সিলেটটুডে ডেস্ক

১৩ আগস্ট, ২০১৫ ০২:২৯

আইএসই কি শেষ বিপদ?

আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস) এর উগ্রবাদ, সন্ত্রাস আর ভয়াবহতা দিয়ে ইতোমধ্যেই সারা বিশ্বকে আতঙ্কিত করে তুলেছে। তাদের মাধ্যমে সন্ত্রাস যেভাবে ছড়িয়ে পড়েছে তাদের দখলকৃত এলাকায় তাতে করে বিশ্ববিবেকের কাছে প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে এর শেষটা কোথায়, অথবা আদৌ কি এর শেষ আছে?

এ সম্পর্কে ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকায় অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিভাগের গবেষক শুভঙ্কর ঘোষ ‘কে বলল, আইসিসই শেষ বিপদ?’ শিরোনামের এক নিবন্ধে লিখেছেন- মার্কিন হামলার সম্মুখে আইসিসের দাপট হয়তো চূর্ণ হবে। কিন্তু আইসিস-উত্তর পর্বে ইরাকের মর্মান্তিক ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হবে না তো? নিবন্ধের বিস্তারিত সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর ডটকম’র পাঠকদের জন্যে:

গত ফেব্রুয়ারির ঘটনা, টেলিভিশনের পর্দা জুড়ে ইরাকের মোসুল সংগ্রহালয়ে আইসিসের নির্বিচার ধ্বংসলীলা দেখে তামাম দুনিয়ার অনেক ইতিহাসপ্রেমী বিদগ্ধজনের শয্যাকণ্টকী হয়েছিল। স্বাভাবিক।

যদিও অনতিবিলম্বেই প্রতীচ্যের বাঘা বাঘা সংবাদ প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের আশ্বস্ত করে যে, উক্ত সংগ্রহের সিংহভাগই নাকি প্রতিরূপ, মূল প্রস্তর-প্রতিমাগুলো সযত্নে বাগদাদের কোনও গোপন স্থানে সংরক্ষিত রয়েছে। প্রায় ধুলিসাৎ হয়ে যাওয়া ইরাকি রাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোর এই চমকপ্রদ তৎপরতার আড়ালে পূর্ববর্তী এক আতঙ্কের স্মৃতি নিহিত।

২০০৩ সাল, দ্বিতীয় ইরাক যুদ্ধ তখন শেষের দিকে, এপ্রিলের এক বিকেলে শোনা গেল, সাদ্দাম হুসেন প্রশাসনের অন্যতম সামরিক ঘাঁটি মোসুল শহর নাকি অবশেষে মার্কিন সেনার নিরাপদ অধীনে। কেমন সে নিরাপত্তা? মুক্তি-উত্তর মোসুলে আরব বংশোদ্ভূত ইরাকি ও কুর্দদের মধ্যে হানাহানির সম্মুখে মার্কিন সেনাবাহিনী সে দিন প্রস্তর-প্রতিমাগুলোর মতোই নীরব দর্শক।

এই নীরবতার কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উদ্যোগের অন্যতম শরিক, উত্তর ইরাকের স্বশাসিত পার্বত্য প্রদেশ, কুর্দিস্তানের ‘পেশমার্গা’ বাহিনী। শব্দটির আক্ষরিক অর্থ ‘মৃত্যুপথযাত্রী’। ইতিহাসের নিরিখে সঙ্ঘবদ্ধ সমরবাহিনী নয় এরা, নানান কুর্দি জনজাতিভুক্ত গেরিলা যোদ্ধাদের একটা গোষ্ঠীমাত্র।

অতীতে এই পেশমার্গারা কখনও পারস্য সাম্রাজ্য, কখনও উসমানীয় সাম্রাজ্য, কখনও ইংরেজ, কখনও বা সাদ্দাম হুসেন প্রশাসনের বিরুদ্ধে কুর্দ জাতির আঞ্চলিক স্বাধীনতা রক্ষার্থে যুদ্ধ করে এসেছে। এ বাহিনীর বর্তমান রূপটা হাল আমলের নির্মাণ। ২০০৩-এর ইরাক আক্রমণের সময় দূরস্থ উত্তর-ইরাকের পার্বত্য অঞ্চল, অস্ত্র-বর্ম সজ্জিত মার্কিন সেনাবাহিনীর কাছেও এক দুর্নিবার ঘাঁটি প্রমাণিত হয়।

দুর্গম গিরি কান্তার মরু লঙ্ঘনের স্বার্থে আমেরিকার কাছে এই বাহিনী অপরিহার্য হয়ে ওঠে। আইসিস জঙ্গিদের বিরুদ্ধেও পেশমার্গা বাহিনীর সাফল্য মার্কিন সেনার তুলনায় অনেক বেশি। ফলত, এরা আজ নেটো-র অস্ত্রাগারের আধুনিকতম আয়ুধে সুসজ্জিত ও রণকৌশলে প্রশিক্ষিত।

১৯৯১ সালেও সাদ্দামের বিরুদ্ধে উত্তর-ইরাকের এই কুর্দ সম্প্রদায়ের পুঞ্জীভূত আক্রোশে মার্কিন সেনা ইন্ধন দিয়েছিল। এর ফল, দুই যুযুধান কুর্দ-গোষ্ঠী, ‘কুর্দ স্বাদেশিক পার্টি’ ও ‘কুর্দ গণতান্ত্রিক পার্টির’ মধ্যে ১৯৯৫-৯৮ তিন বছর ব্যাপী রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ। এই গৃহযুদ্ধের পরোক্ষ প্রজনন গোঁড়া ইসলামি জেহাদি গোষ্ঠী ‘অনসর-অল্‌ ইসলাম’, যার নাম এখন আইসিস।

২০০৩-এর যুদ্ধ কার্যত উত্তর ইরাকের পেশমার্গা বনাম ‘অনসর-অল্‌ ইসলাম’ সশস্ত্র সংঘর্ষ। এর মূলে কুর্দিজাতির অভ্যন্তরীণ সংঘাত এবং রাজনৈতিক স্বার্থে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই দ্বন্দ্বের সুনিপুণ ব্যবহার।

ত্রুটিজর্জরিত সাদ্দাম প্রশাসন ইরাকে অল্‌-কাইদার বিস্তার বজ্রমুষ্টিতে দমনে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু ২০০৩-এর অভিযান স্থিতাবস্থা সম্পূর্ণ আন্দোলিত করে তোলে। সাদ্দামের পতনের পর, আমেরিকা-ব্রিটনের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিষ্ঠিত নৌরি অল্‌-মালিকি সরকার কার্যত শিয়াপ্রধান এক গোষ্ঠী, যারা এযাবৎ ক্ষমতাসীন সুন্নিদের বঞ্চিত করতে শুরু করে। এর প্রেক্ষাপটেই ইরাক জুড়ে অল্‌-কাইদার ক্ষমতা বিস্তার। মালিকি সরকারের সুন্নি বঞ্চনা/দমন-এর সব খবরের জবাবে মার্কিন প্রতিক্রিয়া ছিল সেই প্রস্তর নীরবতা।

আইসিসের বর্তমান ক্ষমতা বিস্তারের ইতিহাসে প্রধান দুই ঘটনা, ২০১১ সালে মার্কিন সেনাবাহিনীর ইরাক থেকে পশ্চাদপসরণ ও সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ পরবর্তী অরাজক পরিস্থিতি। মনে রাখা দরকার, সিরিয়ার রাষ্ট্রপতি বাশার অল্‌-আসাদ-এর বিরুদ্ধে তদানীন্তন অভ্যুত্থানকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি সমর্থন জানায়।

প্রেসিডেন্ট ওবামা সিরিয়ার বিদ্রোহীদের সাহায্যের অঙ্গীকারও করে বসেন। টিভির পর্দায় আইসিস জঙ্গিদের হাতে যে সব অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র দেখা যায়, সেগুলি কিন্তু সবই ‘মেড ইন অ্যামেরিকা’, যা নাকি সিরিয়ার বিপ্লবীদের ত্রাণে বণ্টিত।

মার্কিন ‘মধ্যবর্তিতা’র পূর্ণ ব্যবহার করে গত বছর ইরাকের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে যখন আইসিসের পুনরাবির্ভাব ঘটে, তখন তার বিরুদ্ধে প্রথম সংগঠিত সামরিক প্রতিরোধ গড়ে তোলে কুর্দ পেশমার্গারা। সেই থেকে কোবানি, তেল আবায়েদ, আইন ইস্‌সা, কিরকুক সহ বহু গুরুত্বপূর্ণ জনপদ আইসিসের কবলমুক্ত করেছে তারা।

তবে তাদের এই আশাতিরিক্ত সাফল্য পশ্চিম দুনিয়ার কপালে নতুন আশঙ্কার ভাঁজ ফেলেছে। কুর্দদের রণোন্মাদনা দেখে একাধিক পর্যবেক্ষক প্রশ্ন তুলছেন: তারা কি আইসিসের বিপক্ষে লড়াই করছে, না কি তাদের পিছনে আছে বৃহত্তর কোনও স্বার্থ?

উত্তর-ইরাক ও পার্শ্ববর্তী সিরিয়া, তুরস্ক এবং ইরানের বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে এই কুর্দ বা কুর্দি জাতির বাস। রাষ্ট্রপুঞ্জের হিসেবে, আরব, পারসিক ও তুর্কিদের পরে পশ্চিম এশিয়ার বৃহত্তম জনগোষ্ঠী এরা। অথচ আরব, পারসিক বা তুর্কিদের মতো অতি প্রাচীন এক জাতীয়তাবাদী পরম্পরা থাকা সত্ত্বেও, আজ পর্যন্ত তাদের নিজস্ব ভৌগোলিক রাষ্ট্র নেই।

প্রথম মহাযুদ্ধে, পশ্চিম এশিয়ার বরিষ্ঠতম রাজনৈতিক ক্ষমতা, উসমানি সাম্রাজ্যের পতনের পর, ১৯২০-২১ সালে প্যালেস্টাইনের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত বিস্তীর্ণ মরু-অঞ্চলে দুটি ইংরেজ অনুশাসিত রাজ্যের জন্ম হয়। যথাক্রমে, ট্রান্সজর্ডন এবং ম্যান্ডেটরি ইরাক। এর ফলে সাবেক কুর্দিস্তান চারটে আঞ্চলিক প্রদেশে বিভক্ত হয়ে। এই বিভাজনের কারণে একদা সংখ্যাগরিষ্ঠ কুর্দিরা আজ চারটি দেশে বিক্ষিপ্ত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়।

আনুমানিক তিরিশ কোটির এই জনজাতিকে পুনরায় একত্রিত করবার প্রয়াসে সচরাচর বাধ সেধেছে কোনও না কোনও আঞ্চলিক রাষ্ট্রশক্তি অথবা কুর্দদের অন্তর্দ্বন্দ্ব। ১৯৬০ সালে গৃহীত ইরাকি সংবিধানে কুর্দ ও আরবদের সমান অধিকার দেওয়া হলেও সে অধিকারের সিকিভাগও কখনও টাইগ্রিস নদী অতিক্রম করে কুর্দিস্তানের পর্বতমালা পর্যন্ত পৌঁছয়নি।

ফলত, ইরাকি-কুর্দি সম্পর্কের তিক্ততা গোটা ষাটের দশক জুড়ে ওই অঞ্চলের শান্তি বিঘ্নিত করেছ। সাদ্দাম হুসেন জমানার প্রথম ভাগে ইরাক এবং ইরানের মধ্যে সুদীর্ঘ যুদ্ধ কুর্দ জাতির ইতিহাসে এক মর্মান্তিক গণহত্যার অধ্যায়। কিন্তু সেই বিভীষিকাও ম্লান হয়ে যায় ১৬ মার্চ ১৯৮৮ সালের বর্বরোচিত ঘটনায়। ইরাক-ইরান যুদ্ধের শেষ লগ্নে, দক্ষিণ কুর্দিস্তানের হালাব্‌জা শহরে, সাদ্দাম হুসেন সরকারের নির্বিচার রাসায়নিক বোমা বর্ষণে অন্তত ৫০০০ কুর্দি নারী-পুরুষ-শিশু প্রাণ হারায়।

ইতিহাসে এমন নজির অনেক, যখন উপস্থিত যুদ্ধপরিস্থিতি কোনও উপদ্রুত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মুক্তির অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে। ১৯৯১ সালে ইরাকে মার্কিন আক্রমণ কুর্দ জাতির স্বাধীনতার উদ্দেশ্য সাধন করতে না পারলেও, কুর্দিস্তানের স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়। কিন্তু ইতিহাসের গতি বরাবরই কুটিল। বর্তমান ইরাকের রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা, কুর্দিস্তান প্রশ্নে এক প্যান্ডোরার বাক্স উন্মুক্ত করে দিয়েছে।

আইসিস অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে তাদের ধারাবাহিক প্রতিরোধ এবং আরব অধ্যুষিত দক্ষিণ ইরাকের রাজনৈতিক ক্ষমতা হ্রাস, বিশেষত প্রধানমন্ত্রী নৌরি মালিকির বিরুদ্ধে বাড়তে থাকা অনাস্থাকে পুঁজি করে ২০১৪’য় কুর্দি প্রশাসন কুর্দিস্তানের স্বাধীনতার এক প্রস্তাবে গণভোট ডাকে।

কিন্তু পূর্বসূরিদের মতো নৌরি উত্তর ইরাকের তেল-সম্পদ হাতছাড়া হওয়ার ভয়ে কুর্দি প্রশাসনের উপর আন্তর্জাতিক কূটনীতির চাপ তৈরি করেন। ফলে, কুর্দি গণভোটের দাবি আইসিস সঙ্কটের নভোমণ্ডলে লীন হয়ে যায়। ইরাক ও সিরিয়ায় আইসিস অভ্যুত্থান-পরবর্তী অরাজকতার মধ্যে কুর্দ নেতারা দলবদ্ধ হওয়ার একটা জোরালো সম্ভাবনা দেখছেন।

অনেকের মতে কুর্দিস্তানের সম্ভাব্য স্বাধীনতা আরও একটি সংখ্যালঘু সমস্যার জন্ম দিতে চলেছে। হিউম্যান রাইটস্‌ ওয়াচ-এর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী সিরিয়া ও ইরাকে বিস্তৃত কুর্দি অধীনে মুক্তাঞ্চলের গ্রামেগঞ্জে এক প্রকারের সাইনবোর্ড প্রায়ই দেখা যাচ্ছে। তাতে লেখা: আরবদের প্রবেশাধিকার নেই।

এই সংস্থার বিশেষ পর্যবেক্ষক জানিয়েছেন, ‘যাঁরা কুর্দদের অস্ত্র সরবরাহ করছেন, তাঁদের সতর্ক থাকা উচিত, এই সব অস্ত্র যেন ভবিষ্যতে আরব উদ্বাস্তুদের উপর প্রযুক্ত না হয়।’ প্রসঙ্গত, মার্কিন প্রতিরক্ষা দফতরের এক বিশেষজ্ঞের মতে, ‘ইরাকের বর্তমান পরিস্থিতি মারাত্মক এক আপাত-বৈপরীত্যের মধ্যে দাঁড়িয়ে।

এক দিকে কুর্দি পেশমার্গা বাহিনির নির্ভরযোগ্য কোনও বিকল্প নেই। অন্য দিকে, আইসিসের বিরুদ্ধে প্রত্যেকটি সামরিক জয়, আসন্ন আর একটি সংঘর্ষের অশনি সংকেত বহন করে আনছে।’ নিরবচ্ছিন্ন মার্কিন হামলার সম্মুখে আইসিসের দাপট হয়তো দীর্ঘস্থায়ী হবে না।

কিন্তু, আইসিস-উত্তর ইরাকে সেই মর্মান্তিক ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হবে না তো? বর্তমান সঙ্কট হিংস্রতর কোনও দুর্বৃত্তের জন্যে জমি তৈরি করে দিয়ে যাবে না তো?

আপনার মন্তব্য

আলোচিত