁকি নিতেও কুণ্ঠিত হয়নি। শুনেছি স্বাধীনতা সংগ্রামে এরকম করেই মাকে না জানিয়ে কত মুক্তিকামী ছেলেমেয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো তার হিসেব মেলা ভার। আজো সেরকম ছেলেমেয়েই এই বাংলা, এই বাংলার আকাশ বাতাস জন্ম দেয়, জন্ম দেয় তার পিতৃঋণ শোধ করার জন্য। কেউ পারে, কেউ পারে না।

উজ্জ্বল দাসের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে এ কথা বলতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই আমার- সংকটে সংগ্রামে নাট্যকর্মীরা অবশ্যই মানবিক। মানবিক বলেই তারা খাদ্য সহায়তা প্রদান কর্মসূচির নাম দিয়েছেন, ‘ভালোবাসার সহায়তা’। নাট্যকর্মী বলেই মনে হয়, এমন করে ভালোবাসা প্রকাশ করতে পারেন তারা। যা অন্যরা পারেন না। নাট্যকর্মীরা এমন দুঃসহ সময়ে মানুষকে ভালোবাসতে পারেন, ভালোবাসার কথা বলতে পারেন বলেই তাদেরকেও মানুষ ভালোবাসে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে।

আসলে, সবাইকে ভালোবাসা যায়না। ভালোবাসার কথা বলাও যায়না অকপটে। সম্মিলিত নাট্য পরিষদকে ভালোবাসা যায় এবং সেই ভালোবাসার কথা বলা যায় প্রকাশ্যে। সম্মিলিত নাট্য পরিষদ সিলেটকে আমি ভালোবাসি। সংগঠনটি সেই ভালোবাসা আদায় করে নিয়েছে। সেই ভালোবাসার কথা বলতে তাই আমার কোনও দ্বিধা নেই।

  • অপূর্ব শর্মা: লেখক, সাংবাদিক।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত