মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান

০৬ এপ্রিল, ২০২৪ ১৫:০০

সম্মানিত ও মহিমান্বিত উম্মতে মুহাম্মাদীর কদরের রাত আজ

আজ লাইলাতুল কদর। এটি একটি সম্মানিত ও মহিমান্বিত রাত। লাইলাতুল কদর সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয় আমি কুরআন নাজিল করেছি লাইলাতুল কদরে।’ ‘লাইলাতুল কদর হাজার মাসের চেয়েও উত্তম।’ ‘এ রাতে ফেরেশতারা ও জিবরাইল তাদের প্রভুর অনুমতিক্রমে সব সিদ্ধান্ত নিয়ে অবতরণ করে। শান্তিময় এ রাত ফজরের সূচনা পর্যন্ত’। (সুরা কদর)।

এ রাত কুরআন নাজিলের রাত। মহত্ত্ব ও গুরুত্ব সহকারে মহান আল্লাহর ইবাদতের রাত। এ রাত হলো হাজার মাস তথা তিরাশি বছর চার মাসের চেয়ে উত্তম। ওই ব্যক্তির চেয়েও ভাগ্যবান আর কে হতে পারে, যে এ রাতে নির্ঘুম থেকে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করার সুযোগ পেয়েছে। এ পবিত্র রাতে ফেরেশতারা পৃথিবীতে আসে মানবজাতির জন্য বরকত, রহমত ও কল্যাণ নিয়ে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পবিত্র লাইলাতুল আমরা সবাই এই মহিমান্বিত রজনীতে মহান আল্লাহতায়ালার দরবারে বিশেষভাবে ইবাদত ও দোয়া করি যেন আল্লাহ বাংলাদেশের জনগণসহ বিশ্ববাসীকে সূর্যাস্তের পরপরই এ রাতে মহান আল্লাহ তার আরশ থেকে প্রথম আকাশে নেমে আসেন। মায়া আর দয়া নিয়ে, প্রেম ও ভালোবাসা দিয়ে মানবজাতিকে ডাকেন আর বলেন, ‘কে আছ পাপী! তুমি ক্ষমা চাও, আমি তোমাকে ক্ষমা করে দেব। কে আছ দুঃখী! আমি তোমার দুঃখ মোচন করব। কে আছ রোগী! আমি তোমাকে সুস্থ করে দেব। কে আছ দায়গ্রস্ত! আমি তোমাকে দায়মুক্ত করে দেব। তোমাদের কার রিজিকের প্রয়োজন! আমার কাছে চাও, আমি তার রিজিক বৃদ্ধি করব।’ মহান আল্লাহ এভাবে ফজর পর্যন্ত ডাকতে থাকেন। যারা তার ডাকে সাড়া দিয়ে প্রার্থনায় লিপ্ত হয়, তারা কল্যাণকামী হয়। সৌভাগ্যবান হয়।

নবিজি (সা.) একদিন সাহাবায়ে কেরামদের (রা.) সামনে বনি ইসরাইলের এক উপাসকের কথা বলছিলেন। সে ব্যক্তি এক হাজার মাস ধরে আল্লাহর ধ্যান ও সাধনায় লিপ্ত ছিল। এ কথা শুনে সাহাবায়ে কেরাম (রা.) আফসোস করতে লাগলেন-আর বললেন, আমরা এত বছর ইবাদত করব কীভাবে? তা ছাড়া আমাদের অনেকে তো এত বছর বেঁচেও থাকি না। ঠিক তখনই জিবরাইল (আ.) এ রাতের সুসংবাদসহ সুরা কদর নিয়ে নবিজির (সা.) কাছে হাজির হলেন এবং এ উম্মতকে শ্রেষ্ঠ উম্মত হিসাবে প্রমাণ করে দিলেন। (তাফসিরে মাজহারি)।

নবিজি (সা.) বলেন, ‘তোমরা মাহে রমজানের শেষ দশকের বিজোড় রাতগুলোতে লাইলাতুল কদর তালাশ করো।’ (বুখারি)। এ রাত হলো জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাওয়ার রাত। হজরত আয়েশা (রা.) একবার রাসুলকে (সা.) জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমি যদি লাইলাতুল কদর সম্পর্কে জানতে পারি, তাহলে আমি ওই রাতে কী দোয়া করব? তখন নবিজি (সা.) বললেন, তুমি এ দোয়াটি করবে-‘আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফউন; তুহিব্বুল আফওয়া, ফা’ফু আন্নি’ অর্থাৎ হে আল্লাহ! তুমি তো ক্ষমাশীল! ক্ষমাকে তুমি ভালোবাসো। অতএব, আমাকে তুমি ক্ষমা করো।

নবিজির (সা.) সময় অনেক সাহাবি (রা.) রমজানের ২৭ তারিখকে লাইলাতুল কদর হিসাবে স্বপ্ন দেখেছেন। সাহাবিরা (রা.) নবিজিকে (সা.) স্বপ্নের কথা জানালে নবিজি (সা.) বলেন, আমিও এমনটা স্বপ্নে দেখেছি। হজরত উবাই ইবনে কাব (রা.) বলেন, ‘মহান আল্লাহর শপথ করে বলছি-নবিজি (সা.) ২৭ রমজানের রাতকে লাইলাতুল কদরের রাত বলেছেন।’ অন্য হাদিসে রয়েছে, নবিজি (সা.) বলেন, ‘তোমাদের কেউ যদি দুর্বল অথবা কোনো কারণে অক্ষম হয়ে থাকে, সে যেন রমজানের ২৭ তারিখ রাতে ইবাদত করে।’ (মুসলিম)। আরেক হাদিসে এসেছে-নবিজি (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদর পেতে চায়, সে যেন তা রমজানের সাতাশতম রাতে অনুসন্ধান করে। (মুসনাদে আহমদ)।
এ রাতে আমরা নফল ইবাদত করব। ধীরগতিতে নফল নামাজ পড়ব। স্থিরতার সঙ্গে রুকু-সিজদা করব। বারবার মহান আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইব। এ রাতে যে ক্ষমা পেল না, তার চাওয়া-পাওয়া সবই ব্যর্থ। তার জীবন পুরোটাই অনর্থ। এ রাতে একনিষ্ঠ চিত্তে মহান আল্লাহর কাছে তওবা করব। আল্লাহর কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হব, জীবনে সব পাপ ছেড়ে দেওয়ার। অন্যায়ের জন্য মহান আল্লাহর কাছে অনুতপ্ত হব। কোনো বান্দার অধিকার নষ্ট করলে, তার অধিকার আদায়ের প্রতিশ্রুতি দেব। মহান আল্লাহর কাছে নিজের দুঃখ-কষ্টগুলো তুলে ধরব। নিজের ভুলগুলো স্বীকার করে তার কাছে ক্ষমা চাইব।

“হাজার মাসের চাইতে যে রাত মহামূল্যবান ‘শবে কদর’ সেই সে রাত শোন মুসলমান।”

আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার রুবুবিয়্যাত অন্যতম নিদর্শন হলো মানবজাতির প্রতি অপার দয়াপরবশ অভিভাবকত্ব। আল্লাহর সৃষ্ট এই মানবজাতি যেন দিকভ্রান্ত ও অসহায় হয়ে না পড়ে, সেজন্যই আল্লাহ তাদের জন্য পাঠিয়েছেন সুস্পষ্ট হিদায়াত ও সঠিক দিক-নির্দেশনা, মহাগ্রন্থ আল কুরআন। সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ এই কিতাব আল্লাহর নিয়ামতগুলোর অন্যতম। তাইতো তিনি এই কিতাব অবতীর্ণ করেছেন নিয়ামতপূর্ণ সময়েই, পবিত্র রমযান মাসে। আর এই পবিত্র কিতাবের মর্যাদা এত অধিক যে, এর মহিমায় মহিমান্বিত হয়েছে একটি রজনী যা হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ।

এই রজনীটি হচ্ছে কুরআন নাযিল হওয়ার রজনী; যাকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ‘লাইলাতুল কদর’ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন।

“নিশ্চয়ই আমরা এ কুরআনকে ‘লাইলাতুল কদরে নাযিল করেছি, তুমি জান, লাইলাতুল কদর কি? লাইলাতুল কদর হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ।” (সূরা আল কদর)

লাইলাতুল কদর হচ্ছে এমনি একটি রাত, যার অবস্থান রমজানের শেষ দশকের মধ্যে। ‘লাইলাতুন’ শব্দের অর্থ ‘রাত’। ‘কদর’ শব্দের অর্থ ‘নির্ধারণ করা, সম্মান করা, অতএব ‘লাইলাতুল কদর’ শব্দের অর্থ ‘নির্ধারণ করার রাত’, ‘সম্মানিত রাত’। লাইলাতুল কদরকে “লাইলাতুল মুবারাকান’ ও বলা হয়।

“বরকতময় রাতে প্রত্যেকটি মজবুত হুকুম সিদ্ধান্ত করা হয়।” (সূরা দুখান)

“কদরের রাতে ফেরেশতাগণ ও রুহ জিবরাইল (আ:) তাদের প্রভুর অনুমতিক্রমে প্রত্যেকটি হুকুম নিয়ে অবতীর্ণ হন।” (সূরা কদর)

এই দু’টি আয়াত থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, রাতে সৃষ্টির সাথে সম্পর্কিত সমস্ত বিষয়ে আল্লাহর হুকুম নিয়ে ফেরেশতাগণ দুনিয়ায় আসেন।

ইমাম নববী ও মোল্লা আলী ক্বারি বলেন, মুজতাহিদ আলেমগণ বলেছেন, এ রাতকে কদরের রাত (নির্ধারণ করার রাত) এজন্য বলা হয় যে, এক বছরের সমস্ত রিজিক, ভাগ্যসমূহ, যত মানুষের জন্ম হবে এবং যত মানুষের মৃত্যু হবে, তা এ রাতে ফেরেশতাদের দ্বারা লেখানো হয় (নির্ধারণ করা হয়)।

এছাড়া ভাগ্য নির্ধারণের আরেকটি অর্থ হচ্ছে, এই রাতে এমন একটি কিতাব (আল কুরআন) নাযিল হয়েছে, যা সমগ্র বিশ্ববাসীর ভাগ্য বদলে দিতে সক্ষম।

“লাইলাতুল কদর হচ্ছে হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।” (সূরা কদর)

“রমজান মাসে এমন একটি রাত আছে যা হাজার মাসের চেয়ে উত্তম। যে ব্যক্তি এ রাত থেকে বি ত হবে, সে সমস্ত কল্যাণ থেকে বি ত হবে, এর কল্যাণ থেকে একমাত্র হতভাগ্য লোক ছাড়া আর কেউ বি ত হয় না।” (ইবনে মাজাহ, মিশকাত)

ইমাম যুহরী বলেন, “এ রাত অতীব উচ্চমান, মর্যাদা ও মাহাত্ম্যের রাত্রি।”

শবে কদরের রাত মর্যাদা ও মূল্যের দিক থেকে, এ রাতে সংঘটিত ঘটনার দিক থেকে, এ রাতে বণ্টনকৃত এবং সংগৃহীত এমন ভাণ্ডারের দিক থেকে হাজার মাস তথা হাজার বছরের চেয়ে উত্তম।

হযরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, কদরের রাতে ফেরেশতার সংখ্যা পাথর কণার চেয়ে বেশি হয়ে থাকে। ফলে শয়তানের রাজত্ব বাতিল হয়ে যায় এবং সে রাতে লোকেরা শয়তানের ক্ষতি থেকে নিরাপদ থাকে।

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন, এ রাতের সৎ কাজ হাজার মাসের সৎ কাজের চেয়ে উত্তম। যে ব্যক্তি এ রাতে কিয়াম করবে তাকে সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেয়ার সুসংবাদ দেয়া হয়েছে, অন্যান্য রাতের মত এই রাতেও সেই নির্দিষ্ট সময়টি আছে, যখন দোয়া কবুল করে নেয়া হয়। এ রাতে ইহকাল ও পরকালের যে কোন কল্যাণ প্রার্থনা করা হয়, তা প্রদান করা হয়। এই মহান রহমত ও বরকতময় ফযিলতের ভিত্তিতেই আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এই রাতকে হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতম রাত বলে আখ্যায়িত করেছেন।

“নিশ্চয়ই আমি পবিত্র কুরআন মাজীদ অবতীর্ণ করেছি কল্যাণময় রজনীতে।” (সূরা দুখান)

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আরও বলেন, “হে মানবজাতি। তোমাদের নিকট তোমাদের প্রভুর পক্ষ থেকে পথ প্রদর্শক এসে গেছে। এটা সেই জিনিস যা অন্তরের সুস্থতা নিরাময় করে, যারা এটা গ্রহণ করবে তাদের জন্য পথপ্রদর্শক ও রহমত হিসেবে কাজ করবে। (হে নবী!) আপনি বলে দিন যে, আল্লাহ অত্যন্ত করুণা ও মেহেরবানী করে এ মহামূল্যবান জিনিস পাঠিয়েছেন, এ কারণেই লোকদের উৎসব করা উচিত। মানুষ যা কিছু সংগ্রহ করার কাজে ব্যস্ত সেসব কিছুর চেয়ে এটা শ্রেষ্ঠ।” (সূরা ইউনুস : ৫৭-৫৮)

কদরের রাত অন্য আট-দশটা সাধারণ রাতের মত নয়। সমগ্র মানবতা ও সমগ্র সৃষ্টিজগতের ভবিষ্যৎ সম্পৃক্ত হয়ে থাকে এ রাতে। কদরের রাত উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে এমন করুণা, যাতে অল্প আয়াসে, অল্প বয়সে বান্দা অধিক পরিমাণ ইবাদতের মর্যাদা অর্জন করতে পারে। তবে, যদি কেউ চিন্তা করে যে, সারাজীবন আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে শুধু কদরের রাতে ইবাদত করলেই জান্নাত পেয়ে যাবে, তাহলে তা হবে চরম বোকামি। নবী (সা.) ও সাহাবায়ে কেরামগণ সারাজীবন আল্লাহর আদেশ নিষেধ মানার সাথে সাথে কদরের রাতকেও যথাযথভাবে পালন করেছেন। এভাবে জীবন ধারণকারীই হবেন আল্লাহর পছন্দনীয় বান্দা।

লাইলাতুল কদর একটি মহান রাত, যে রাত সম্পর্কে কুরআনে পূর্ণ একটি সূরা নাযিল হয়েছে। স্বয়ং আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.) স্পষ্ট ও পরিষ্কারভাবে কদরের রাতের ফযিলত বর্ণনা করেছেন।

বরকতময় রাতে সৃষ্টির ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেরেশতাগণ আসেন। (সূরা দুখান) অর্থাৎ ভাগ্য নির্ধারণের রাত এটি।

রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, “রমযান মাসে এমন একটি রাত আছে, যা হাজার মাস হতে উত্তম, যে ব্যক্তি সে রাতের কল্যাণ থেকে বি ত হবে, সে সমগ্র কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হবে, এর কল্যাণ থেকে একমাত্র হতভাগ্য লোক ছাড়া আর কেউ বঞ্চিত হয় না।” (ইবনে মাজাহ, মিশকাত, আত তারগীব)

বুখারী শরীফের হাদিসে এসেছে, রাসুল (সা.) বলেন, “যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদরে ঈমানসহ সওয়াবের নিয়তে ইবাদতের জন্য দাঁড়াবে, তার পেছনের সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে।”

এ রাতে ইবাদতকারীকে ফেরেশতাগণ সালাম ও করমর্দন করে, তাদের দোয়ায় আমীন আমীন বলতে থাকে। রাসুল (সা.) বলেন, “যখন কদরের রাত উপস্থিত হয়, তখন আল্লাহ জিবরাঈল (আ.)-কে নির্দেশ দেন এবং তদনুযায়ী জিবরাঈল (আ.) বিরাট একদল ফেরেশতা নিয়ে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হন। আর তাদের সাথে সবুজ বর্ণের একটি নিশান থাকে। অতঃপর তারা নিশানটিকে কাবাঘরের মাঝখানে গেড়ে দেন। জিবরাঈল (আ.)-এর একশত ডানা (পাখা) আছে, সেগুলোর মধ্যে এমন দু’টি ডানা আছে যা তিনি কদরের রাত ছাড়া আর কোন রাতে খুলেন না। তিনি সে ডানা দু’টি এই রাতে বিস্তৃত করেন এবং তা পূর্বপ্রান্ত হতে পশ্চিমপ্রান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। এরপর তিনি ফেরেশতাগণকে উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন। ফেরেশতাগণ ঐ সমস্ত লোককে সালাম করতে থাকে যারা দাঁড়িয়ে, বসে ইবাদত করে আর যারা নামায পড়ে এবং যারা আল্লাহকে স্মরণ করে, তারা তাদের সাথে করমর্দন করে এবং তাদের দোয়ায়ও শামিল হয়ে আমীন আমীন বলতে থাকে ফজর উদয় হওয়া পর্যন্ত। অতঃপর ফজর হলে জিবরাঈল (আ.) উচ্চস্বরে বলেন, হে ফেরেশতাগণ! চল, চল, তখন ফেরেশতাগণ বলে, হে জিবরাঈল। আহমাদ (সা.) এর মুমিন উম্মতের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও প্রয়োজনগুলো সম্বন্ধে আল্লাহ তায়ালা কি করলেন? উত্তরে তিনি বলেন, আল্লাহ তায়ালা এ রাতে তাদের প্রতি সুদৃষ্টি নিক্ষেপ করেছেন এবং তাদের সম্পূর্ণরূপে ক্ষমা করেছেন।” (আত তারগীব ওয়াত তারহীত)

প্রকৃতপক্ষে লাইলাতুল কদর উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য একটি মহামূল্যবান নিয়ামত, পূর্ববর্তী আম্বিয়ায়ে কেরামগণের উম্মতগণ দীর্ঘ আয়ু পাওয়ার কারণে স্বভাবতই আল্লাহর ইবাদত বেশি বেশি করতে পারতেন। পক্ষান্তরে উম্মতে মুহাম্মদী স্বল্প আয়ু পাওয়া সত্ত্বেও যাতে ইবাদত বন্দেগীর দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য লাভে তাঁদেরকে ছাড়িয়ে যেতে পারে, সেজন্য মহান আল্লাহ দয়াপরবশ হয়ে এ রজনীর ব্যবস্থা করেছেন।

তবে, চার শ্রেণির লোকেরা এ রাতের বরকত হতে বি ত হবেন। ১. শরাবখোর, ২. মাতাপিতার অবাধ্যচারী নাফরমানকারী সন্তান, ৩. আত্মীয়তার সম্পর্কচ্ছেদকারী, ৪. হিংসুক-নিন্দুক। (আত তারগীব ওয়াত তারহীব)

অন্যদিকে যারা বিশ্বাসগতভাবে মুনাফিক; ইসলাম ও কুফরের মাঝে যখন যেটা প্রয়োজন, সেটাকে গ্রহণ করে, এ রাতে তারাও বঞ্চিত হবে।

অবশ্য এ ধরনের পাপাচারে লিপ্তরা যদি খালেসভাবে তওবা করে এবং বাকী জীবন পুতপবিত্র হয়ে চলার সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে আল্লাহ তাদেরকে নিজ করুণা ও দয়ার মাঝে শামিল করে নেন।

লাইলাতুল কদর রমজানের শেষ দশকের কোন রাতটিতে, তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। বিভিন্ন হাদিস থেকে জানা যায় যে, রমজানের মাসের শেষ দশদিনের বেজোড় রাতগুলোর মধ্যে কোন একটি অর্থাৎ ২১শে, ২৩ শে, ২৫ শে, ২৭ শে, বা ২৯ শে রাত হচ্ছে কদরের রাত।

হযরত আয়শা (রা.) বলেন, নবী (সা.) বলেন, “আমাকে শবে কদর দেখানো হয়েছে, তারপর আমি তা ভুলে গিয়েছি বা আমাকে ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে। অতএব তোমরা রমযানের শেষ দশদিনের বেজোড় রাতগুলোতে লাইলাতুল কদর সন্ধান কর।” (বুখারী)

এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে যে লাইলাতুল কদরের রাতটির এই গোপনীয়তার রহস্য কী? আসলে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এ রাতকে গোপন রেখেছেন আমাদের উপর রহম করেই। তিনি দেখতে চান, এই বরকত ও ফযিলত লাভের জন্য কে কত প্রচেষ্টা চালায়। কদরের রাতকে গোপন রাখার মধ্যে আছে আল্লাহ তায়ালার বিরাট হিকমত ও রহস্য। প্রত্যেক মূল্যবান বস্তু হাসিল করা যেমন কষ্টসাধ্য ব্যাপার, তেমনি আল্লাহ তায়ালার উদ্দেশ্য হলো এ মহামূল্যবান রাতের অনুসন্ধানে বান্দাগণ সাধনা করুক, শবে কদরের তারিখ গোপন থাকায় বেশ কিছু সুবিধা পেয়েছে, এ উম্মত।

এক. এ কারণে আজকেই শবে কদর কী না ভাবতে ভাবতে অনেকগুলো রাত ইবাদত করার সুযোগ হবে।

দুই. তা না থাকলে ঐ দিনটি ছুটে গেলে পরবর্তী রাতগুলোতে মন ভরে ইবাদতের মাধ্যমে সে ক্ষতি পূরণের মানসিকতা থাকে না।

তিন. যতগুলো রাত এভাবে ইবাদতে কাটাবে প্রত্যেকটিরই স্বতন্ত্র প্রতিদান মিলবে।

চার. যারা স্বভাবজাত অপরাধী তারা জেনেশুনে ঐ নির্দিষ্ট রাত জানা সত্ত্বেও রাতটি অবহেলা করে খোদাদ্রোহিতা করত।

মহিমান্বিত রজনীর নির্দশনসমূহ
আবু মুনাযির (রা.) ও অন্যান্য সাহাবাগণের প্রশ্নের উত্তরে আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন যে, “এই রাতের পরবর্তী সকালে সূর্য আলোক রশ্মিহীন অবস্থায় উদিত হয়।” (মুসলিম)

এই রাতের আরও কিছু নিদর্শন এমন-কদরের রাত তিমিরাচ্ছন্ন হবে না। নাতিশীতোষ্ণ হবে।

মৃদু বায়ু প্রবাহিত হবে।

উক্ত রাতে মুমিনগণ ইবাদত করে অন্যান্য রাত অপেক্ষা অধিক তৃপ্তি পাবেন।

ঐ রাতে বৃষ্টি বর্ষণ হতে পারে।

হয়তোবা আল্লাহ তাঁর কোন ঈমানদার বান্দাকে তা স্বপ্নে দেখাবেন।

এ রাতে আমাদের করণীয়
রাসুলে কারীম (সা.) সর্বদা রমজানের শেষ দশ দিলেন এতেকাফ করতেন এবং স্বীয় পরিবার পরিজনকেও সজাগ রাখতেন। হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, “রমজানের শেষ দশক এলে রাসুল (সা.) স্ত্রীদের থেকে পৃথক হয়ে যেতেন। নিজে সারা রাত ইবাদত করতেন এবং পরিবার-পরিজনদের ইবাদতের জন্য সজাগ করে দিতেন।” (বুখারী)

তাই আমাদের যা যা করা উচিত:
১) রাতের প্রথম অংশেই মাগরিব ও এশার সালাত আদায় করা।

২) রাতের কিছু অংশ কোরআন তেলাওয়াত ও অধ্যয়ন করা।

৩) বিশেষ একটি অংশে তারাবীহর সালাত ও নফল/ তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করা।

৪) বেশি বেশি যিকর, দরূদ, তাসবীহ পাঠ করা।

৫) তাওবা এস্তেগফার করা ও আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করা।

৬) দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণের জন্য বেশি করে দোয়া করা, কারণ এটি দোয়া কবুল হওয়ার সুবর্ণ সুযোগ।

৭) প্রয়োজন হলে বিশ্রাম নেয়া এবং সেহরি ও ফজরের সালাত আদায় করা।

৮) আল্লাহর রাসুল (সা.) আয়েশা (রা.)-কে এই রাতের জন্য একটি দোয়া শিখিয়ে দিয়েছেন, তা হলো : “আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন তুহিব্বুল আফওয়া ফা’ফু আন্নী” অর্থাৎ “হে আল্লাহ! তুমি ক্ষমাশীল! ক্ষমা করাকে তুমি পছন্দ কর, অতএব আমাকে ক্ষমা কর।” (আহমাদ, তিরমিযী)

মানুষের ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় জীবন পর্যন্ত কুরআনের নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্যই এই মহাগ্রন্থের আবির্ভাব। এই কুরআন এসেছে ইসলামকে সমস্ত মত ও পথের উপর বিজয়ী করতে। তাই যেই মহিমাময় কুরআনের জন্য লাইলাতুল কদর হয়েছে মহিমান্বিত। সেই কুরআনকে যদি আমরা আমাদের সারা জীবনের গাইড লাইন হিসেবে অনুসরণ না করি, তাহলে কদর রাতের ইবাদত নিছক আনুষ্ঠানিকতা বৈ আর কোন কল্যাণ বয়ে আনবে না। অতএব কদর রাতের যথাযথ ইবাদত ও আল কুরআনের প্রকৃত অনুসরণেই কেবল আমরা অবগাহন করতে পারবো ঐ রাতের রহমতের ঝর্ণাধার!

আপনার মন্তব্য

আলোচিত