১৮ মে, ২০২১ ১৪:৫৫
ছবি: শহীদুল ইসলাম
ইংরেজি নাম Coral Red Kukri Snake , বৈজ্ঞানিক নাম Oligodon kheriensis। এটি বাংলাদেশের সাপের তালিকায় যুক্ত হওয়া নতুন একটি সাপ। কমলা রঙ্গের এই সাপটি ২০২০ সালের ২৭ অক্টোবর পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার স্থানীয় একটি বাঁশঝাড়ে মাটি খুঁড়তে গিয়ে পাওয়া যায়। পরে সেটি নিয়ে গবেষণা করেন বিশেষজ্ঞরা। এই সাপকে নিয়ে একটি গবেষণা চলতি মাসের ৯তারিখ বৈজ্ঞানিক জার্নাল ‘জার্নাল অফ এশিয়া প্যাসিফিক বায়োডাইভারসিটি' তে প্রকাশিত হয়েছে।
এই গবেষণাটি চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরীর নেতৃত্বে ভেনম রিসার্চ সেন্টার, বাংলাদেশের দুই সহকারী গবেষক বোরহান বিশ্বাস রুমন ও ইব্রাহীম আল হায়দার সম্পন্ন করেন।
গবেষকদের দলের সুত্রে জানা যায়, এই সাপটির বাংলা নাম তার গায়ের রঙের সাথে মিল রেখে “কমলাবতী সাপ” রাখা হয়েছে। গবেষক দলের সদস্য বোরহান বিশ্বাস রুমন এই নামটি প্রস্তাব করেন। এটি Colubridae পরিবারভুক্ত একটি সাপ। পৃথিবীতে এই সাপটি শুধুমাত্র হিমালয়ের অদূরবর্তী অঞ্চলে পাওয়া যায়।
১৯৩৬ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশে সর্বপ্রথম এই সাপটির দেখা পাওয়া যায়। তখন এম এন আচার্য্য ও এইচ সি রায় নামে দুজন জীববিজ্ঞানী এই সাপকে নতুন প্রজাতি বলে তখন সনাক্ত করেন, যা পরবর্তীতে বিখ্যাত জীববিজ্ঞানী ম্যালকম স্মিথ নিশ্চিত করেন। পরবর্তীতে এটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মেঘালয় ও উত্তরাখন্ডে এবং নেপালের বিভিন্ন অঞ্চলে পাওয়া যায়।
গবেষকদের দলের সদস্য ইব্রাহীম আল হায়দার জানান, এই সাপটিকে এর আগে বাংলাদেশে কখনো পাওয়া যায়নি। ২০২০ সালের ২৭শে অক্টোবর পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার স্থানীয় একটি বাঁশঝাড়ে মাটি খুঁড়তে গিয়ে পাওয়া যায়। স্থানীয় স্নেক রেস্কিউয়ার মোঃ শহীদুল ইসলাম এই সাপটি পেয়ে আমাদেরকে ছবি পাঠালে আমরা সাপটি সংগ্রহ করার ব্যবস্থা করি। এই সাপটিকে বাংলাদেশে পাওয়া Oligodon গণের অন্যান্য সাপ থেকে আলাদা মনে হলে আমরা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সাপটির তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করি। প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশে এটি নতুন প্রজাতির সাপ হিসেবে আমরা নিশ্চিত হই। যেহেতু এটি আগে বাংলাদেশে পাওয়া যায়নি, তাই ইতোপূর্বে এর কোন বাংলা নাম ছিল না। আমাদের দলের সদস্য বোরহান বিশ্বাস রুমন এই সাপের নাম কমলবাতী প্রস্তাব করলে আমরা সবাই এই সাপের রঙের সাথে মিল রেখে বাংলা নাম রেখেছি কমলাবতী।
গবেষক দলের আরেক সদস্য বোরহান বিশ্বাস রুমন জানান, এই সাপটি পাওয়ার পর পরে পঞ্চগড় জেলায় এই প্রজাতির আরো ৪ টি সাপ পাওয়া গেছে। আমাদের গবেষণায় পুরো পৃথিবীতে শুধুমাত্র হিমালয়ের কাছাকাছি জায়গায় আমরা এই সাপের বিস্তৃতি পেয়েছি। এছাড়া পৃথিবীর আর কোথাও এই সাপটি পাওয়া যায় না। নতুন এই সাপটির মাধ্যমে বাংলাদেশে বর্তমানে ১০২ টি সাপের অস্তিত্ব পাওয়া গেলো। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (আইইউসিএন) এর সর্বশেষ তালিকা অনুসারে বাংলাদেশে ১০০ টি সাপ রয়েছে। তবে এই তালিকা ২০১৫ সালের। এরপর আমাদের এই নতুন আবিষ্কার হওয়া কমলাবতীসহ দুইটি সাপ পাওয়া গেছে যার ফলে বাংলাদেশে এখন ১০২ প্রজাতির সাপ রয়েছে। যার মধ্যে ১৬ প্রজাতির সাপ সামুদ্রিক।
গবেষকদলের প্রধান চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুল ওয়ায়েদ চৌধুরী জানান, এই সাপ খুবই বিরল। এদের বিষ আছে এবং বিষদাঁত অনেকটা বিষধর সাপের মত বড় তবে ধারণা করা হচ্ছে শুধু মাত্র শিকার ধরে খাওয়ার জন্য যতটা বিষ প্রয়োজন ততটা রয়েছে। তবে বিষ নিয়ে নিশ্চিত হতে গবেষণা চলছে। সারা বিশ্বে এখন পর্যন্ত মাত্র ২৪ থেকে ২৫ বার দেখা গেছে। এই সাপ পানির উৎসের নিকটবর্তী জায়গা, বনভুমি ঘেঁষা অঞ্চল, গ্রামাঞ্চলের ঝোপঝাড়, শস্যখেতে থাকতে পছন্দ করে। হিমালয়ের দক্ষিন পাশে শীতপ্রবন এলাকা তাদের পছন্দ। সম্ভবত জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সাপটি এই দিকে এসে থাকতে পারে। তবে সাপটি পৃথিবী থেকে বিপন্ন হওয়ার আশংকা রয়েছে। এই সাপের বিস্তার রয়েছে এমন জায়গায় ভারত, নেপাল ও বাংলাদেশ মিলে শুধুমাত্র ৮ শতাংশ সংরক্ষিত বনভুমি রয়েছে। তাছাড়া এর বিস্তারের অন্তর্ভুক্ত এলাকার মধ্যে শুধু বিগত বিশ বছরেই ১.৪ শতাংশ বনভূমি নষ্ট হয়েছে বলে আমাদের গবেষণায় উঠে এসেছে। তাছাড়া কৃষি কাজ, কন্সট্রাকশন কাজ, এমনকি রাস্তা পারাপারের সময়েও এই সাপটি বিভিন্ন সময়ে মারা পড়েছে। তাই সবদিক বিবেচনা করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে এই সাপ সংরক্ষণে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া অত্যন্ত জরুরী।
আপনার মন্তব্য