মাধব কর্মকার

২৮ এপ্রিল, ২০২০ ২৩:৩৬

অপ্রকাশিত কিছু সত্য বলি আজ

জাতীয় বিপর্যয়ের সময় বিবিসির বাংলা সংবাদ শুনেননি এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর। সবাই মুখিয়ে থাকতেন নিরপেক্ষ সংবাদ শোনার প্রতীক্ষায়। কোথা থেকে সে সংবাদ প্রচারিত হতো সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না। সংবাদটি শোনানোর আগে একটা সিগনেচার টিউন শুনানো হতো যা এখনও কানে বাজে। তারপর ভেসে আসতো- শ্রোতামণ্ডলী এবারে বিবিসি'র বাংলা অনুষ্ঠান ঢাকা থেকে রিলে করে আপনাদের শোনানো হচ্ছে কিংবা 'দিস ইজ দ্যা ভিওএ, ফোলোইং প্রোগ্রাম ইজ ইন বাংলা'। ভয়েজ অব অ্যামেরিকা থেকে ভেসে আসতো দরাজ গলায় 'খবর পড়ছি সরকার কবির উদ্দীন'।

চেনেন কি তাদের? না, চেনেন না হয়তো! কেবল নামটিই শুনেছেন। চেহারা দেখা যায় না তাদের, নামটি শোনা যায় কেবল। এতেই তারা তৃপ্ত, আমরা ঋদ্ধ।

বিজ্ঞাপন

পথপরিক্রমায় সেই ১৯৩৯ সাল থেকে রেডিওর জন্ম এ বঙ্গে। কালের পরিক্রমায় অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আজ বাংলাদেশ বেতারে হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সমসাময়িক খবর প্রচার রকমারি অনুষ্ঠান রাষ্ট্রীয় দিবসগুলোর বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালার বিন্যাসে। সরকারি এ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগপ্রাপ্ত সকল কর্মকর্তা কর্মচারী, সবাই সরকারি চাকুরে হলেও বাংলাদেশ বেতারের প্রায় সকল ঘোষক-ঘোষিকা সংবাদ পাঠক নির্ধারিত সম্মানী প্রাপ্তির ভিত্তিতে কাজ করে আসছেন। এমনকি শ্রোতাদের বিনোদন প্রদানকারী বিভিন্ন গ্রেডের শিল্পীবৃন্দও একই ধারায় সম্মানীপ্রাপ্ত হোন।

আজ প্রায় ৮০ বছরেও সামান্যতম কমেনি বাংলাদেশ বেতারের গ্রহণযোগ্যতা। তার কৃতিত্বের সিংহভাগ জুড়েই তো আছেন বেতারের সাথে সংশ্লিষ্ট ঘোষক কিংবা ঘোষিকা, সংবাদ পাঠক কিংবা গায়ক-গায়িকারা।

বাংলাদেশ বেতারের আঞ্চলিক শাখা, সিলেটের কথাই ধরুন না- ভোর ৬ টায় প্রথম শব্দ, আর জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে সমাপ্তি রাত ১১.১৩ মিনিটে। পুরোটা সময় জুড়েই তৎপর থাকেন কোন না কোন ঘোষক-ঘোষিকা। তা সে মহামারিই হোক আর অন্যকোন জাতীয় দুর্যোগ।

ভাবুন তো ভোর ৬টায় প্রথম শব্দ উচ্চারণ করতে হয়। বেতার কর্তৃপক্ষ যাতায়াত সুবিধের জন্য গাড়ি সরবরাহ করলেও ঠিক কয়টায় উঠে বাসাবাড়িতে প্রাক প্রস্তুতি নিতে হয়, বুঝতেই পারছেন! কখনো ভোরবেলা জলখাবারটুকু পর্যন্ত জুটে না কপালে। কিংবা রাত ১২টায় বাসায় ফিরে খুব স্বাচ্ছন্দ্যে যে রাতের খাবার জুটবে, সে আশাও গুড়েবালি। এমনও রাত যায়, সামান্য জল খেয়েই নিদ্রা যেতে হয়। টানা ছয় ঘণ্টাই হোক, বিচক্ষণতা আর প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব না থাকলে যে লেজেগোবরে অবস্থা হতে পারে, এটি সহজেই অনুমেয়।

বদ্ধ কোন বুথে, একের পর এক ঘোষণা আসছে, একেক ধরনের অনুষ্ঠানে সজ্জিত হচ্ছে বেতারের দিনলিপি, মিনিট সেকেন্ডের পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসেব কষে-কষে। সাথে ব্রিটিশের তৈরি করা নিয়মনীতিতে চলমান হিসেবহীন 'লগবহি' রোজনামচা লিখে-লিখে।

সেটা না দেখলে বুঝতেই পারবেন না। ঝড়-বৃষ্টি,ভয়ার্ত কোন অবস্থা কখনই আটকে থাকে না অনুষ্ঠান প্রচার আর ঘোষণার কার্যক্রম। এই করোনা কালেও যদিও বেতারের কর্মপরিধি কমিয়ে আনা হয়েছে। হ্রাস করা হয়েছে অনুষ্ঠান ঘোষকের সংখ্যাও, কিন্তু ঘোষকের প্রয়োজনটা দিবালোকের মতো সত্য।

দায়িত্ব এড়াচ্ছে না কেউই, সৎ আর নিষ্ঠার সাথে কাজ করে যাচ্ছে করোনা ভয় নিয়েই। কী ভাবছেন? চাকরি, অনেক টাকা!

না ভাই, এটা দায়বদ্ধতা দেশের প্রতি। এটা বেতারের প্রতি দায়বদ্ধতা, সর্বোপরি দেশের প্রতি ভালোবাসা। ভালোবাসা মাইক্রোফোনের প্রতি। এটা কোন চাকরিও নয় কিন্তু!

বিজ্ঞাপন

সরকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। অত্যন্ত আশাজাগানিয়া সংবাদ। কিন্তু বেতার সংশ্লিষ্ট এসব অত্যাবশ্যকীয় ঘোষক-ঘোষিকা তার থেকে বঞ্চিত। এ প্রণোদনায় প্রণোদিত হবেন কেবল সংশ্লিষ্ট চাকরিজীবীরা। আর বেতারের শ্রোতা মনোরঞ্জনে যাদের মুখ্য দায়িত্ব, তারাই থেকে যাচ্ছেন অযত্নে অবহেলায় অনেকটা অস্পৃশ্যজন হয়ে। নিয়মের ব্যত্যয় না হলে এসব কন্ঠযোদ্ধারা প্রণোদনার আওতায় আসাটাই নৈতিকতা!

আর প্রতিটি শো'র জন্য কণ্ঠশিল্পীরা যে পারিশ্রমিক বা সম্মানী পান, সেটিও বর্তমান পরিস্থিতিতে কতটা সম্মানপ্রদর্শন, তাও ভাববার অবকাশ আছে বৈকি! কর্তৃপক্ষ ভেবে দেখবেন।

করোনাকালীন এই ক্রান্তিলগ্নে আমরাই কেবল আমাদের জন্য প্রার্থনা করতে পারি কোনক্রমে ভালো থাকার, করোনা আক্রান্ত হলে আমাদের কেউ নেই দেখার!

ভালো থাকুন আমার সহকর্মীরা। ভালো থাকুন আমার অগ্রজ, অনুজ বেতারের ঘোষক-ঘোষিকা সবাই।

মাধব কর্মকার: অনুষ্ঠান ঘোষক ও সংবাদ পাঠক, বাংলাদেশ বেতার।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত