শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ

২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ১৪:০৬

প্রীতিলতার ‘আত্মাহুতি’ এবং ‘আত্মহত্যা’র অসংহতি

কয়েকদিন ধরে ‘আত্মহত্যা’ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। পত্রিকা-সামাজিক মাধ্যম, ফেসবুক-টকশো, সর্বত্র। আত্মহত্যার বাক-বিতণ্ডায় নারী-পুরুষের বৈষম্যের বিষয়টি প্রাধান্য পাচ্ছে। একে অন্যকে দুষছেন। যদিও পারস্পরিক এই দোষারোপের ধারা বহু কালের। এই ধারায় পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা বাঙালিদের মাঝে একেবারেই ক্ষীণ।

প্রসঙ্গটা আজ মনে বেশী নাড়া দিচ্ছে। আজ ২৩ সেপ্টেম্বর। ১৯৩২ সালের এই দিনে ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম এক নারী পটাসিয়াম সায়ানাইড নামক বিষ খেয়ে ‘আত্মহত্যা’ করেছিলেন। সেই নারী নেত্রীর নাম প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। তার ডাকনাম রাণী এবং ছদ্মনাম ফুলতার। তৎকালীন পূর্ববঙ্গে জন্ম নেয়া এই বাঙালি বিপ্লবী তখনকার ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন এবং জীবন উৎসর্গ করেন। ১৯৩২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর প্রীতিলতা পাহাড়তলিতে ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

‘আত্মহত্যা’ বিষয়ক যে ব্যাখ্যাগুলো প্রচলিত, তার মধ্যে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য হচ্ছে, ‘আত্মহত্যা’ ভীতুদের কাজ। পরাজয়কে স্বীকার করে নেয়ার নমুনা। প্রশ্ন হচ্ছে, ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন নারী যোদ্ধা ও বিপ্লবী কী ভীতু ছিলেন? তিনি কী মানসিকভাবে অসুস্থ ছিলেন? তিনি কী জীবন নিয়ে হতাশায় ভুগছিলেন? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আমাদের জানা নেই। জানার সুযোগও নেই।

আধুনিক বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায়, যখন কোনো ব্যক্তি তার বিবেক, বুদ্ধিমত্তা বা বিচার বিবেচনা হারিয়ে ফেলে তখন সে নিজেকে হত্যা করে। নিজেকে হত্যা করাই ‘আত্মহত্যা’। আত্মহত্যা এক অর্থে আত্ম খুন- নিজেকে নিজে খুন করা। আত্মহত্যা বলতে এমন এক ধরনের মৃত্যুকে বুঝায় যেখানে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় বা নিজের হাতে নিজের জীবন সংহার করে। এটা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ হতে পারে।

কোনো ব্যক্তি স্বেচ্ছায় আত্মহত্যা করে না বরং বিভিন্ন সামাজিক ঘটনা ব্যক্তির আত্মহত্যা করার প্রবণতাকে প্রভাবিত করে। ফরাসি সমাজ বিজ্ঞানী এমিল ডুর্খেইম তার বিখ্যাত ‘The Suicide’ গ্রন্থে আত্মহত্যা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। আধুনিক সমাজে বিভিন্ন সামাজিক সংহতির ভিত্তিতে আত্মহত্যা লক্ষ্য করা যায়। তার মতে, আত্মহত্যা কোনো ব্যক্তিগত, মানসিক, বংশগত, ভৌগলিক বা দৈহিক কারণে ঘটে না বরং সামাজিক সংহতির মধ্যে নিহিত থাকে। তিনি মনে করেন, আত্মহত্যা হচ্ছে যান্ত্রিক সংহতির নেতিবাচক ফলশ্রুতি।

১৯১১ সালের ৫ মে চট্টগ্রামের পটিয়ার ধলঘাট গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন প্রীতিলতা। প্রীতিলতার জন্মে তার বাবা খুশি হতে পারেননি। তাছাড়া প্রীতিলতার গায়ের রঙ ছিলো কালো। সে সময়ে কন্যা সন্তানের জন্ম অনেকেই স্বাভাবিকভাবে নিতে পারতেন না। বিভিন্ন কারণে কন্যা-সন্তানকে পরিবার নিজেদের বোঝা মনে করতো। ৬ ভাই-বোনের মধ্যে প্রীতিলতা’র অবস্থান ছিলো দ্বিতীয়। তার মায়ের নাম প্রতিভা দেবী। বাবা জগদ্বন্ধু ওয়েদ্দেদার। তিনি ছিলেন মিউনিসিপাল অফিসের হেড কেরানি।

প্রীতিলতার ডাকনাম রানী। তার পড়াশোনার হাতেখড়ি মা-বাবার কাছে। তার স্মৃতিশক্তি ছিলো অসাধারণ। জগদ্বন্ধু ওয়েদ্দেদার মেয়েকে ড. খাস্তগির উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে সরাসরি তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি করান। অষ্টম শ্রেণিতে বৃত্তি পান তিনি। ওই স্কুল থেকে ১৯১৭ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন প্রীতিলতা। তারপর ভর্তি হন ঢাকার ইডেন কলেজে।

কলেজে পড়া অবস্থায় লীনা নাগের সঙ্গে তার যোগাযোগ হয়। লীনা নাগ ওই সময়ে দীপালি সংঘের নেতৃত্বে ছিলেন। শিক্ষা জীবনে প্রীতিলতা সফল অর্জন করেন। ১৯৩০ সালে সবার মধ্যে পঞ্চম ও মেয়েদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে আইএ পাস করেন।

বিএ পাস করে তিনি চট্টগ্রামের নন্দন কানন অর্পণাচরণ ইংরেজি বালিকা বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে যোগ দেন। ইডেন কলেজে পড়ার সময় বিপ্লবী সংগঠন 'দীপালি সংঘ'ও বেথুন কলেজে থাকতে 'ছাত্রী সংঘের সক্রিয় কর্মী হলেও মূলধারার রাজনীতিতে যুক্ত হন তিনি।

‘কুকুর ও ভারতীয়দের প্রবেশ নিষিদ্ধ’ এইরূপ অবমাননামূলক কথার জন্য ইউরোপিয়ান ক্লাব নিয়ে ক্ষুব্ধ ছিলো ভারতীয়রা। সে সময় প্রীতিলতার নেতৃত্বে বিপ্লবীরা ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ সফল করেন।

১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল। বিপ্লবী নেতা মাস্টারদা সূর্যসেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রামে অস্ত্র লুট, রেললাইন উপড়ে ফেলা, টেলিগ্রাফ-টেলিফোন বিকল করে দেয়াসহ ব্যাপক আক্রমণ হয়। এ আক্রমণ চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ নামে পরিচিতি পায়। এ আন্দোলন সারাদেশের ছাত্রসমাজকে উদ্দীপ্ত করে। চাঁদপুরে হামলার ঘটনায় বিপ্লবী রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের ফাঁসির আদেশ হয়। এবং তিনি আলীপুর জেলে বন্দি হন।

প্রীতিলতা রামকৃষ্ণের বোন পরিচয় দিয়ে তার সঙ্গে দেখা করতেন। রামকৃষ্ণের প্রেরণায় প্রীতিলতা বিপ্লবী কাজে আরো বেশি সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। ১৯৩১ সালে ৪ আগস্ট রামকৃষ্ণের ফাঁসি হওয়ার পর প্রীতিলতা আরো বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন। ওই সময়ের আরেক বিপ্লবী কন্যা কল্পনা দত্তের সঙ্গে পরিচয় হয় প্রীতিলতার। বিপ্লবী কল্পনা দত্তের মাধ্যমে মাস্টারদার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেন প্রীতিলতা।

১৯৩২ সালের মে মাসে প্রীতিলতার দেখা হয় মাস্টারদা ও বিপ্লবী নির্মল সেনের সঙ্গে। তার কাছ থেকে অস্ত্র প্রশিক্ষণ লাভ করেন। জুন মাসে বিপ্লবীদের শক্ত আস্তানা প্রীতিলতার জন্মস্থান ধলঘাটে সাবিত্রী দেবীর বাড়িতে মাস্টারদা তার সহযোদ্ধাদের সঙ্গে গোপন বৈঠক করার সময় ব্রিটিশ সৈন্যরা তাদের ঘিরে ফেলে।

বিপ্লবীরা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন,যুদ্ধে প্রাণ দেন,নির্মল সেন ও অপূর্ব সেন' অন্যদিকে ব্রিটিশ সেনা কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন ক্যামেরুন নিহত হন। এ ঘটনার পর পুলিশ সাবিত্রী দেবীর বাড়ি পুড়ে দেয়। মাস্টারদা প্রীতিলতাকে বাড়ি ফিরে স্কুলে যোগ দিতে বলেন। কিন্তু প্রীতিলতার ওপর পুলিশের নজরদারি বেড়ে যায়। এই কারণে জুলাই মাসে প্রীতিলতাকে আত্মগোপনে যাওয়ার নির্দেশ দেন মাস্টারদা।

১৯৩২ সালে আবার ক্লাব আক্রমণের পরিকল্পনা করা হয়। ওই বছর ১০ আগস্ট আক্রমণের দিন ধার্য করা হয়। সেপ্টেম্বর মাসে নারী বিপ্লবীদের নেতৃত্বে আক্রমণ হওয়ার কথা হয়। আর নেতৃত্বে থাকে কল্পনা দত্ত। কিন্তু আক্রমণের আগেই পুলিশের হাতে ধরা পড়ে কল্পনা দত্ত। তাই নেতৃত্বে দেয়া হয় প্রীতিলতাকে।

২৪ সেপ্টেম্বর রাতে ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণে সফল হন বিপ্লবীরা। প্রীতিলতা সেদিন পুরুষের বেশে আক্রমণে যোগ দেন। জয়ী হয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে ফেরার পথে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। এ অবস্থায় ধরা পড়ার আগেই সঙ্গে থাকা সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন তিনি।

বিপ্লবী আন্দোলনের পাশাপাশি নারীদের প্রতি বৈষম্যের বিরুদ্ধেও সোচ্চার ছিলেন প্রীতিলতা। শেষ মুহূর্তেও তিনি বলেছিলেন, 'নারীরা আজ কঠোর সংকল্প নিয়েছে যে আমার দেশের ভাগিনীরা আজ নিজেকে দুর্বল মনে করিবেন না। সশস্ত্র ভারতীয় নারী সহস্র বিপদ ও বাধাকে চূর্ণ করিয়া এই বিদ্রোহ ও সশস্ত্র মুক্তি আন্দোলনে যোগদান করিবেন এবং তাহার জন্য নিজেকে তৈয়ার করিবেন এই আশা লইয়াই আমি আজ আত্মদানে অগ্রসর হইলাম।'

প্রীতিলতা ভারত উপমহাদেশের ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম বিপ্লবী নারী, যিনি আত্মহত্যা করেন। এর মধ্যদিয়ে সূচিত হয় আত্মদানের ইতিহাস।

১৯৭১ সালে আরও শত শত প্রীতিলতার জন্ম হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কারণে। এটা ২০১৬ সাল। প্রীতিলতার মতো বহু ‘অগ্নিকন্যা’র জন্ম হয়েছে। ফলে, সমাজ এগিয়ে চলছে। নারীসমাজ দেশের সার্বিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

যখন-ই নারীর স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ আসে, ইতিহাস মনে করিয়ে দেয় সেই অতীতকে। সেই অগ্নিযুগের কন্যা বা নারীদের। নারী হিসেবে নয় মানবিকতা এবং সাহসিকতার দিক দিয়েই তারা দেশের জন্য সংগ্রাম করেছে। জীবিকার জন্য সংগ্রাম করেছে এবং করছে।

আত্মহত্যা রোধে কার্যকর পদক্ষেপ বা উদ্যোগের কোন প্রস্তাব বা মতামত কি আসছে? সামাজিক অবক্ষয়-দুর্নীতি-মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের কথা কী প্রাধান্য পাচ্ছে? সবচেয়ে ভয়াবহ, বিষয় হলো, 'আত্মহত্যা' ইস্যুকে কেন্দ্র করে অনেকের ব্যক্তিগত সম্পর্কেও ভাটা পড়ছে।

অসুস্থতা দোষের নয়। অন্যায়ের নয়। সেটা শারীরিক কিংবা মানসিক। অসুখের কারণ চিহ্নিত করতে পারলে, অনেক ক্ষেত্রে নিজেই সেটিকে সারিয়ে তোলার জন্য যথেষ্ট। সর্বক্ষেত্রে চিকিৎসকের প্রয়োজন হয় না। কিন্তু মিথ্যা আর ভণ্ডামির সংমিশ্রণে যে রোগ, সেটির যেমন নাম নেই চিকিৎসাও নেই। সুতরাং এর পরিণাম ভয়াবহ। যেই ভয়াবহ ঘূর্ণির আবর্তে আমরা।

পৃথিবীর বিভিন্ন মনীষীদের আত্মহত্যা সম্পর্কে উক্তি রয়েছে। তারা বলেছেন; নেপোলিয়নের মতে, ‘আত্মহত্যাই জীবনের সবচেয়ে বড় কাপুরুষতার পরিচয়’। সেন্ট অগাস্টিনের অভিমত হলো, ‘আত্মহত্যা অন্যায় ও নিকৃষ্ট কাজ’। ওভাটিন প্যিলিস বলেছেন, ‘জীবনের অকল্যাণ থেকে মুক্তি পাওয়ার প্রচেষ্টায় নিকৃষ্ট কাজ আত্মহত্যা’। দার্শনিক কান্ট মনে করতেন, ‘আত্মহত্যা অন্যায় কাজ। কেননা, আত্মহত্যা মানবতার আদর্শের পরিপন্থি, আত্মহত্যার বেলায় মানুষ তার মনুষ্যত্বের অমর্যাদা করে’। সুনীল কুমার নাগের মতে, ‘আত্মহত্যা নীতির চোখে অন্যায়, আইনে অপরাধ’।

আমরা যদি মনীষীদের উক্তি গুলো বিবেচনা করি, তাহলে একজন প্রীতিলতাকে ‘বীরকন্যা’ ‘অগ্নিকন্যা’ ‘সাহসীকন্যা’ প্রভৃতি উপমাগুলোতে কীভাবে সম্বোধন করবো? এটা কী পরস্পর বিরোধী বিষয় হয়ে দাঁড়ায় না?

প্রীতিলতা-ই প্রথম আত্মহত্যা করেছিলেন। তিনিই অন্যদের এই পথ দেখিয়েছেন, চিনিয়েছেন। তাকে কী এই পথের অনুপ্রেরণাদাত্রী হিসেবে বিবেচনা করা হয়? শেষ মুহূর্তেও তিনি বলেছেন।

যুদ্ধকালীন সময়ের ‘আত্মহত্যা’ সাহসী, আর অন্য যে কোন সময়ের আত্মহত্যা ভীরুতার, এটি কোন যুক্ত সংগত কথা হতে পারে না। মূল বিষয়টি হচ্ছে, পরিস্থিতি কেন্দ্রিক। কে কোন পরিস্থিতি কী করছে, সেটি শুধু-ই সে জানে। অন্য কারও পক্ষে জানা দুরূহ! কিন্তু একজন ‘আত্মহত্যা’ করার পর যে ধরণের খিস্তিখেউড় সম্প্রতি নজরে আসছে, সেটা সত্যিই দুঃখজনক। একটি অস্বাভাবিক মৃত্যুর পেছনের কারণ অনুসন্ধান না করে, মৃত মানুষটিকে ভীতু-কাপুরুষ আখ্যা দেয়া কতোটা যৌক্তিক?

  • শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ: সাংবাদিক। ইমেইল : [email protected]

আপনার মন্তব্য

আলোচিত