শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ

১৯ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০১

স্মরণ : হৃদয়ে সঞ্জীবদা এবং কিছু কথা

মানুষ জন্মগ্রহণ করে, পৃথিবীতে জীবনযাপন করে কিছুদিন, তারপর মৃত্যুতে ঘটে তার পরিসমাপ্তি। এভাবে যতো মানুষ আসে, সবাই চলে যায়। দু’চারদিন পর তাকে ভুলে যায় সবাই। এটাই সাধারণের ক্ষেত্রে ঘটে থাকে। কিন্তু যিনি কীর্তিমান, মানুষের মনে অপার ভালোবাসা যিনি রেখে যান, তাকে কেউ বিস্মৃত হয় না। তিনি থাকেন এবং নানা প্রসঙ্গে ঘুরে-ফিরে আসেন আমাদের মধ্যে। এমনই একজন মানুষ সঞ্জীব চৌধুরী, আমাদের প্রিয় সঞ্জীব দা। আজ (১৯ নভেম্বর) তার নবম মৃত্যুবার্ষিকী।

২০০৭ সালের এই দিনে তিনি বাইলেটারেল সেরিব্রাল স্কিমিক স্ট্রোকে ঢাকার অ্যাপোলো হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর মৃত্যুতে সাহিত্য-সংস্কৃতি, গানপাড়া, সাংবাদিক অঙ্গনসহ সারাদেশে শোকের ছায়া নেমে আসে। ১৯৬৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর তিনি হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং উপজেলার মাকালকান্দি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিষয়ে মাস্টার্স পাশ করে আশির দশকে সাংবাদিকতা শুরু করেন সঞ্জীব চৌধুরী।

আজকের কাগজ, ভোরের কাগজ ও যায়যায়দিনসহ বিভিন্ন দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকায় কাজ করেছেন তিনি। সর্বশেষ কাজ করেছিলেন যায়যায়দিনের ফিচার এডিটর হিসেবে। এখন যারা প্রিন্ট মিডিয়ায় সাংবাদিকতা করছেন তাদের অনেকেই সঞ্জীব চৌধুরীর হাতে গড়া। ছাত্র জীবনে ‘শঙ্খচিল’ নামে একটি গানের দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি।

১৯৯৬ সালে বাপ্পা মজুমদারের সঙ্গে একত্রিত হয়ে গঠন করেন ভিন্নধর্মী ব্যান্ড দলছুট। স্বপ্নবাজি নামে একটি একক অ্যালবাম মুক্তি পায় তার। ব্যান্ড ও সলো অ্যালবামে সঞ্জীব চৌধুরীর গাওয়া জনপ্রিয় গানের মধ্যে রয়েছে গাড়ি চলে না, বায়োস্কোপ, আমি তোমাকেই বলে দেবো, কোন মেস্তিরি বানাইয়াছে নাও, আমাকে অন্ধ করে দিয়েছিল চাঁদ, সাদা ময়লা রঙিলা পালে, চোখ, কথা বলবো না প্রভৃতি। শিল্পী হিসেবে যতোটা জনপ্রিয় ছিলেন সঞ্জীব চৌধুরী, তারচেয়ে বেশি জনপ্রিয় ছিলেন গীতিকার ও সুরকার হিসেবে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অনেক গীতিকারই তার দ্বারা প্রভাবিত। গানের পাশাপাশি কবিতাও লিখতেন সঞ্জীব চৌধুরী। দেশের প্রায় সব পত্রিকায়ই তার কবিতা ছাপা হয়েছে। তার একমাত্র কাব্যগ্রন্থের নাম রাশপ্রিন্ট।

শুধু কবিতা নয়, সঞ্জীব চৌধুরী বেশ কিছু ছোট গল্প ও নাটকের স্ক্রিপ্ট লিখেছেন। সঞ্জীব চৌধুরী অভিনীত একমাত্র নাটক ‘সুখের লাগিয়া’। সৃজনশীল ও মেধাবী এ মানুষটির মৃত্যুতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সৃজনশীলতার অনেক শাখা। তবু আমাদের বলতে হয়, সঞ্জীব চৌধুরীদের মৃত্যু নেই, তারা চিরকালই মানুষের স্মৃতিতে ভাস্বর!

এক নজরে সঞ্জীব চৌধুরীর জীবনধারা: সত্তরের দশকে অকালপ্রয়াত অসামান্য মেধাবী ছাত্র, ঢাকা কলেজের বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী খান মুহাম্মদ ফারাবির একটি কবিতা সঞ্জীব চৌধুরী প্রায়ই মুখস্থ শোনাতেন। ‘আমি তো তাদেরই জন্য,/ সূর্যের দিকে চেয়ে থাকবার অভ্যাসে যারা বন্য!/ আমি তো তোমারই জন্য,/ কপাল রাঙানো যে মেয়ের টিপ রক্তের ছোপে ধন্য!’ এই রঞ্জিত উজ্জ্বল পথ ধরেই ১৯৭৮ সালে মেধাতালিকায় স্থান পেয়ে সঞ্জীব চৌধুরী ঢাকা কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। তাঁর আদি নিবাস ছিল সিলেটের হবিগঞ্জে।

অত্যন্ত মেধাবী, সংস্কৃতিমনা ও প্রগতিশীল পরিবেশে তাঁর জন্ম। ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে ক্যান্টিনে তাঁর কাছে দেখা যেত কবিতার বই। প্রিয় কবি নির্মলেন্দু গুণের না প্রেমিক না বিপ্লবী, প্রেমাংশুর রক্ত চাই; আরও থাকত আবুল হাসান (অকালপ্রয়াত) রচিত যে তুমি হরণ করো, পৃথক পালঙ্ক ও রাজা যায় রাজা আসে। এ ছাড়া দেখা যেত মহাদেব সাহার চাই বিষ অমরতা আর শামসুর রাহমান, সুভাষ মুখোপাধ্যায় ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা।

গণিতে ভালো দখল ছিল বলে তাঁর পরিবার স্বপ্ন দেখত, তিনি হয়তো একজন প্রকৌশলী হবেন। আর ঢাকা কলেজে বিজ্ঞান বিভাগের মেধাতালিকায় স্থান পাওয়া খুব কম ছাত্রই পরে ব্যান্ড গিটারিস্ট, সাংবাদিক বা কবি-গীতিকবি হয়েছেন। কামিয়াব সঞ্জীব তাই সফল অর্থেই ‘দলছুট’। ঢাকা কলেজে পড়ার সময়ই তাঁর দৃঢ় সিদ্ধান্ত ছিল, স্বপ্ন ছিল, একটি বৈষম্যহীন অসাম্প্রদায়িক সমাজের জন্য সমাজবদলের লড়াইয়ে সময়, মেধা ও জীবন উৎসর্গ করবেন।

১৯৭৯-৮০ সালে তিনি ঢাকা কলেজের বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তাঁর প্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিল ফ্যাসিস্টবিরোধী আন্দোলনে শহীদ সোমেন চন্দ, খান মুহাম্মদ ফারাবি, প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও শহীদ কমরেড তাজুল ইসলাম। ১৯৭৮ থেকে ১৯৯০ সময়ে লেখাপড়া, ছাত্র পড়ানো আর দৈনন্দিন জীবনযুদ্ধের ফাঁকে ফাঁকে সঞ্জীব রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। তাঁর গান, কবিতা আর ছড়ায় ছিল নতুন দিনের হাতছানি।

আশির দশকের অস্থির সময়ের মধ্যেই প্রকাশিত হয় সঞ্জীবের রাশপ্রিন্ট গ্রন্থটি। তাঁর আরও অনেক লেখা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, যা লুপ্তপ্রায়। আজ তাই জরুরি সেগুলো দ্রুত সংকলন করে প্রকাশ করা। ১৯৯০ সালে জালেমশাহীর দুঃশাসন আর শোষণের অবসানে রাজপথ কাঁপিয়ে গর্জে ওঠে বিক্ষুব্ধ জনতা, উত্তপ্ত হয়ে ওঠে ঢাকা। এ সংগ্রামে বিজয়ী হওয়ার আশায় বুক বাঁধেন ছাত্র-রাজনীতিবিদদের সঙ্গে সঞ্জীব চৌধুরীও। এ বিরতিতে গান বাঁধেন তিনি। মিছিল-মিটিং থেকে শুরু করে মেতে ওঠেন ব্যান্ডের কনসার্টে কনসার্টে। তাঁর খ্যাতি ও যশ ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে।

সাংবাদিকতাও করেন দীর্ঘদিন ভোরের কাগজ-এ। এ সময় ঘর বাঁধেন তিনি। এক কন্যাশিশুর জন্ম হয়, নাম রাখেন কিংবদন্তি।

শেষ কয়েকটা বছর দলছুটের গায়ক হিসেবে অনেকের কাছেই প্রিয় নাম ছিলো সঞ্জীব চৌধুরী। তাঁর গানের কথায় আর সুরে সৃজনশীলতার স্বাক্ষর ভাস্বর। তিনি প্রায়ই গাইতেন ‘মানুষ জন্ম দিয়ে বিধি,/ পাঠিও না পৃথিবীতে,/ এত দুঃখ পেলাম আমি,/ মাপার মতো নেইকো ফিতে’।

ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন হাসিখুশি, আড্ডাবাজ আর বন্ধুবৎসল। তাঁর সৎ চেতনা, সুন্দর স্বপ্ন আর অগাধ মানবিক বিশ্বাসের চিরঞ্জীব অগ্রযাত্রা আজ সব মানুষেরই একান্ত কাম্য।

যেভাবে চলছে সঞ্জীব চৌধুরীর পরিবার: সঞ্জীব চৌধুরী মারা যাওয়ার পর বন্ধু-বান্ধব, শুভাকাঙ্খীসহ মিডিয়া সংশ্লিষ্ট সবাই তার পরিবার নিয়ে দুশ্চিন্তা প্রকাশ করেছিলেন। পরিবারটিকে টিকিয়ে রাখার জন্য কেউ কেউ আর্থিক সহযোগিতার কথাও বলেছেন। দেখতে দেখতে নয়-টি বছর পার হয়ে গেল!, কিভাবে চলছে সঞ্জীব চৌধুরীর পরিবার? এ প্রশ্নটি কী আজ আর কারো মনে উঁকি দিচ্ছে?

এ ব্যাপারে সঞ্জীব চৌধুরীর স্ত্রী শিল্পীকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, আমি মায়ের সঙ্গে নিজ বাড়িতে থাকছি। আমাদের কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। কিংবদন্তিকে নিয়ে আমি বেশ ভালো আছি। সঞ্জীব চলে যাওয়ার পর অনেকেই আমাদের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন, আমি বিনয়ের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেছি। বলেছি, ভবিষ্যতে দরকার হলে চেয়ে নেবো। দুস্থ শিল্পী হিসেবে নিজের জন্য সাহায্য তোলা হবে; এটা খুবই অপছন্দ করতো সঞ্জীব। আমার নিজেরও পছন্দ নয়। হাসপাতালে থাকাকালে সঞ্জীবের জন্য অনেকেই অনেক কিছু করেছেন, আমি তাদের কাছে কৃতজ্ঞ। এখনো যারা সহযোগিতা করতে চাইছেন, তাদের কাছেও কৃতজ্ঞ আমি।

এ ব্যাপারে বাপ্পা মজুমদার বলেন, দাদা দলছুটের আজীবন সদস্য। দলছুটের পক্ষ থেকে দাদার জন্য একটা ফান্ড করা হয়েছে। দলছুটের স্টেজ শো ও অ্যালবামের রয়ালিটি থেকে দাদার ফান্ডে নিয়মিত টাকা জমা হচ্ছে। এ টাকা আমরা শিল্পীর হাতে তুলে দিতে চেয়েছিলাম। শিল্পী এ টাকা নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে এবং বলেছে, টাকাগুলো কোনো সামাজিক কাজে ব্যবহার করতে কিংবা গরিব-দুঃখী আর এতিমদের মধ্যে বিতরণ করতে।

একমাত্র মেয়ে কিংবদন্তি: সঞ্জীব চৌধুরীর একমাত্র মেয়ে কিংবদন্তি চৌধুরী। ২০০৪ সালের ১৮ মে জন্ম তার। সঞ্জীবদার মৃত্যুর সময় তার বয়স প্রায় সাড়ে ৪ বছর। এই বয়সের শিশু কন্যা কিংবদন্তি এখনো বুঝে উঠতে পারেনি বাবা হারানোর বেদনা। তাই বেশ হেসে-খেলেই জীবন পার হচ্ছে তার। তবে হঠাৎ হঠাৎ বাবার কথা বলে উঠে সে। টিভিতে সঞ্জীব চৌধুরীর কোনো গান দেখলেই খুব খুশি হয়, দৌড়ে গিয়ে মাকে খবর দেয়। বাপ্পা মজুমদারকে দেখলেও একই রকম প্রতিক্রিয়া হয় তার। মিরপুরের এফএম মেথড স্কুলে পড়ছে কিংবদন্তি। টিভিতে তার প্রিয় অনুষ্ঠান কার্টুন। টম অ্যান্ড জেরির ভীষণ ভক্ত সে। বড় হয়ে কি হতে চায় জানতে চাইলে কিংবদন্তি বলে, বড় হয়ে আমি ডাক্তার হবো। অবচেতন মন হয়তো বাবার চলে যাওয়াটা মেনে নিতে পারেনি।

সঞ্জীব চৌধুরীকে নিয়ে তাঁর স্ত্রীর কিছু কথা: মিরপুরের প্রিয়াঙ্গন আবাসিক এলাকায় মায়ের বাড়িতে থাকেন সঞ্জীব চৌধুরীর স্ত্রী খন্দকার আলেমা নাসরীন শিল্পী। মা ছাড়াও এ বাড়িতে আরো রয়েছেন ছোট বোন ও তার স্বামী। মা ও ছোট বোন চাকরি করেন উত্তরা ব্যাংকে। ছোট বোনের স্বামী ডাক্তার। সকালে ঘুম থেকে উঠেই যে যার কাজে চলে যান আর শিল্পী সারাটা দিন কাটিয়ে দেন কিংবদন্তির পড়াশোনা ও টেক কেয়ার করে।

ভোরের কাগজ, আনন্দ ভুবনসহ কয়েকটি পত্রিকায় লেখালেখি আর পরে ডাইং ফ্যাক্টরি ও কপি রাইটার হিসেবে অ্যাড ফার্মে চাকরি করলেও এখন আর কিছুই করছেন না তিনি। কিংবদন্তি বড় হওয়া পর্যন্ত, নিজেই নিজের দায়িত্ব নেয়া পর্যন্ত আর কোনো চাকরি করবো না। ওর বাবা না থাকায় একই সঙ্গে আমাকে বাবা ও মায়ের দায়িত্ব পালন করতে হয়।...দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে এমনটি-ই বলেন বৌদি (সঞ্জীবদার স্ত্রী)।

সঞ্জীব চৌধুরীর অভাব কতোটা পীড়িত করে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা আসলে কাউকে বলে বোঝানোর মতো নয়। একজন মানুষের শূন্যতা প্রতি মুহূর্তেই অনুভূত হয়। এ অনুভূতি ভাষাহীন। তবে গান শুনতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয় আমার। আমি তাই সিডি বাজিয়ে ওর গান শুনতে পারি না। মাঝে মাঝে রেডিওতে বাজে, তখন শোনা হয়। আমি চাই ওর গান আরো বেশি বেশি করে বাজুক, মানুষ ওর গান শুনুক। সঞ্জীব তো বেঁচে আছে ওর গানেই। গান ছাড়াও সঞ্জীবের মূল প্রফেশন ছিল সাংবাদিকতা। শেষের দিকে সঞ্জীব সাংবাদিকতা নিয়ে খুব হতাশ হয়ে পড়েছিল। সব সাংবাদিকের জন্যই ওর খুব দুঃখ হতো। ও বলতো, এটা হচ্ছে সার্বক্ষণিক একটা অনিশ্চয়তার জায়গা।

হৃদয়ে সঞ্জীবদা এবং কিছু কথা: জীবন একটাই, আর সেটাকে পুরোপুরি উপভোগ করে আমাদের চোখের আড়ালে চলে গেল সঞ্জীব চৌধুরী। তাঁর সাথে আমার ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতা ছিলো। হাসিখুশি, আনন্দ-উচ্ছল, সৃজনশীল এক মানুষ। সবসময়-ই যেন একজন প্রাণবন্ত মানুষ। সকলের সাথে আমাকে তিনি পরিচয় করিয়ে দিতেন নিজের বন্ধু হিসেবে। বয়সের বৈষম্যকে কখনোই প্রাধান্য দেননি তিনি। আমাদের কাছে এই মৃত্যু ভাবনায় ছিল না, কামনার তো নয়ই। মাত্র ৪৪ বছরের জীবন! কেউ এই সময়টাকেই যথেষ্ট মনে করেন, আবার অন্যরা হয়তো না। যাই হোক। আমার দৃষ্টিতে সজ্ঞীবদা ছিলেন অসামান্য প্রতিভার অধিকারী। কিন্তু সেই প্রতিভার স্বীকৃতি কী তিনি পেয়েছেন?

সঞ্জীবদার মৃত্যুর সময় আমি এ দেশের একটি প্রতিষ্ঠিত দৈনিকে কর্মরত। তাঁর মৃত্যুর সময় দেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগে আক্রান্ত। মাত্র ৩ দিন আগেই দেশের উপর দিয়ে বয়ে গিয়েছিলো প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় সিডর। এতো বিপর্যয়ের মাঝেও সঞ্জীবদার স্মরণে পত্রিকা কর্তৃপক্ষ বিশেষ সংখ্যা বের করতে বাধ্য হয়েছিলো। এতো গুণী লেখকের লেখা আসছিলো যে আমরা সেই বিশেষ সংখ্যা বের করতে রীতিমতো হিমশিম খেয়েছি।

সঞ্জীবদার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে আমি ওই একই পত্রিকায় কর্মরত। বিস্ময়কর বিষয় হচ্ছে, তাঁর স্মরণে কেউ কিছু লেখা তো দূরের কথা,তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীর সংবাদটি পর্যন্ত কোন পত্রিকায় আসেনি। সঞ্জীবদার লাশ নিয়ে মিছিল করে দলছুটের কর্ণধার বাপ্পা মজুমদার বলেছিলেন, কিংবদন্তী আমাদের কন্যা,তার ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার দায়িত্ব আমাদের। বাপ্পার কাছে আমার প্রশ্ন, তিনি সঞ্জীবদার কন্যার জন্য কী করেছেন?

সঞ্জীবদার লেখা ও সুর দেয়া গান গুলো যখন তিনি পরিবেশন করেন,তখন কী একটি বারের জন্যও সঞ্জীব চৌধুরীর নাম তিনি স্মরণ করেন? সঞ্জীবদার পরিবার আজ কতোটা মানবেতর জীবন যাপন করছেন,সে খবর কেউ কী জানতে চাইবেন? এক সময় যারা বৌদির হাতের রান্না খাওয়ার জন্য তার বাসায় ভিড় জমাতেন,আজ তাদের আর খুঁজে পাওয়া যায় না। প্রগতিশীল চিন্তার অধিকারী সঞ্জীব চৌধুরী নিজের ধর্মের ঊর্ধ্বে ভিন্ন ধর্মের একজনকে বিয়ে করার অপরাধে প্রতি পদে পদে বিড়ম্বিত হয়েছেন। তিনি বেঁচে থাকতে ঝামেলা তবুও কম ছিলো। কিন্তু তাঁর অকাল প্রয়াণে সঞ্জীব চৌধুরীর স্ত্রী খন্দকার আলেমা নাসরীন শিল্পী আজ মানসিকভাবে চরম বিপর্যস্ত। আর্থিক অনটনে তার কন্যার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। তিনি কারো দান গ্রহণ করেন না। তাকে তার প্রাপ্য সম্মানটুকুও এই ভণ্ড জাতি তথা আমরা দিতে পারিনি।

এই লেখাটি যখন লিখছি তখন আমার গাঁয়ে প্রচণ্ড জ্বর। ডাক্তারের পরামর্শ অবিলম্বে হাসপাতালে ভর্তির। আমরা কেউ জানি না আগামীকাল কী ঘটবে। চরম একরোখা, অনিয়ন্ত্রিত, বাউণ্ডুলে জীবন-যাপনে অভ্যস্ত সঞ্জীবদাও জানতেন না যে, তাঁর অকাল মৃত্যুতে পরিবারটির এমন বেহাল দশা হবে। জীবনের প্রতিটা বিন্দু উপভোগ করা ছিলো তাঁর বাসনা।

মানুষ মানুষের জন্য। আমাদের প্রত্যেকের জীবন অনিশ্চিত এবং সীমাবদ্ধ। শত চেষ্টা করলেও সঞ্জীবদাকে আমরা আর ফিরিয়ে আনতে পারবো না। কিন্তু আমাদের একটু প্রয়াস হয়তো পারে তাঁর শিশু কন্যাটির মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলতে। পারে তার ভবিষ্যৎ নিশ্চিত গড়ে তুলতে। যে কাজটি আজ সঞ্জীব চৌধুরীর স্ত্রীর পক্ষে দুরূহ, সেটি হয়তো আমাদের সহযোগিতায় সফল হতে পারে। আসুন, আমরা যে যার সীমাবদ্ধতার জায়গা থেকে সঞ্জীব চৌধুরীর পরিবারের পাশে দাঁড়াই। কিংবদন্তী যেন বড় হয়ে বলতে পারে সে একা নয়,তার পাশে রয়েছে তার পিতার অসংখ্য ভক্ত এবং বন্ধু।

সঞ্জীবদার সাথে সাক্ষাৎ শেষে বিদায়ের ক্ষণে একটি কথা তিনি আমাকে সব সময় বলতেন, “বন্ধু বিদায় বলো না, বলো জীবন ভালোবাসি”। সঞ্জীবদাকে কী ভুলে যাওয়া যায়? আমার স্মৃতিতে চিরকাল সঞ্জীবদা বেঁচে থাকবেন তাঁর প্রাণবন্ত মুখটি নিয়েই...

  • শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ: সাংবাদিক। ইমেইল : [email protected]

আপনার মন্তব্য

আলোচিত