সিলেটটুডে ডেস্ক

১৪ জুলাই, ২০১৫ ১২:২৬

রাজাকার ফোরকান মল্লিকের যুদ্ধাপরাধের রায় বৃহস্পতিবার

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অপরাধে অভিযুক্ত পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জের রাজাকার ফোরকান মল্লিকের যুদ্ধাপরাধের রায় ঘোষণা করা হবে আগামি ১৬ জুলাই বৃহস্পতিবার। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ মঙ্গলবার রায় ঘোষণার এ দিন ধার্য করে।

গত ১৪ জুন আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক শেষে ট্রাইব্যুনাল মামলাটিকে রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি- কোর্ট এওয়েটিং ভারডিক্ট) তালিকায় রেখেছিলেন।

ফোরকানের বিরুদ্ধে হত্যা-গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, ধর্মান্তরকরণ ও দেশান্তরকরণের ৫টি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ রয়েছে।

এর আগে ফোরকানের বিরুদ্ধে যুক্তিতর্ক শেষ করেছেন কৌঁসুলিরা। প্রসিকিউটর মোখলেসুর রহমানের দাবি, ফোরকান স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ডা. দেবেন্দ্রনাথ ও তার স্ত্রী দিবা রানী এবং হাফেজ খলিফা হত্যার সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন। গত ১৯ জানুয়ারি সূচনা বক্তব্যের মাধ্যমে মামলার কার্যক্রম শুরু করা হয়।

১৯ এপ্রিল পর্যন্ত ফোরকান মল্লিকের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তা সত্য রঞ্জন রায়সহ রাষ্ট্রপক্ষের ১৪ জন সাক্ষী। নির্যাতনের শিকার এক নারীও ক্যামেরা ট্রায়ালের মাধ্যমে তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন। অন্য সাক্ষীরা হলেন হাবিবুর রহমান বাদশা, মো. চান মিয়া, কবিরাজ শান্তি রঞ্জন দে, সেলিম হাওলাদারসহ অনেকে।

গত ২৬ এপ্রিল থেকে ১৭ মে পর্যন্ত আসামি পক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছেন চারজন সাফাই সাক্ষী। তারা হলেন- ইসহাক আলী খান, মৃদুল চন্দ্র সেন মধু, গোবিন্দ কুণ্ডু। গত বছরের ২৬ জুন শুরু করে ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত মামলাটির তদন্ত করেন তদন্ত কর্মকর্তা সত্যরঞ্জন রায়।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের দায়ে ২০০৯ সালের ২১ জুলাই ফোরকানের বিরুদ্ধে মির্জাগঞ্জ থানায় আবদুল হামিদ নামে এক ব্যক্তি মামলা দায়ের করেন।

২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ফোরকান মল্লিকের বিরুদ্ধে পটুয়াখালীর আদালতে বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু হয়। এ সময় তিনি উচ্চ আদালত থেকে ছয় মাসের জামিন নেন। গত বছরের ৩০ মার্চ বিচারিক কার্যক্রম চলাকালে আদালতে হাজির না হওয়ায় তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়।

ফোরকান মল্লিকের বিরুদ্ধে বিচারিক প্রক্রিয়া চলাকালে তার বিরুদ্ধে হত্যা, লুণ্ঠন, খুন, ধর্ষণসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রমাণ পান পটুয়াখালীর আদালত। তখন মামলাটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়।

ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার একেএম নাসির উদ্দিন মাহমুদ মামলাটি গত বছরের ২৫ জুন তদন্ত সংস্থার কাছে পাঠান। তদন্ত সংস্থা মামলাটি গ্রহণ করে ২৬ জুন থেকে তদন্ত শুরু করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা সত্যরঞ্জন রায়।

৩০ জুন, ২০১৪ ফোরকান মল্লিককে মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় গ্রেফতার দেখানো (শ্যোন অ্যারেস্ট) ও তদন্তের স্বার্থে ট্রাইব্যুনালে হাজির করানোর আবেদন জানান প্রসিকিউটর প্রসিকিউটর মোখলেসুর রহমান বাদল। শুনানি শেষে ফোরকান মল্লিককে ৩ জুলাই ট্রাইব্যুনালে হাজির করানোর জন্য কারা মহাপরিদর্শককে আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল-২।

২০১৪ সালের ১৮ ডিসেম্বর ফোরকানের বিরুদ্ধে হত্যা-গণহত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, ধর্মান্তরকরণ ও দেশান্তরকরণের ৫টি মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযোগ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল-২। এর মধ্যে রয়েছে ৮ জনকে হত্যা ও গণহত্যা, ৪ জনকে ধর্ষণ, ৩ জনকে ধর্মান্তরকরণ, ১৩টি পরিবারকে দেশান্তরকরণ, ৬৪টি বসতঘর ও দোকানপাটে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগ।

২৭ অক্টোবর, ২০১৪ ফোরকান মল্লিকের বিরুদ্ধে তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেন তদন্ত সংস্থা। আসামির বাড়ি পটুয়াখালী জেলার মির্জাগঞ্জ উপজেলার ছইলাবুনিয়া গ্রামে। দীর্ঘদিন পলাতক থাকার পর গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ২৫ জুন, ২০১৪ সকালে পটুয়াখালী গোয়েন্দা শাখার একটি দল বরিশালের রূপাতলী বাসস্ট্যান্ড এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করে।

ফোরকান মল্লিকের বিরুদ্ধে পাঁচ অভিযোগ
১৯৭০-৭১ সালে ফোরকান মল্লিক মুসলিম লীগের একজন সমর্থক ও কর্মী হিসেবে একই গ্রামের শান্তি কমিটির সভাপতি আজহার উদ্দিন খান, খবির বিশ্বাস, সুবিদখালীর শাহজাহান সিকদার, আ. ওয়াজেদ সিকদার, কাকড়াবুনিয়া গ্রামের আলী আকবর গাজী, ইউসুফ আলীসহ অন্যান্যদের সঙ্গে মুসলিম লীগের পক্ষে প্রচারণা চালান।

পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তারা রাজাকার বাহিনী গঠন করেন। পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ থানার সুবিদখালী পুরাতন হাসপাতাল ভবনটিতে ছিল রাজাকারদের প্রধান ক্যাম্প। মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক সুবিদখালী বাজারের ডা. দেবেন্দ্রনাথ সরকার ও তার স্ত্রীকে হত্যার পর ওই বাসাটি থানা শান্তি কমিটির প্রধান কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করেন তারা। এসব ক্যাম্প-কার্যালয় থেকে মির্জাগঞ্জ থানার বিভিন্ন এলাকায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নানা মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেন ফোরকান মল্লিক ও তার বাহিনী।

প্রথম অভিযোগ: ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আষাঢ় মাসের মাঝামাঝি সময় (ইংরেজি ২৭ জুন থেকে ৩ জুলাই) সকাল ছয়টার দিকে ফোরকান মল্লিক ও তার সঙ্গী অন্যান্য সশস্ত্র রাজাকাররা গানবোটে করে পাকিস্তানি সেনাদের মির্জাগঞ্জ থানার কাকড়াবুনিয়া গ্রামে নিয়ে আসেন। পাকিস্তানি সেনাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে আসার পর ওই গ্রামের হাওলাদার বাড়ির মো. কাঞ্চন আলী হাওলাদার ও হাজী আবুল হাশেম হাওলাদারসহ মোট সাত জনকে আটকের পর আটককৃতদের ওপর নির্যাতন চালান, বাড়ি-ঘর লুটপাট এবং জোর করে অর্থ আদায় করেন। আটককৃতদের এক মাস আটক রাখার পর ছেড়ে দেওয়া হয়।

দ্বিতীয় অভিযোগ: মুক্তিযুদ্ধের সময় আষাঢ় মাসের শেষের দিকে (ইংরেজি ২ জুলাই থেকে ১৭ জুলাই) সকাল সাড়ে নয়টার দিকে ফোরকান মল্লিক ও তার সঙ্গী অন্যান্য সশস্ত্র রাজাকাররা গানবোটে করে পাকিস্তানি সেনাদের মির্জাগঞ্জ থানার দেউলি গ্রামে নিয়ে আসেন। পাকিস্তানি সেনাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে আসার পর ওই গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আলতাফ হায়দারসহ মোট ছয়জনের ঘর-বাড়িতে লুটপাটের পর অগ্নিসংযোগ করেন।

তৃতীয় অভিযোগ: ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ১২ আগস্ট থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সময়ের মধ্যে ফোরকান মল্লিক ও তার সঙ্গী অন্যান্য সশস্ত্র রাজাকাররা গানবোটে করে পাকিস্তানি সেনাদের মির্জাগঞ্জ থানার সুবিদখালীতে নিয়ে আসেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সংবাদবাহক কাকড়াবুনিয়া গ্রামের হাফিজ উদ্দিন খলিফা, মির্জাগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. আব্দুল কাদের জমাদ্দার, সুবিদখালী বাজারের ডা. দেবেন্দ্রনাথ ও তার স্ত্রী বিভা রানীকে আটকের পর নির্যাতন চালিয়ে তাদের হত্যা করেন। এ অভিযোগে ফোরকান মল্লিকের বিরুদ্ধে গণহত্যা, লুটপাট, ধর্ষণ, ধর্মান্তরকরণ এবং বিতারণের অভিযোগ আনা হয়েছে।

চতুর্থ অভিযোগ: ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ৫ থেকে ৮ ভাদ্র (ইংরেজি ২২ আগস্ট থেকে ২৫ আগস্ট) সময়ের মধ্যে ফোরকান মল্লিক ও তার সঙ্গী অন্যান্য সশস্ত্র রাজাকাররা গানবোটে করে পাকিস্তানি সেনাদের মির্জাগঞ্জ থানার কাকড়াবুনিয়া বাজারে আসেন। এখানে তারা চারজনকে হত্যা করেন। এছাড়াও ফোরকান মল্লিক ও তার সহযোগী রাজাকার এবং পাকিস্তান সেনারা হত্যা, গণহত্যা, জখম, আটক, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগের মতো অপরাধ সংঘটিত করেন।

পঞ্চম অভিযোগ: ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ৫-৮ ভাদ্র (ইংরেজি ২২ আগস্ট থেকে ২৫ আগস্ট ১৯৭১) সময়ের মধ্যে ফোরকান মল্লিক ও তার সঙ্গী অন্যান্য সশস্ত্র রাজাকাররা মির্জাগঞ্জ থানার দক্ষিণ কলাগাছিয়া গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মো. আবুল হোসেন মৃধাকে আটকের পর নির্যাতন এবং বাড়ি-ঘর লুটপাট করেন।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত