নিজস্ব প্রতিবেদক

২৬ এপ্রিল, ২০২১ ১৭:০২

এখন কৃষ্ণচূড়ার দিন

‘জানি না শ্রীরাধিকার প্রিয় ছিল কি না রাধাচূড়া’- গানে গানে এমন প্রশ্ন তুলেছিলেন কবির সুমন। কৃষ্ণচূড়া নিয়েও একই প্রশ্ন করা যায়, শ্রীকৃষ্ণের কি পছন্দের ফুল ছিল এটি? কৃষ্ণ কি লাল ফুলে মজেছিলেন?

এসব প্রশ্নের জুতসই কোনো উত্তর পাওয়া যায় না। যেমন জানা যায় না কৃষ্ণচূড়া নামকরণের রহস্য।

নিসর্গ লেখক আমিরুল আলম খান এই নামকরণের একটা কাহিনি শুনিয়েছেন তার ‘পারুলের সন্ধানে’ বইতে। আমিরুল লিখেছেন, ‘এক রাজকবি কৃষ্ণের মাথার চূড়ার বর্ণনা করতে গিয়ে রক্তবর্ণ এই ফুলের সঙ্গে তুলনা করেছেন। সেই থেকে এই ফুলকে কৃষ্ণচূড়া বলে ডাকা হয়। অন্যদিকে কৃষ্ণের প্রেয়সী রাধাকে উপলক্ষ করে রাধাচূড়া নামকরণ করা হয়।’

হলেও হতে পারে। সে যাই হোক। নামে কী-ইবা এসে যায়! ফুল সুন্দর কি না, গন্ধ বিলায় কি না, সেটাই তো মুখ্য।

ভাবছেন, হঠাৎ কৃষ্ণচূড়া নিয়ে এমন তথ্যতালাশের হেতু কী? একেবারে মিছেমিছি নয় কিন্তু। এখন দিনই যে কৃষ্ণচূড়ার। দিকে দিকে লাল আভা ছড়িয়ে ফুটেছে এ ফুল।

নগরের ইট-সিমেন্টের জঞ্জালের মধ্যেও এই ফুল একেবারে দুর্লভ নয়। নানা জায়গায়ই এর দেখা মেলে। মন কেড়ে নেয়া এমন সুন্দর যে ফুল, তার নামকরণ নিয়ে আগ্রহ তো হতেই পারে।

পলাশ-শিমুল যদি বসন্তের প্রতীক হয়, কদম যদি হয় বর্ষার, তবে কৃষ্ণচূড়া নিশ্চয়ই গ্রীষ্মের প্রতীক। গ্রীষ্মের তপ্ত দিনেই ফোটে এটি। এবারও ব্যতিক্রম হয়নি। কৃষ্ণচূড়ার ডালে ডালে এখন আগুন লেগেছে। সবুজ পাতার ফাঁকে মোরগের লাল ঝুঁটির মতো ফুটেছে ফুল।

সবুজের মাঝে লাল- এ তো বাংলাদেশেরই রূপ।

বসন্তের প্রকৃতি নিয়ে বাঙালির যত আদিখ্যেতা-রোমান্টিকতা দেখা যায়, গ্রীষ্ম নিয়ে তার ছিটেফোটাও নেই। কবিদের সব কবিতা-গানও যেন বর্ষা আর বসন্ত নিয়ে। গ্রীষ্ম বড় অবহেলিত। নিজের রৌদ্র-তেজোদীপ্ত রূপের কারণেই কি গ্রীষ্ম রোমান্টিক বাঙালির অনাদরণীয়?

গ্রীষ্মে মাঝামাঝি বলে কিছু নেই। গরম তো তীব্র গরম। ঝড় তো বিরাট ঝড়। এ বুঝি বাঙালির পছন্দ নয়! তবে কেবল বসন্তে নয়, গ্রীষ্মেও কিন্তু নানা ফুল ফোটে। বৃক্ষসখা দ্বিজেন শর্মার ‘ফুলগুলি যেন কথা’ বইতে গ্রীষ্মের নানা ফুলের বর্ণনা পাওয়া যায়।

দ্বিজেন শর্মা লিখেছেন- ‘কৃষ্ণচূড়ার লাল-কমলা, জারুলের হালকা বেগুনি, ক্যাশিয়ার গোলাপি-সাদা, পেল্টফরাম আর সোনাইলের হলুদ এবং বাতাসে ফেরে স্বর্ণচাঁপা শিরিষ হিজল কুরচির মধুগন্ধ। বাগানে উজ্জ্বলতা ছড়ায় রঙ-বেরঙের জবা, রাধাচূড়া, টগর, নানা রঙের ঘণ্টা ধুতরা, কলকে, বনপথে ফোটে লুটকি কাঠমল্লিকা, হিজল. বরুণ।’

রবীন্দ্রনাথ যেমন তার গানে দুঃখের দিনের আশার বাণী শুনিয়েছেন, ‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে/ তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে,’ গ্রীষ্মের ফুলগুলো যেন তেমনি, আশাজাগানিয়া। প্রখর রোদ, গায়ে জ্বালা ধরা গরম, আবার কখনও সবকিছু উড়িয়ে নেয়া ঝড়, প্রকৃতির এমন তাণ্ডবের মধ্যেও নানা রঙের ফুল প্রশান্তি জাগায়; চোখের আরাম দেয়।

এইবার তো আরও খারাপ পরিস্থিতি। কেবলই মৃত্যু। কেবলই অসুখ। কেবলই হাহাকার। মানুষের এই দুর্দিনেও প্রকৃতি সেজেছে তার আপন রূপে।

সিলেট নগরের চৌহাট্টা এলাকায় রোববার ঘুরে দেখা মেলে রক্তিম কৃষ্ণচূড়ার। ঝুলে আছে উঁচু গাছের ডালে। টিলাগড় এলাকায়ও গিয়ে দেখা মিলল এমন লাল-সবুজের।

নজরুলের গানে আছে কৃষ্ণচূড়া বন্দনা, ‘কৃষ্ণচূড়ার রাঙা মঞ্জুরি কর্ণে/ আমি ভুবন ভোলাতে আসি গন্ধে ও বর্ণে।’

উদ্ভিদবিদদের মতে, কৃষ্ণচূড়া একটি বৃক্ষজাতীয় উদ্ভিদ। উষ্ণ ও শুকনো আবহাওয়া এ ফুলের উপযোগী। সাধারণত এপ্রিল থেকে জুন মাসে কৃষ্ণচূড়া ফোটে। এর বৈজ্ঞানিক নাম ডেলোনিক্স রেজিয়া।

বাঙালির প্রিয় এই ফুলের জন্ম নাকি এখানে নয়। এর আদিনিবাস পূর্ব আফ্রিকার মাদাগাস্কারে। আর রাধাচূড়ার জন্ম নাকি ওয়েস্ট ইন্ডিজে। হতে পারে। কত অতিথিকেই তো আপন করে নিয়েছে বাঙালি।

সিলেট সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে নগরের বিভিন্ন এলাকায় কৃষ্ণচূড়া ও রাধাচূড়া গাছ লাগানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এরই মধ্যে রিকাবিবাজার-সুবিদবাজার সড়কে সিটি করপোরেশনের সহযোগিতায় রাধাচূড়া গাছ রোপণ করেছে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ‘আনন্দ নিকেতন’। এ ছাড়া বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান শেভরণের পক্ষ থেকে সিটি করপোরেশনকে কৃষ্ণচূড়া ও রাধাচূড়ার আড়াই হাজার চারা উপহার দেয়া হয়েছে।

সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা জানান, নগরের বিভিন্ন সড়ক বিভাজক, সুরমা নদীর দুই তীর, নগরের মানিকপীর টিলাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় এসব ফুল গাছের চারা রোপণ করা হচ্ছে।

সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, ‘আমরা নগরের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। ফুলের গাছ লাগানো একটি অংশ। শুধু সড়ক বিভাজকে নয়, নগরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গা ও সুরমা নদীর তীরে কৃষ্ণচূড়া-রাধাচূড়া গাছ রোপণ করা হচ্ছে। আগামী বর্ষায়ও কিছু চারা রোপণ করা হবে।’

আপনার মন্তব্য

আলোচিত