সিলেটটুডে ডেস্ক

২৭ নভেম্বর, ২০১৬ ০১:৩৯

যে জীবন বিপ্লবীর

১৯২৬ সালের ১৩ অাগস্ট জন্ম হয় ফিদেল আলেহান্দ্রো ক্যাস্ত্রো রুৎজের। ধনী কৃষক আনহেল মারিয়া বাউতিস্তা ক্যাস্ত্রোর সন্তান ছিলেন তিনি। সান্টিয়াগোর ক্যাথলিক স্কুলে শিক্ষাজীবন শুরু হয় ফিদেলের। স্কুলের পড়ার সময় থেকেই ফিদেল ছিলেন প্রখর বুদ্ধি  সম্পন্ন এবং খেলাধুলার প্রতি খুব ঝোঁক ছিল। উচ্ছৃঙ্খল জীবনই ছিল তার কাছে বেশি প্রিয়। স্কুল জীবনে বেপরোয়া আচার আচরণের জন্য তাকে ‘পাগল’ বলা হতো।

১৯৪৫ সালে তিনি হাভানা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখানে আইন পড়ার সময় তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। এসময় তিনি কিউবার জাতীয়তাবাদ আদর্শে উদ্বুদ্ধ হন ক্যাস্ত্রো। ওই সময়ে তার নেতৃত্বে ধর্মঘট ও সমাবেশ হয়। এবং তৎকালীন প্রেসিডেন্ট র‌্যামন গ্রাউ ও তার সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলেন।

স্পেন থেকে কিউবাতে আসা একজন ধনী কৃষক আনহেল মারিয়া বাউতিস্তা কাস্ত্রোর সন্তান ছিলেন ক্যাস্ত্রো। বাবার খামারের ভৃত্য ছিলেন মা লিনা রুৎজ গনজালেজ, যিনি পরবর্তীতে ছিলেন তার পিতার রক্ষিতা। ফিদেলের জন্মের পর তার মাকে স্ত্রীর মর্যাদা দেন তার বাবা।

কলেজ জীবনেই ফিদেল তার মেধার পরিচয় দেন। যদিও তার বিরুদ্ধে গুঞ্জন রয়েছে, ক্যাস্ত্রো সহিংস কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এসময় তার খ্যাতির কথা জেনে কিউবার ধনী এক রাজনীতিবিদের মেয়ে মার্টা ডিয়াজ বালার্টক কাস্ত্রোর প্রেমে পড়েন। পরে ১৯৪৮ সালে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হন তারা।

তবে ক্যাস্ত্রোর সঙ্গে বিয়ে দিতে রাজি ছিলেন না বালার্টকের ভাই। কাস্ত্রোকে বিয়ে না করার জন্য বোনকে অনেক ভাবে বুঝিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘কাস্ত্রো একটা পাগল ছেলে। সে ভীতু এবং তার মানসিক সমস্যা রয়েছে। তোমাকে ছুড়ে ফেলতে সে একটু দেরিও করবে না।’

তবে বিয়ের মাধ্যমে দেশটির এলিট শ্রেণীতে যুক্ত হওয়ার সুযোগ থাকলেও তার বদলে ক্যাস্ত্রো আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়েছেন মার্ক্সবাদে।

বিপ্লব

১৯৫০ সালে হাভানা ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতক শেষে করেন এবং আইন পেশায় ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন ক্যাস্ত্রো। এরপর ছোট পরিসরে আইন পেশা প্র্যাকটিস শুরু করেন। কিন্তু রাজনীতির প্রতি তার আগ্রহ ছিল বেশি। এই পরিস্থিতিতেও রাজনীতি অব্যাহত রাখেন তিনি।

১৯৫২ সা ফুলগেন্সিও বাতিস্তা একটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট কার্লোস প্রিয়র সরকারকে উচ্ছেদ করেন।

ক্যাস্ত্রো বিশ্বাস করতেন কিউবার লাগামহীন পুঁজিবাদের কারণে দেশটির যাবতীয় অর্থনৈতিক সমস্যার উদ্ভব এবং একমাত্র জনগণের বিপ্লবের মাধ্যমেই এই সমস্যার সমাধান হতে পারে। বাতিস্তার সরকারের নীতি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের মতই, যা ছিল ক্যাস্ত্রোর বিশ্বাসের পরিপন্থী।

ফলে বাতিস্তা সরকারকে উৎখাতের জন্য তিনি একটি গোপন সংগঠন গড়ে তোলেন যার নাম 'দ্য মুভমেন্ট'।

সশস্ত্র বিপ্লবের জন্য তার ভাই রাউল ক্যাস্ত্রোসহ ১০০ জন বিদ্রোহী নিয়ে অস্ত্র সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ১৯৫৩-র জুলাই মাসে সান্টিয়াগোর কাছে মোনাকাডা সেনা ছাউনিতে একটি আক্রমণের পরিকল্পনা করেন কাস্ত্রো।

আক্রমণটি ব্যর্থ হয় এবং বহু বিপ্লবী হয় নিহত হয় নয়তো ধরা পড়ে। বন্দীদের মধ্যে ক্যাস্ত্রো ও তার ভাই ছিলেন। তাদের দুই ভাইকে ১৫ বছরের কারাদণ্ড দেয় আদালত।

১৯৫৩ সালে তার বিচার শুরু হয়।

বিচারের শুনানিগুলো ক্যাস্ত্রো ব্যবহার করতেন সেনাবাহিনীর দমন-পীড়নের ঘটনাবলী ফাঁস করে দেয়ার মঞ্চ হিসেবে।

এসময় শুনানিগুলোতে বিদেশি সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকার ছিল, ফলে ক্যাস্ত্রোর জনপ্রিয়তা এসময় বেড়ে যায়। এসময় বাতিস্তা সরকার বিরোধী আন্দোলনের প্রতীক হয়ে উঠেন ক্যাস্ত্রো। সাধারণ ক্ষমার মাধ্যমে ১৯৫৫ সালের মে মাসে জেল থেকে ছাড়া পান ক্যাস্ত্রো।

জেলে থাকার সময়েই স্ত্রীকে তালাক দেন তিনি এবং মার্ক্সবাদে আরো ভালোভাবে জড়িয়ে পড়েন। ছাড়া পাওয়ার পর ফের গ্রেপ্তার এড়াতে মেক্সিকো পালিয়ে যান তিনি। সেখানে তার পরিচয় হয় আরেক তরুণ বিপ্লবী আরনেস্তো চে গুয়েভারার সঙ্গে।

১৯৫৬ সালের নভেম্বরে ১২ জন ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি ইঞ্জিন নৌকায় ৮১ জন সশস্ত্র সঙ্গীকে নিয়ে কিউবায় ফিরে আসেন ফিদেল ক্যাস্ত্রো। তারা সিয়েরা মায়েস্ত্রা পাহাড়ে আশ্রয় নেন এবং এখান থেকে হাভানার সরকারের বিরুদ্ধে দুই বছর ধরে গেরিলা আক্রমণ চালান।

১৯৫৯ সালের দোসরা জানুয়ারি বিদ্রোহীরা হাভানায় প্রবেশ করে। বাতিস্তা পালিয়ে যান। এসময় বাতিস্তার বহু সমর্থককে বিচারের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়।

এসব বিচার কার্যক্রমকে অনেক বিদেশি পর্যবেক্ষকই ‘অনিরেপক্ষ’ বলে মনে করেন।

কিউবার নতুন সরকার জনগণকে সব জমি বুঝিয়ে দেবার এবং গরীবের অধিকার সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি দেয়।

কিন্তু একই সাথে দেশে একটি এক দলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম করা হয়।

রাজবন্দী হিসেবে বহু মানুষকে কারাগারে এবং শ্রম শিবিরে পাঠানো হয়। হাজার হাজার মধ্যবিত্ত কিউবান বিদেশে পালিয়ে নির্বাসন নেন। ১৯৬০ সালের কিউবাতে থাকা সকল মার্কিন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রায়ত্ত খাতে নিয়ে নেয়া হয়। জবাবে যুক্তরাষ্ট্র কিউবার উপর একটি বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যা একবিংশ শতক পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।

ঠান্ডা যুদ্ধ

বিপ্লবের সময় তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়া এবং এর নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভের সাথে মিত্রতা তৈরি হয় ক্যাস্ত্রোর।

ফলে কিউবা পরিণত হয় ঠাণ্ডা যুদ্ধের যুদ্ধক্ষেত্রে। ১৯৬১ সালের এপ্রিল মাসে যুক্তরাষ্ট্র কাস্ত্রো সরকারকে উৎখাতের চেষ্টা চালায় একদল নির্বাসিত কিউবানকে দিয়ে দ্বীপটি দখল করিয়ে নেবার মাধ্যমে। ওই চেষ্টা ব্যর্থ হয়, বহু মানুষ এসময় নিহত হয়, হাজার খানেক মানুষ ধরা পড়ে।

এই ঘটনা পরবর্তীতে কিউবা নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। ফিদেল ক্যাস্ত্রো আমেরিকার এক নম্বর শত্রুতে পরিণত হন। সিআইএ তাকে হত্যার চেষ্টাও করে।

১৯৮০-র দশকে বিশ্ব রাজনীতির মোড় ঘুরতে শুরু করে।

মিখাইল গর্ভাচেভের নেতৃত্বাধীন মস্কো কিউবা থেকে আর চিনি কিনতে অস্বীকৃতি জানায়। এদিকে মার্কিন নিষেধাজ্ঞাও অব্যাহত থাকায় কিউবা বিরাট বিপদে পড়ে যায়। খাদ্য ঘাটতি দেখা দেয় এসময়।

এসময় ফিদেল ক্যাস্ত্রো ঘোষিত বিশ্বের সবচাইতে অগ্রসরমান কিউবা কার্যত মান্ধাতা যুগে ফিরে যায়।

১৯৯০ এর দশকে পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে হাজার হাজার কিউবান ভালভাবে বেঁচে থাকার আশায় সমুদ্রে পাড়ি জমায় যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। এসময় বহু মানুষ সমুদ্রে ডুবে মারা যায়।

কিন্তু অনেকেই এসব মৃত্যু এবং হাজার হাজার কিউবানের আমেরিকায় পাড়ি জমানোকে দেখেছেন ফিদেল ক্যাস্ত্রোর প্রতি অনাস্থার নিদর্শন হিসেবে। ক্যাস্ত্রোর শাসনামলে কিউবায় অবশ্য বহু অভ্যন্তরীণ উন্নয়নও হয়েছে।

দেশটির প্রতিটি নাগরিকই বিনামূল্যে উন্নত চিকিৎসা সেবা পায়।বিশ্বের বহু উন্নত দেশের তুলনায় কিউবায় শিশুমৃত্যুর হার কম।

শাসনামলের শেষ দশ বছরে নিজের বিপ্লবকে বাঁচাতে মুক্ত বাণিজ্যের কিছু কিছু দিক গ্রহণ করতে বাধ্য হন ক্যাস্ত্রো।

২০০৬ সালের ৩১ জুলাই ৮০তম জন্মদিনের কয়েকদিন আগে ভাই রাউলের হাতে সাময়িক শাসনভার দিয়ে একটি জরুরী অস্ত্রোপচারে যান তিনি। এসময় তার শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে। ২০০৮ সালের গোড়ার দিকে তিনি অবসরে যাবার ঘোষণা দেন ক্যাস্ত্রো।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত